মাথা গোঁজার ঠাঁই কোথায়?

খুশী কবির:

২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি আমার অজান্তে লিখতে বসেছিলাম। আমি আমার অনুভূতি, আমার হতাশা, আমার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আমার ভয়-ভীতিগুলোই লিখছিলাম। অধ্যাপক করিম একজন নিরীহ ধরনের মানুষ ছিলেন; শান্ত প্রকৃতির সংগীতপ্রিয় নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। আর সব বাঙালির মতো তিনিও সংগীত ভালো বাসতেন। তাঁর রক্তে ছিলো সাংস্কৃতিক চেতনা। ফলে তিনি সব সময় সবখানে তা-ই করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি যে বাসাটায় থাকতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের খুবই কাছে, সেই বাসাটাও একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

prof-afm-rezaul-karim-siddiqueeঅধ্যাপক করিম ঘোষিত কোনো নাস্তিক বা ব্লগার ছিলেন না, এমনকি তিনি ফেসবুক অ্যাকটিভিস্টও ছিলেন না। গতানুগতিক তর্কপ্রিয় বাঙালি বা বুদ্ধিজীবীদের সাথেও তার কোনো মিল নেই। এমনকি তিনি সামনের সারির কোনো আন্দোলনকর্মীও ছিলেন না, ছিলেন না খ্যাতিমান টকশোজীবী কিংবা এমন কোনো লেখক, যারা দেশের হাল-চাল নিয়ে পত্রিকায় দীর্ঘ মতামত বা সম্পাদকীয় লিখে থাকেন। তাহলে কেন তিনি খুন হলেন?

নানারকম সংবাদমাধ্যমের নানারকম সংবাদ থেকে আমি যে সংবাদ পাই তা হচ্ছে, আমি বিভিন্ন সময়ে যে বাঙালির কথা বলি, যে ভূমিপুত্রের কথা বলি, এবং আমি যে ধরনের মানুষের সংস্পর্শ-সাহচর্যে বড় হয়েছি, তিনি অনেকটা সে ধরনের মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন মাটির মানুষ, শিকড়সন্ধানী মুক্তমনা। তার চিন্তা-চেতনা ধ্যান-জ্ঞানজুড়ে ছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সংগীত।

তিনি সেতার বাজাতেন, বই পড়তেন এবং এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই থাকতেন। পাশাপাশি তিনি সামাজিক জীবনে তাঁর সহজ সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী স্বজন-পরিজন প্রতিবেশীদের সাথেও সুসম্পর্ক রাখতেন। তাঁর গ্রামের মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অংক অনুদান হিসেবে দিয়েছেন।

তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কন্যাও খুব জোরের সঙ্গে দাবি করেছে যে, তার বাবা ‘ধার্মিক’ বা ‘বিশ্বাসী’ ছিলেন। আর এখানে এসেই আমি থমকে দাঁড়াই। আমি আমার বর্তমান রাষ্ট্রকেও প্রায় সময় ঠিক একইরকমভাবে কথা বলতে শুনি।

রাষ্ট্রও আমাদের সবাইকে এরকম ‘ধার্মিক’ বা ‘বিশ্বাসী’ হওয়ার ওয়াজ শোনাচ্ছে। কিন্তু কেন? হত্যাকাণ্ড তো হত্যাকাণ্ডই! একেকটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের পর কেন এরকম ‘ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের’ সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের শিকার লোকটির ‘ধর্মবিশ্বাস’-এর প্রশ্ন আসবে? সে ‘বিশ্বাসী’ ছিল কী ছিল না এসব প্রশ্ন কেন আসবে?

আমরা তো প্রায় সবাই গান গেয়ে, নাচ শিখে, কোনো না কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, কবিতা লিখে এবং আবৃত্তি করে বা এরকম কোনো না কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থেকে বড় হয়েছি। আমরা তো ভাবতেও পারি না, এরকম ‘সংস্কৃতি-সম্পৃক্ততা’র কারণে কেউ খুন হতে পারেন বা তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ চালাতে পারে, তাঁকে অবমান-অসম্মান করতে পারে!

তাহলে কী ধরে নেব দেহ-মনে চিন্তায়-চেতনায় কাজে-কর্মে একজন প্রকৃত বাঙালি হওয়াই অধ্যাপক করিমের ভুল ছিল? তাই আর যেন কেউ তাঁর মতো না হয় সে কারণেই তাঁকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো? নাকি তিনি ১৯৫২ আর ১৯৭১-এর মহান চেতনার প্রকৃত সূর্যসন্তান ছিলেন বলেই তাঁকে নিঃশেষ করা হলো?

Xulhaz-Mannanঅধ্যাপক করিম হত্যার শোকাচ্ছন্নতা কাটতে না কাটতেই আমরা ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যায়, জুলহাজ মান্নান আর মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের খবর শুনতে পেলাম। রাজধানীর ঢাকার একেবারে কেন্দ্রস্থলে, জনবসতিপূর্ণ এলাকা কলাবাগানে, জুলহাজের নিজ বাসায়, ওদের দুজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমাদের আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে জুলহাজ খুবই পরিচিত ছিলেন। এলজিবিটি ম্যাগাজিন ‘রূপবান’-এর সম্পাদনার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শোনার পর আমার পরিচিত অনেককে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখেছি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-বয়সের বিপুলসংখ্যক মানুষ, যারা সাধারণত খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায় না, তারাও তাঁর মৃত্যুতে মুষড়ে পড়ে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা তাঁকে কাছ থেকে চিনতেন, তাঁর সংস্পর্শ-সান্নিধ্য পেয়েছেন। তারা তাঁকে শান্ত-শিষ্ট প্রকৃতির একজন সদালাপী হাসি-খুশি মানুষ হিসেবে জানতেন; যিনি বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এক অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কথা বলতেন। এমন এক বাংলাদেশ, যে দেশ তার সব মানুষ, সব বিশ্বাস, সব শ্রেণি-পেশা-পরিচয়কে সগর্বে এবং নির্ভয়ে ধারণ করবে।

সত্যিকারের সাহসী বলতে যা বুঝায়, জুলহাজ তা-ই ছিলেন। তিনি কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেননি। কখনোই ভাবেননি তাঁর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কখনোই দেশ-ত্যাগের কথা ভাবেননি, যেমন ভাবেননি তাঁর কাজকর্ম এবং বিশ্বাস থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা।

তাঁর আত্মরক্ষার অনেক উপায় ছিল, তাঁর জন্য অনেক পথ খোলা ছিল। তিনি কখনো এসব পথ ব্যবহার করে আত্মরক্ষায় আত্মগোপন করেননি বা বিদেশে চলে যাননি। কারণ তাঁর কাঁধে অঘোষিত অলিখিতভাবে তাঁর পরিবার, দেশ, সহকর্মী এবং বন্ধু-স্বজনদের দায় ছিল। তিনি তাঁর বয়স ভারাক্রান্ত অচলপ্রায় মায়ের দেখাশোনার ভারও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেই মায়ের সামনেই তাঁকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়।

জুলহাজ অন্য সবাইকে কীভাবে সাহস দেবেন যদি তিনিই উপস্থিত না থাকেন? তিনিই যদি ভয়ে দেশ ছেড়ে পালান? আমরা যারা জুলহাজকে চিনতাম, আমরা তাঁকে এরকমভাবেই চিনি। আমার সাথে তাঁর খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না। টুকটাক যা-ই হতো কাজের প্রয়োজনে।

সর্বশেষ কথা হয় পহেলা বৈশাখে (১৪২৩)। শুনতে পাই মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে চার সমকামী যুবককে ধরে নিয়ে গেছে শাহবাগ থানার পুলিশ। আমি ফোনে তাঁর কাছে জানতে চাই কোনোরকম সাহায্য লাগবে কীনা!

সে দৃঢ়বিশ্বাসের সঙ্গে পরিস্কারভাবে জানায়, ‘না, সমস্যা নেই। আমরা আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দেবে। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।’ এটাই ছিল আমার তাঁর সাথে শেষ কথা-বার্তা। তাঁর বন্ধু তনয় ছিলেন একজন নাট্যকর্মী। তারা দুজনেই মানুষের মধ্যে বিশ্বাস এবং সাহস জুগাতেন।

এসব হত্যাকাণ্ডের পর, এমন অনেকের সাথে আমার কথা হয়েছে যারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চান, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সব জেনে-শুনেও ওরা কেমন করে দেশে থাকাটাকেই নিরাপদ মনে করলো? কেন ওরা অন্য কোনো দেশে চলে গেলো না? তাদের কথা শুনলে মনে হবে, তারা বলতে চান, তাহলে কেন তাদেরকে খুন করা হবে না?

কিন্তু আমি বলতে চাই, তারা কাউকে কোনোদিন কোনো আঘাত বা আক্রমণ করেননি। তারা কখনোই কোনো সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন না। তাদের মতাদর্শ বা ভাবনা-চিন্তাও তারা কারও উপর কখনোই জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেননি। বরং তারা সবসময় সবার মতামত প্রকাশের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। জুলহাজের বাসাটি সব সময় সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। যার যখনই একটু স্বস্তি-শান্তি মনোবল বুদ্ধি-পরামর্শের প্রয়োজন পড়তো, সে-ই তখন ছুটে যেত ওর বাসায়।

জুলহাজ ও তনয়-এই নিরীহ দুজনকে তো আমি কখনোই দেখিনি যে তারা তাদের মতাদর্শ বা জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য চাপাতি, রামদা, ছুরি, বন্দুক, গোলাগুলি বা এরকম অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার করতে চেয়েছেন। আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, কোনো যুক্তিবাদী বা বুদ্ধিমান মানুষ তার মতাদর্শ প্রচার ও প্রসারের জন্য কখনোই এরকম ভয়-ভীতি-সন্ত্রাস-নৃশংসতার পথ বেছে নেয় না। এরকমভাবে কোনো মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা বা অনুসরণ করানো যায় তারা তা ভাবতেও পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার নামে, ধর্মের নামে, এটা চলছে। কিন্তু কেমন করে কেউ এমন পরস্পরবিরোধী হতে পারে?

হ্যাঁ, হতে পারে, তখনই, যখন কোনো অপশক্তি পরোÿভাবে, নেপথ্যে থেকে, পর্দার আড়ালে থেকে কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কলকাঠি নাড়ে, যখন ‘মানুষের ভয় পাওয়া’ বা ‘মগজধোলাই’-এর ঘটনায় কারো কোনো হীন স্বার্থ লুকিয়ে থাকে, তখনই ঠিক এ ধরনের সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে।

Abhijit allগত সতেরো মাসে নিহত হওয়া মানুষের তালিকা সুদীর্ঘ। আমি জানি না তালিকাটি আর কত দীর্ঘ বা দ্রুত হলে বা সারাদেশে আরও কত ব্যাপকভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে আমরা বলতে পারবো, হ্যাঁ, এবার এটা বন্ধ করার সময় হয়েছে। হ্যাঁ, এটাই এখন এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন: আমরা কী এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যাপারে ন্যূনতম কোনো সন্তোষজনক অবস্থা বা অবস্থান কোথাও দেখতে পাচ্ছি? সরকার একের পর এক বিভ্রান্তিকর এবং কখনো কখনো স্ববিরোধী কথাবার্তা বলেই যাচ্ছে। সরকারের এসব অর্থহীন কথাবার্তায় কোনো কিছু বোঝা না গেলেও এটা পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, তারা এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মোটেও ভাবিত নয়। বরং কখনো কখনো তাদের বক্তব্যে খুনিরাই জোরালো সমর্থন পায়, দায়মুক্তি পায়।

সম্প্রতি সরকারের এরকম মনোভাব প্রকাশের ব্যাপারটিতে কোনো রাখঢাকও নেই। কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেই সরকারের পক্ষ থেকেই বলে দেয়া হচ্ছে যে, যারা আক্রমণের শিকার হয়েছে বা যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা ব্লগার! আর ব্লগার মানেই তো নাস্তিক! সুতরাং নাস্তিক মানেই তো হত্যা!

যেন এটা কোনো আইনসিদ্ধ সাংবিধানিক অধিকার!

আমি বলতে চাই, এই অতি সরলীকরণের সময় এখানেই শেষ হওয়া উচিত। এই ভয়াবহ বিভীষিকাময় প্রবণতা এখনই থামানো উচিত। অনেক হয়েছে, আর নয়। কেন মানুষ ভাববে যে একজন নাস্তিক মানেই বিপজ্জনক? তাদেরকে সহ্য করা যাবে না?

একজন ধার্মিক, তার ধর্ম যা-ই হোক না কেন, তা সে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, জৈন বা অন্য যে কোনো ধর্ম-এটা যেমন স্বাভাবিক এবং সহজে গ্রহণযোগ্য, একইভাবে যার কোনো ধর্ম নেই বা কোনো ধর্মের প্রতিই বিশ্বাস নেই-এটাও তো একই। এটা তো পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। এটা নিতান্তই যার যার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

Pohela 3আমি যে বাংলাদেশকে চিনতাম, এটা সেই বাংলাদেশ নয়। আমি সাধারণ কোনো খুন-জখম, ধর্ষণ বা বর্ষবরণ উৎসবে নারীদের ওপর যৌন সহিংসতার মতো ঘটনা বা রাষ্ট্রীয় বাহিনির হাতে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ডের কথা বলছি না। আমি ‘ধর্মের নামে’ যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, আপাতত সেসবের কথাই বলছি।

যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এসব ঘটনার সাথে বিস্ময়জনক সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন সাদৃশ্য রয়েছে খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ, তাদের গ্রেপ্তার করা বা বিচার করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গড়িমসি বা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়! আমাদের সরকার একটা বুলিই বার বার আওড়াচ্ছেন, কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটলেই বলছেন, ‘এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’  

সম্প্রতি এরকম এক ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনার’ পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলে দিয়েছেন, ‘এ পর্যন্ত যত খুন হয়েছে, সব খুনি ধরা পড়েছে!’ কিন্তু আমরা জানি ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকারীদের একজনকে ধরা হয়েছিল এবং তাঁকে আবার ছেড়েও দেয়া হয়েছে। আমরা সিসিটিভির ফুটেজেও পুলিশকে এরকম ধরতে দেখেছি এবং ছেড়ে দিতেও দেখেছি, কারণ পুলিশের অত শক্তি নেই!

কেননা হত্যাকারীরা পুলিশের চেয়েও বেশি শক্তিমান ও সশস্ত্র। অবশ্যই তারা তা-ই হবে। কারণ যারা দু’জন জ্যান্ত মানুষকে হত্যা করতে পারে, তারা দু’জনকে আহত করে প্রাণে বাঁচতে চেষ্টা করবে না? এবং তারা তা-ই করছে। অন্যদিকে, এই খুনোখুনির ক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কপাল অনেক ভালো!

ওনারা ‘এনকাউন্টার’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে একই কাহিনি বলে বলে প্রায় হেসে-খেলেই অনায়াসে মানুষ মারতে পারছেন। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে, ওদের চিত্রনাট্যের ভাষা নিয়ে। দুটোই হাস্যকর রকম দুর্বল। তাদের সত্যিই একজন ভালো ‘স্ক্রিপ্ট রাইটার’ প্রয়োজন।

Freedom of speechআমি আরও কিছু বিষয় উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, যাদেরকে খুন করা হয়েছে তাদের সবাই ব্লগার ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, ব্লগারমাত্রই নাস্তিক নয়। যেমন সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ব্যক্তি মানেই ব্লগার বা নাস্তিক নয়। তারা নাস্তিক হোক আর না হোক, এটা অপ্রাসঙ্গিক। তৃতীয়ত, (আমার এ বিষয়ে জানা নেই, তাই যারা জানেন তাদেরকে সবিনয়ে বলছি) আপনারা আমাকে দয়া করে জানাবেন যে, আমাদের সংবিধানের কোন ধারায় লেখা আছে যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে কেউ নাস্তিক হতে পারবে না? সব দেখে শুনে আমরা যে বার্তা পাচ্ছি, তাতে তো মনে হচ্ছে, নাস্তিককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করো, কেননা সে ধর্মের মূলভিত্তি ও বিশ্বাসীর বিশ্বাস নিয়েই প্রশ্ন তোলে। তাই হয়তো হত্যাকারীরা আইনকানুনের তোয়াক্কা করছে না। তাদের আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে না। কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে না! তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না।

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, বিশ্বাসী বা ধার্মিকদের যার যার ধর্মটাও একমাত্র বা অভিন্ন অদ্বিতীয় নয়। একটি ধর্মেরই আবার অনেকগুলো ভিন্নমতাবলম্বী শাখা-প্রশাখা আছে। এসব শাখা-প্রশাখার মধ্যেও অন্তর্কোন্দল চলতেই থাকে, সেটাও সহিংসতাশ্রয়ী। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। ইসলামের ক্ষেত্রেও একই দশা। ইসলামেরও যেসব ঘরানা মাজহাব বা শাখা-প্রশাখা আছে, তারাও সবাই সবাইকে ‘ধ্বংস’ করার মাধ্যমে ইসলামকে ‘রক্ষা’র চেষ্টা করছে! এই ইসলাম, এখন যেটা বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, সেটার শুরুটা কিন্তু তলোয়ার দিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে বা জোরাজুরি করে সহিংসতার মাধ্যমে হয়নি; হয়েছে সুফি-সংস্কৃতি প্রভাবিত হৃদয়বান ধর্মপ্রাণ আধ্যাত্মিক নেতাদের প্রেমময় প্রচারের মাধ্যমে।

এখন ইসলামের যে ‘অভিন্ন রূপ’ দেখা যাচ্ছে, বিশ্বাস বা চর্চায় কোনোভাবেই তা আমাদের দেশে ছিল না। যে ওয়াহাবি/সালাফিদের এখন লাফালাফি, তারা আমাদের দেশের যে সুন্নি ইসলাম, সেই ইসলামের ৪ মাজহাবের অংশ নয়; অথচ তাদেরকেই এখন নাট্যমঞ্চে বীরদর্পে পায়চারী করতে দেখা যাচ্ছে। শুধু আমাদের এখানেই নয়, এটাই এখন বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। তাই আমাদের সরকার বাংলাদেশে ‘আইএস’-এর অস্তিত্ব স্বীকার করুক আর না করুক, তাকে মুজাহিদিন, তালিবান, আল কায়েদা, হেফাজত-ই-ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি বা যে নামেই ডাকুক, তাতে কিছুই যায় আসে না। বিভিন্ন দেশে তারা যে প্রক্রিয়ায় শক্তি প্রদর্শন করে, যেভাবে নৃশংসতা সহিংসতার মাধ্যমে খুনোখুনির রাজত্ব কায়েম করে, এখানেও হুবহু একইরকমভাবে করছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ওদের মনগড়া দুনিয়ায় নারীদের জন্য ন্যূনতম কোনো জায়গা নেই, সেখানে সমানাধিকার দূরের কথা, নারীরা পুরোপুরি নাগরিক হিসেবেও বিবেচিত নন। সুতরাং আমরা তো আমাদেরকে জেনেশুনে পিছনের দিকে, গুহামানবের যুগে নিয়ে যেতে পারি না। আমাদের সুদীর্ঘ প্রাণান্ত লড়াই-এর যে ইতিহাস, যে অর্জন, তা তো আমরা বিসর্জন দিতে পারি না। কিছুতেই না।

আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, এই সময় পর্যন্ত, অনেকগুলো নিরীহ প্রাণ ঝরে গেছে। এরমধ্যে রয়েছে মুসলিম পীর-ফকির, শিয়া-আহমদিয়া, সুফি-সম্প্রদায়ের অনুসারী, খ্রিস্টান পাদ্রী, মুক্তমনা লেখক (যারা স্বঘোষিত নাস্তিক নয়, এবং যাদের অনেকে ধর্ম বিষয়ে কখনো লেখালেখিই করেনি), বিদেশি নাগরিক, যারা বাংলাদেশে কাজ করার জন্য এসেছিল। এমনকি যারা গান ভালোবাসে, যারা তরুণ, কমবয়সী-মধ্যবয়সী বা প্রবীণ, কেউই বাদ পড়েনি, তাদের সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আস্তিক-নাস্তিক সবাইকে এক কাতারে এনে স্রেফ এক অভিনব ইসলামের নামে কতল করা হয়েছে।

এসব নৃশংসতার পর পরই ধর্মানুভূতিওলাদের ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়। ওনারা তখন উল্টো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকেন।

Religion and Politicsওনারা বলেন, কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া উচিৎ নয়। এ ব্যাপারে সবারই সতর্ক থাকা উচিৎ। আমি বলতে চাই, আমরা কার অনুভূতির কথা বলছি? কোন বিশ্বাসীর? কোন ধার্মিকের? সেই সব নারীবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকদের যারা ধর্মের নামে রক্তারক্তি হিংস্রতার প্রচার-প্রসার করছে? সেই সব সংঘবদ্ধ শয়তানদের যারা ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় অর্থনৈতিকভাবে শক্তপোক্ত হয়ে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে? যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অশিক্ষা, মূর্খতাকে পুঁজি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে?

যারা ভুলব্যাখ্যা ভুল উদ্ধৃতি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে মানুষকে উসকানি দিয়ে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে? তারা কাদের আশ্রয়ে-প্রশয়ে এসব করে বেড়াচ্ছে? তারা কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? এখনই এসব প্রশ্ন তোলার সময়। এইসব রহস্যবাদী, নারীবিদ্বেষী আদর্শবাদীরা একেক সময় একেক ধর্মের নামে একেক দেশে একেকরকম নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে? কাদের প্রয়োজনে এই ভয়াবহ ধর্ম ব্যবসা? এই ব্যবসার সঙ্গে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচার বা যৌন ব্যবসার তো আমি কোনো পার্থক্য দেখি না।

ইসলাম, হ্যাঁ, আবারও বলছি, ইসলাম আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম। প্রায় ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষের ধর্ম হিসেবে শত শত বছর ধরে ইসলাম এখানে টিকে আছে। চাপাতির নৃশংসতার মতো কোনোরকম সহিংসতা ভয়ভীতি ছাড়াই এখানে ইসলাম আছে। তো এত বছর পর হুট করেই কেন এখানে এখন ‘ইসলাম রক্ষার’ জন্য ‘মানুষবলী’র মচ্ছব শুরু হয়ে গেল? আমাদের তো নতুন করে এই অচিন রাক্ষুসে ইসলামের দরকার নেই।

একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই, রাষ্ট্র এক জিনিস, ধর্ম আরেক জিনিস। এই দুই রকম দুই জিনিস যার যার অবস্থানে থাকবে, দূরে দূরে থাকবে, পৃথক থাকবে। দুটো যেহেতু দুই জিনিস, সেহেতু কখনোই এক হবে না, এক করা যাবে না। করতে গেলেই বিপত্তি বাঁধবে এবং রাষ্ট্র এক অনন্ত আত্মঘাতী সংঘর্ষের দিকে যাবে।

আমরা যারা, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণ বা চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম বলে দাবি করি, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান হারে ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯% অমুসলিম। কিন্তু, ১৯৫১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৩%। যেটা ১৯৭৪ সালে কমে এসে ১৪.৬% হয়েছিল।

যখন কোনো রাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের পথে চলতে চায়, তখন বহুমত বহুপথের বহুমুখি বৈচিত্র্যকে ধারণ করার প্রয়োজন পড়ে। বিধ্বংসী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধী ভূমিপুত্রদের ভূমি রক্ষার মিছিলে গুলি, তাজরীন গার্মেন্ট-রানা প্লাজার গণহত্যাসহ অন্যান্য শিল্পকারখানার  হত্যাযজ্ঞ, সংখ্যালঘু অমুসলিম ও আদিবাসীদের ওপর হামলা-এসব সব ঘটনার প্রবণতা শেষপর্যন্ত এক।

তা হচ্ছে আধিপত্যবাদী একমুখী সংকীর্ণ স্বৈরাচারী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা-কোথাও হয়তো এর নেপথ্যে উৎপাদন ব্যবস্থা বা বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, কোথাও বা আদর্শ বা সংস্কৃতির নামে স্রেফ মানুষের মন ‘জবর-দখলের’ চেষ্টা। কিন্তু বন্ধুগণ, এখনও কী এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় হয়নি? এখনই কী সবার মুখ খোলা উচিৎ নয়?

Khushi Kabir
খুশী কবির

আমি বলতে চাই, এখনই সময় শূন্যস্থান পূরণের, যোগসূত্র স্থাপনের, সেতু তৈরির। একজন নারী হিসেবে, একজন নারীবাদী হিসেবে, একজন যুক্তিবাদী হিসেবে, গণতন্ত্র, কথা বলা ও চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হিসেবে, বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্নদর্শী হিসেবে আমার বিশেষ চাওয়া হচ্ছে একটিই, আমি আমার চিন্তার স্বাধীনতা চাই। আমি নিরাপদে নিশ্চিন্তে সব সময় সবখানে চলাফেরার স্বাধীনতা চাই। আমি সোচ্চারকণ্ঠে বলতে চাই, আমার মনটা আমার নিজের, মনটাকে আমিই ধারণ করি। এই মন মুক্ত মন। সে যেখানে ইচ্ছে সেখানে চলে যেতে পারে, সে তার মতো স্বপ্ন দেখতে পারে, দেখাতে পারে এবং সে আমাকে আমার মতো করে প্রকাশ করতে পারে।

আমি কারও আদর্শ বা বিশ্বাসকে আঘাত করতে চাই না, যেমন চাই না অন্য কেউ আমাকে করুক। আমি আমার বিশ্বাসে অনড় অটল, কারণ, এটা আমার বিশ্বাস এবং আমি ওটা বুঝে-শুনেই ধারণ করি, পোষণ করি।

আমার বিশ্বাস, আমার আদর্শ কোনো রূপকথা-চুপকথা নয়, কেউ যদি সায় না দেয় তাতে আমার আদর্শের কিছুই যায় আসে না। তাতে আমার আদর্শ একটুও নড়ে-চড়ে ওঠে না, হুমকি বোধ করে না। কেননা, মহান ১৯৭১ আমাকে শিখিয়েছে, হত্যা করে কারও স্বাধীনতা আটকানো যায় না। এটা তখনো সম্ভব হয়নি, এবং এখনও সম্ভব হবে না।

 

শেয়ার করুন: