ইমতিয়াজ মাহমুদ: বাঙালি মায়েরা এত সুন্দর হয় কেন দেখতে? কখনো ভেবেছেন? আজকে নাকি মা দিবস। ইংরেজিতে মাদার্স ডে। সাহেবদের চোখে মাতৃরূপ কিরকম জানি না। সাহেবরা মায়ের জন্যে একটা দিন পালন করার জন্যে ঠিক করেছে, ভাল করেছে কি মন্দ করেছে সে নিয়েও কথা হচ্ছে।
যারা বলছেন, মায়ের জন্যে তো সন্তানের প্রতিদিন সারা জীবনই ভালবাসাময়, একটা দিন আবার আলাদা করার কি দরকার, ওদের কথাও ফেলে দেওয়ার মত না। কিন্তু এই যে ছেলে বুড়ো সকলেই ফেসবুকে মাদার্স ডে উপলক্ষে মায়ের ছবি দিচ্ছে, মায়ের সাথে নিজেদের ছোটবেলার ছবি, এটাও তো বেশ ভালোই লাগছে। আবেগকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
এইসব ছবি দেখতে দেখতেই ভাবছিলাম, বাঙালি মায়েরা দেখতে এতো ভাল হয় কেন? সন্তান কোলে নিয়ে বা সন্তানের হাত ধরে বা সন্তানের গায়ে গা লাগিয়ে তোলা আটপৌরে সাদামাটা ধরনের ম্যাটমেটে চেহারার সাধারণ নারীদের দেখতে কিরকম যে ভাল লাগছে, দেখেছেন?
কোর্ট থেকে ফেরার পথে বসে বসে মোবাইল ফোনে এইসব ছবি দেখতে দেখতে আমার চোখ ভিজে আসে। আহা, বাঙালি মা, আমাদের চিরকেলে দু:খিনী মা। ঈশ্বর কিরকম দেখতে সে তো জানি না, কিন্তু এইসব দু:খিনী নারীদের ছবি দেখলে মনে নয় ঈশ্বর বলে কেউ যদি থাকেন, তিনিও নারীই হবেন, কিন্তু তাঁর চেহারাও আমার মায়ের চেয়ে মহিমাময় হবে না।
(২)
আর দেখেন, আজকে কিনা আবার আমাদের রবীন্দ্রনাথেরও জন্মদিন। আহ, এই লোকটা না থাকলে আমাদের কী হতো বলেন দেখি? আমাদের সকল দুঃখ সকল অহংকার আর সকল আচারে আমরা তো এই বুড়ার কাছেই দ্বারস্থ হই আর ওর চোখ দিয়ে নিজেদের দেখি। আমাদের মায়ের রূপও তো তিনিই সবচেয়ে স্পষ্ট করে আঁকেননি? রবীন্দ্রনাথেরই লাইন কয়টা তুলে দিই-
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,
তোমার আঁচল ঝুলে আকাশতলে রৌদ্রবসনী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
যখন অনাদরে চাই নি মুখে ভেবেছিলেম দুঃখিনী মা
আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে, দুখের বুঝি নাইকো সীমা।
কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি–
আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ওই চরণের দীপ্তিরাশি!
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
(৩)
এটা তো স্বদেশ পর্বের গান, রবীন্দ্রনাথ তো দেশকে ভেবে লিখেছিলেন। ঠিক কথা। কিন্তু বাঙালির কাছে মা আর দেশ তো একই। একই না? সাহেবরা তো অনেকে দেশকে বলে পিতৃভূমি, আর আমরা দেশকে বলি মাতৃভূমি আর ভিটাকে বলি পিতৃভূমি। আমাদের কাছে দেশ আর মা তো একই। আর এই যে গানটা, মাতৃভূমি বাংলাকে দুর্গা ঠাকুরের মত দেখা, এটাই তো আমার কাছে লাগে যেন প্রকৃত মাতৃরূপ বর্ণনা।
আগে এরকম মনে হতো না। রূপবতী তো মাকে সবসময়ই মনে হতো, যৌবনে আমার মা রূপবতীই ছিলেন বটে। কিন্তু আমাদের কৈশোরে মাকে সেরকম মহিমাময়ী মনে হতো না। এখন স্বীকার করতে লজ্জা নাই, অনেক সময় মনে হতো ‘মামনি এইসব কি যে করে?’ আর মনে মনে বিব্রত হতাম মাকে নিয়ে। মামনি তো আমাদের বন্ধুদের সবাইকে তুই তুই করে বলতেন। কথায় কথায় এটা সেটা নিয়ে ধমক দিয়ে বসতেন। কী যে বিব্রত হতাম।
(৪)
১৯৮৯ এর ডিসেম্বরে ধুম করে একদিন আমার পিতা বিনা নোটিশে মরে গেলেন। আমরা ছয় ভাইবোন। সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন আমার পিতা, তাঁর তো সেরকম কোন সঞ্চয়ও ছিল না। কিছু টাকা আমরা নানাভাবে এমনিও নষ্ট করেছিলাম। নিদারুণ অর্থকষ্টে পরে গেলাম পুরা পরিবার। এমনও দিন গেছে যে অর্থাভাবে দিনের খাবারও জোটে না প্রায় সেরকম অবস্থা।
ঐ যে রবীন্দ্রনাথ দুর্গা ঠাকুরের রূপে দেশের রূপ এঁকেছেন না? বাংলাদেশের রূপ আর দুর্গা ঠাকুরের রূপ তিনি মিলিয়ে একাকার করে দিয়েছেন। আমি আমাদের জীবনে সেইসব কঠিন দিনের কথা যখন ভাবি, আমার মনে হয় ঐ দুর্গাঠাকুরের রূপ আর আমার মায়ের রূপে কোন পার্থক্য নাই। দুর্গা ঠাকুরের তো দশ হাত, সন্তানের জন্যে মায়ের যে কয়টা হাত মা নিজেও সেটা জানেন না।
পিতামাতাকে ‘লাভ ইউ’ বলে এফেকশন দেখানো জিনিসটা আমাদের সংস্কৃতিতে নাই। বাঙালি মায়ের প্রতি এফেকশন দেখায় কবিতা লিখে। আমি কোনদিন মাকে নিয়ে কবিতা লিখি নাই। আহা, যদি লিখতে পারতাম!
(৫)
আমরা মুখে কোনদিন মাকে ভালোবাসার কথা বলি না। সাহেবরা বলে। সাহেবদের কাছ থেকে আমাদের ছেলেমেয়রাও অনেকে শিখেছে, এখন ওরাও বলে। গতকাল বিকেল থেকে আমার মেয়েরা ওদের মায়ের জন্যে মাদার্স ডে করবে বলে পাঁয়তারা করছে। গোপনে আমাকে এটা সেটা নিয়ে যেতে বলছে। মাকে সারপ্রাইজ দেবে। আমার বড় মেয়ে মায়ের সাথে নিজের ফটো পোস্ট করেছে ফেসবুকে।
আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকেও সেইভাবে কখনো দুইটা মিষ্টি কথা বলা হয়না। মায়ের মহিমার একটা দিক দেখার জন্যে তো আমার তাঁকেও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়।
আমার সন্তানদের জন্ম হয়েছে বিলেতে। সেখানে সন্তান জন্মের সময় হাসপাতালের থিয়েটারে স্ত্রীর সাথে স্বামীদেরকে থাকতে দেয়। আমার বড় মেয়ের জন্মের দিন অপারেশ থিয়েটারে আমি আমার স্ত্রীর হাত ধরে ছিলাম। আমাদের এখানে এই ডাক্তাররা এটা করেন না। করা উচিৎ। সন্তান যখন আক্ষরিক অর্থেই মায়ের শরীর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে পৃথিবীর আলোয়, সেই দৃশ্য সকলেরই দেখা দরকার।
আর মাগুলো কীরকম বোকা দেখেন, এইরকম কষ্টের পরেও বারবার সন্তান জন্ম দিয়ে যায়।