তরুণ মায়ের প্রতি খোলা চিঠি

শাশ্বতী বিপ্লব: প্রিয় তরুণ মা, মা দিবসের শুভেচ্ছা জানবেন। আমরা সমবয়সীই হবো, আমাদের সন্তানরাও প্রায় একইবয়সী। আমারই মতো আপনিও মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছেন এবং আজো মধ্যবিত্তের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

আপনার সাথে আমার মাঝে মধ্যেই দেখা হয়। ছেলের স্কুলে, স্যারের কোচিংএ, আলোহায়, ক্রিকেট স্কুলে বা অন্য কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে। আপনার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে, সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন, চোখের কোলে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

13115325_10207873053117082_679485265_nএই যান্ত্রিক শহুরে জীবনে ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা পরিবারের মা আপনি। একটি কি দুটি সন্তান আপনার, যাদের “মানুষ” করার প্রধান দায়িত্ব আপনার কাঁধে। একালের শহুরে শিশুদের শৈশব চুরি হয়ে যাওয়া নিয়ে আমাদের ক্ষোভ, হতাশার শেষ নেই। অভিযোগের শেষ নেই পড়ার চাপ, বইয়ের বোঝা আর সবকিছুতে পারদর্শী হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা নিয়ে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় রসদ যোগাতে গিয়ে জীবন চুরি হয়ে যাচ্ছে আপনারও, সে খবর কি রাখেন?

জীবন বড় স্বার্থপর, আপনি নিজে যদি সেই খবর না রাখেন, কেউ রাখবে না আপনার হয়ে।

সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে আপনি অতি উদ্বিগ্ন। স্কুলের পরীক্ষায় ১/২ নাম্বার কম বেশি পাওয়ার সাথে আপনার রক্তচাপ ওঠানামা করে। সংসার সামলে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়তে আপনি দিনমান ছুটে চলেছেন স্কুল, বাসা, কোচিং, গান শেখা, ক্রিকেট শেখা, ছবি আঁকা শেখার পেছনে। আপনি যদিও কর্মজীবী নন কিন্তু কর্মজীবী মায়ের চাইতেও ব্যস্ত। নিজের দিকে তাকানোর ফুসরত আপনার কদাচিৎ মেলে।

Shaswati 5আপনাকে সাহায্য করার জন্য কোন গৃহকর্মী নেই। আপনিই রাখতে চান না। গৃহকর্মী ম্যানেজ করার চাইতে নিজে করে ফেলাটা আপনার সহজ মনে হয়। আর তাছাড়া আপনাকে বাইরেই থাকতে হয় বেশিরভাগ সময়। তাই নানা বাস্তব কারণে গৃহকর্মী আপনার কাছে উটকো ঝামেলা মনে হয়।

আপনার দিনপঞ্জি অনেকটা রিলে রেসের মতো – একটার পরে একটা কাজ সারবেঁধে দাঁড়ানো যেনো।

ভোর পাঁচটারও আগে আপনার দিন শুরু হয়, রান্নাবান্না গুছিয়ে ছেলে আর ছেলের বাপকে খাইয়ে নিজে কোনরকমে দুটো খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় এসে সংসারের বকেয়া কাজ করে দুপুরের খাবার বক্সে ভরে আবার বের হন। বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে সোজা যান কোচিং এ। সেখান থেকে সপ্তাহে দুইদিন আসেন ক্রিকেট স্কুলে আর তিনদিন যান গানের স্কুলে। সেখান থেকে আবার আরেক কোচিংএ। মোটমাট বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজে।

এর মাঝেই খাওয়া দাওয়া, ড্রেস চেঞ্জ করা, সবই হয় -কখনো গাড়ীতে, কখনো মাঠের কোনায় বসে। এর মাঝে সপ্তাহে দুইদিন আবার হুজুর আসে। সন্তানকে চৌকস বানাতে যা কিছু করা প্রয়োজন করে যান বিনা বাক্যব্যয়ে। আপনারও প্রতিযোগিতা চলে, অন্য মায়েদের সাথে।

আপনার সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। আপনি মনে করেন আপনি তাদের পড়া বুঝবেন না। তাই আপনার কোচিং নির্ভরতা অসীম। আপনি বাংলা মিডিয়ামে পড়েছেন বলে আপনি সবসময় কুন্ঠিত থাকেন। ছেলে-মেয়ের সাথে, তাদের স্কুলের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না বলে আপনি হীনমন্যতায় ভুগেন।

আপনাকে নিয়ে সমালোচনা অনেক। সবাই ভাবে আপনি শুধু জি টিভির সিরিয়াল দেখেন আর রূপচর্চা, পরচর্চা করেন। কিন্তু আপনার দিন আসলেই কিভাবে কাটে তার সঠিক খবর কেউ রাখে না।

আপনার নিজের স্বপ্ন হারিয়ে গেছে সন্তান “মানুষ” করার যাঁতাকলে। আপনি ভুলে গেছেন আপনাকে নিয়েও আপনার বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল। আপনি হয়তো গান গাইতেন একসময় অথবা ভালো নাটক করতেন কিংবা নিছক বই পড়ার শখ ছিল। সেসব আপনি ভুলেছেন। “মা চাকরী করলে সন্তান মানুষ হবে না” – সবাই বুঝিয়েছে আপনাকে। আপনিও মেনে নিয়েছেন। তাই কোন কাজের সাথে জড়াননি নিজেকে। নিজের জন্য কিছুই করা হয় না আপনার অথবা নিজেকে মনেই থাকে না।

একটু দম নিন মা। বাচ্চাদেরও নিতে দিন। ওরা হঠাৎ বড় হয়ে যাবে, নিজের জগৎ তৈরি করে নেবে। আপনার সাথে লেপ্টে থাকার প্রয়োজন ফুরাবে। তখন নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হবে আপনার।

Mother 2আজ মা দিবস। সবাই মায়েদের ভালোবাসা জানাবে আজকে। যে মায়েরা তাঁদের জীবন খরচ করে ফেলেছেন তাদের জন্য। আফসোস করবে মায়ের কত শখ পূরণ হলো না বলে। কিন্তু বর্তমানের তরুণ মা, যাদের জীবন এখনো ফুরিয়ে যায়নি, যারা চাইলে এখনো শুরু করতে পারে অনেককিছু – তাদের কথা ভাবা হবে না। তাদের জীবনটাও একইরকম খরচের খাতায় তুলে দেবে নিশ্চিন্তে সবাই মিলে। ভবিষ্যতে এই মায়ের সন্তানেরাও কোন এক মা দিবসে মাকে নিয়ে চমৎকার কোন স্ট্যাসাস দেয়ার যোগ্য হয়ে উঠবে – এই অপেক্ষায়। কিন্তু আপনার জীবনের সোনালী সময় আর ফিরবে না।

নিজেকে সময় দিন তরুণ মা। সন্তানের জন্য কষ্ট করবেন ঠিক আছে, কিন্তু পাশাপাশি নিজের কথাও ভাবুন, প্লীজ। এখনও বেশি দেরী হয়ে যায়নি, বিশ্বাস করুন।

ইতি

আরেকজন তরুণ মা

 

শেয়ার করুন: