প্রয়োজন এখন এই দানবকে রুখে দেয়া

বাকী বিল্লাহ: ইস্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ানো চলছে- গত কয়েক বছর ধরে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত বছরের শেষভাগ থেকে এখন পর্যন্ত একটানা নির্যাতন-নৃশংসতা-অনাচারের যে সুনামি শুরু হয়েছে তা অস্বাভাবিক।

অসংখ্য ঘটনা, কোনোটিই অন্যটির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ পরিস্থিতিতে ইস্যুর চেয়ে যে সামগ্রিক অন্ধকারের পথে যাত্রা শুরু করছে দেশ ও রাষ্ট্র; তার স্বরূপ সন্ধান ও প্রতিবিধান বেশি জরুরি।

Tulshi Rani
তুলসী রানী

গত বছরের অক্টোবরের ৩০ তারিখ আমরা জানতে পারলাম, ফেনীর জেলেপল্লীতে এক সন্তান সম্ভবা হিন্দু নারীকে পেটে লাথি মেরে গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে। লাথির আঘাতে অকালে প্রসব হওয়া শিশুটির ছবি আমাদের চৈতন্যে নাড়া দিল।

জানা গেল, স্থানীয় এক প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা সে ঘটনার জন্য দায়ী। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের নানারকম ক্ষোভের বহি:প্রকাশ দেখা গেল। ৩১ অক্টোবর শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করা হলো।

৩১ তারিখ ওই কর্মসূচির ব্যানারের ডিজাইনটি করে যখন অনলাইনে আমরা কয়েকজন সেটা নিয়ে আলাপ করছি, ঠিক তখনই সিলেট থেকে আসা একটি ফোনে জানতে পারলাম, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের অফিসে আক্রমণ হয়েছে। বাসা থেকে বের হয়ে ছুটলাম লালমাটিয়ার দিকে। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল। বিকেলে আজিজ মার্কেটে খুন হলেন জাগৃতির প্রকাশক দীপন।

পরবর্তী কয়েকদিন আমাদের মনে করে দেখারও সুযোগ হয়নি যে, ফেনীর জেলেপল্লীর ওই হিন্দু নারীটি কেমন আছেন? খবর রাখা হয়নি যে দোষী যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কী না?

যেখানে দিনরাত চেঁচিয়েও আমরা সরকারী দলের চোর-বাটপার নির্যাতকদের বিচারের আওতায় আনতে পারি না সেখানে আপডেট না রাখতে পারলে তো কথাই নেই। পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। এরপর থেকে আজ অবধি ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই অগ্রসর হচ্ছে।

সর্বশেষ কয়েকদিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা লোপাট, জোহাকে তুলে নেয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল সমালোচনার নতুন গল্প প্রসবের মধ্য দিয়ে জোহাকে ফিরিয়ে দেয়া, এর পরপরই তনুর ধর্ষণ ও খুন এবং গতকাল বাঁশখালীতে পুলিশ ও মাস্তানদের গুলিতে ছয়জন গ্রামবাসী খুন। একই সময়ের মধ্যে আরো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে।

বগুড়ায় পূজা মণ্ডপে ভাগ্নীকে লাঞ্ছনা করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মাস্তানদের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন মামা। তার নাম সনাতন। সিলেটে ভাগ্নিকে টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন সনাতন ধর্মের এক মামা। তারা এখনও হুমকির মুখে, মেয়েটির স্কুলে যাওয়া বন্ধ, পাবনার এডুয়ার্ড কলেজের এক হিন্দু ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ, মেয়েটির পরিবার হুমকির মুখে, ফেনি ক্যাডেট কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তুবার লাশ উদ্ধার, আত্মহত্যা বলা হলেও তার শরীরে ছিল অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন, ইরফান নামে দৃক গ্যালারির এক কর্মকর্তা ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন, পরে তার লাশ মিলেছে নারায়ণগঞ্জে। কিছু কিছু ঘটনা তুলনামূলক কম আলোচিত। কিছু করারও নেই। একসাথে এতো ঘটনা বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় আনা সম্ভব না।

আমরা কী করবো? ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে শাহবাগের আশেপাশের কোনো এক দোকানে চা খেতে দাঁড়িয়ে আমার জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটির কথা মনে পড়ছিল। ৬, ৭, ৮ ফেব্রুয়ারি- শাহবাগের উন্মাতাল জনতা আমাকে সময়ের প্রয়োজনে গল্পটির পূর্ণাঙ্গ পাঠ দিয়েছিল।

সময়ের কী প্রয়োজন এখন? স্বাধীনতার চেতনা রক্ষার নামে ৫৭ ধারা করে আমাদের কন্ঠরোধ করা হলো। আমার স্বাধীনতা গ্রাস করে যে চেতনা দাঁড়ায় তাকে কী নামে ডাকবো? আমার প্রাণ-প্রকৃতি-জীবন কেড়ে নিয়ে যে উন্নয়ন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকেই বা কী নামে ডাকবো?

আমার সঞ্চয় লুট হচ্ছে, লুট হচ্ছে ভবিষ্যত। আমার শ্রম ঘামের পয়সায় কেনা বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয়া হচ্ছে আমাকেই। এক ভয়ংকর দানব সৃষ্টি হচ্ছে। চেতনাধারী এই দানব চেতনাহীন দানবের চেয়ে বেশি ভয়ংকর। কারণ ভয়াল অন্ধকারেও আমাকে যাদুর কাঠি দিয়ে ঘুম পাড়ানোর মন্ত্র রয়েছে এই দানবের কাছে।

সময়ের অনিবার্য প্রয়োজন এখন এই দানবকে রুখে দেয়া।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও অ্যাক্টিভিস্ট

 

শেয়ার করুন: