সমতা ও গণতন্ত্রই নারীবাদী আন্দোলনের মূলমন্ত্র

 উইমেন চ্যাপ্টার: কেবলমাত্র ভারতেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই আজ কমলা ভাসিন একটি নামই শুধু নয়, নারী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। সেই তিনি বাংলাদেশে আসার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এখন ঢাকায়। শুক্রবার ছায়ানট প্রাঙ্গণে তাঁর এই আসা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল এক মিলনমেলার। কমলা রংয়ের পোশাক পরে আর কণ্ঠে ‘এই আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গান গেয়ে সবাই তাঁকে বরণ তো নয়, যেন জয় করে নিলেন। জেগে উঠলো শত শত প্রাণ। সেই ভালবাসার প্রতিদান দিতে ৭০ বছর বর্ষীয় এই নেত্রী তাঁর স্বভাবসুলভ নাচের ভঙ্গিতে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন।

Kamla 1নারীবাদ নিয়ে যারাই কাজ করেন এই দেশে, তারা একনামেই চেনেন তাঁকে, ভালবাসেন প্রাণখুলে। কমলা ভাসিন কাকে বেশি ভালবাসেন এ নিয়েও সবার মাঝে একটা প্রতিযোগিতা কাজ করে, এমন কথাই বললেন নারীনেত্রী খুশি কবীর, সুলতানা কামাল এবং ফওজিয়া খোন্দকার ইভা, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন।

তাঁরা তাদের বক্তব্যে বলেন, অসম্ভব প্রাঞ্জল ভাষায় প্রশিক্ষণকে কী করে আয়ত্ত করতে হয় এবং তা ছড়িয়ে দিতে হয় প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে তা কমলা ভাসিনের প্রশিক্ষণ যারাই পেয়েছেন তারা জানেন। প্রশিক্ষণ শেষে মনে হবে, সবাই তাঁর আপন জন। তিনি একজন দক্ষ যোগাযোগ কর্মীও।

ফুল এবং নানান উপহারে তাঁকে বরণ করে নেয়ার পর বক্তৃতা শোনার পালা। বললেন, নারীবাদী আন্দোলনের কথা, তার চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার কথা, আশা-হতাশা-ক্ষোভের কথা। ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কও বাদ যায়নি তাঁর বক্তব্যে। তিনি বলেন, নারীবাদী আন্দোলনের মূলনীতি হচ্ছে সমতা এবং গণতন্ত্র, যা প্রথমে অনুশীলিত হতে হবে পরিবারের মধ্যে এবং পরবর্তীতে সংগঠনে।

Kamla 3তিনি জানান, গত ৪০ বছর ধরে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী কর্মীদের মধ্যে মেলবন্ধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকটা সফলকাম হয়েছেন বলেও দাবি করেন। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি বিদ্যমান আছে, তাও কমিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে।

বর্তমানে ভারতের নয়াদিল্লিতে বসবাসকারী কমলা ভাসিনের এই দেশে আসা শুরু হয়েছিল জাতিসংঘের কর্মী হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি জেন্ডারভিত্তিক সমতা নিয়ে কাজ করেন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সাথে।

কমলা বলেন, অনেক নারীবাদীই বলে থাকেন যে, নারীর কোনো দেশ নেই, কিন্তু আমি বলি, একজন নারী হিসেবে পুরো পৃথিবীই আমার দেশ।

বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে কিনা মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করে সফল হয়েছে, মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্বের বুকে, একাত্তরে মহাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।

তাঁর নিজের কাজের ভিত্তি হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক ঐক্যমত, বন্ধুত্ব এবং সমগ্র বিশ্বের প্রতি ভালবাসার কথা উল্লেখ করেন। তিনি একাধারে আন্দোলনকর্মী, গীতিকার, কবি, সমাজ বিজ্ঞানী। তবে তাঁর ভাষায়, আন্দোলনের স্বার্থেই তিনি গীতিকার হয়েছেন, গান লিখেছেন, স্লোগান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘আজাদী’ স্লোগানই সম্প্রতি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের সময় উচ্চারিত হতে শোনা গেছে। 

বক্তৃতা পর্ব শেষে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হয় কমলা ভাসিনের উদ্দেশ্যে। গান, কবিতা, অপহৃতা আদিবাসী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে নিয়ে মনোলোগ এবং ঢোলের তালে তালে সবাই নেচে-গেয়ে অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত করে তুলেন।

বাংলাদেশ সফরের দ্বিতীয় দিনে ছিল গুলশান ১ এ বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড অফিসে গ্লোবাল প্লাটফর্ম বাংলাদেশের উদ্যোগে তরুণদের সাথে মতবিনিময় সভা। যেখানে তিনি তরুণদের ভূমিকা ও কাজ নিয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তরুণের বাস এখন দক্ষিণ এশিয়ায়। ত্রিশের নিচে বয়সীদের সংখ্যা এখানে বৃহত্তম। কাজেই দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতই শুধু তরুণদের ওপর নির্ভর করছে না, বর্তমানও নির্ভর করছে। প্রায় তিন ঘন্টাব্যাপী এই মতবিনিময় আয়োজনে তাঁর বক্তব্যের পাশাপাশি তরুণদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমলা ভাসিন।

তিনি নীতিমালা পরিবর্তনের আগে নিজেদের পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব দেন। এবং সবাইকে যে যার জায়গা থেকে কাজ করার তাগিদ দেন।

 

শেয়ার করুন: