তবে কি জন্মই ছিল আমার আজন্ম পাপ?

তামান্না ইসলাম: অনেকদিন ধরে একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘোরাঘুরি করে, সেটা হলো এই যে আমরা সবসময় নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলি, আসলে কি নারী-পুরুষ সমান? উত্তর হলো, না, সমান না। তবে কি একজন আরেকজনের চেয়ে উত্তম? এই উত্তরটা একটু জটিল।

Nariআমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যে, যদিও নারী পুরুষ এক না, কিন্তু তারা কেউ কারো চেয়ে উত্তম বা অধম না, এক জন একেক দিকে ভালো। কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। নারীর সাথে পুরুষের কিছু মুল পার্থক্য আছে, যেই পার্থক্যগুলো একজনকে করে তুলেছে অত্যাচারী, আরেকজনকে করে তুলেছে অত্যাচারিত।

আমার কাছে প্রধান তিনটি পার্থক্য মনে হয়-

১. গড়ে শারীরিকভাবে পুরুষ নারীর তুলনায় সবল।   

২. শুধুমাত্র নারী গর্ভ ধারণ করে।

৩. শারীরিক চাহিদার তীব্রতা সম্ভবত গড়ে পুরুষের বেশী।

আজ যদি পুরুষ আর নারীর বাহুবল হতো সমান, তাহলে অনেক কম পুরুষই সাহস করতো ধর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তে, এমনকি রাস্তা ঘাটে হয়রানি করতে। শুধু ঘরের বাইরেই না, নিজের ঘরে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিদিন অসংখ্য নারী ধর্ষিত হয়, বিবাহিত নারী ধর্ষিত হয় নিজের স্বামীর কাছেও শুধুমাত্র এই বাহুবলের ভয়েই।

গর্ভধারণের দায়িত্ব পরোক্ষভাবে অনাগত সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব চলে আসে নারীর ঘাড়ে। পিতৃ পরিচয় না থাকলেও, একজন মানুষের মাতৃ পরিচয় থাকবেই। প্রকৃতি যদি গর্ভধারণের এই গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দিত ছেলেদের উপর, তাহলেও দেখা যেত শুধু ক্ষণিকের শারীরিক আনন্দ উপভোগ করার এই পাশবিক পথ বেছে নিতে ছেলেরা দুইবার চিন্তা করতো।

তৃতীয় কারণটার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমার হাতে নেই, জানি না এটা মাপার কোন মাপকাঠি আছে কিনা। তবে বাহুবল কম হলেও, পাঁচটা মেয়ে একসাথে হলে একটা ছেলের চেয়ে তো শক্তি কম হওয়ার কথা না। তারপরেও পাঁচটি মেয়ে মিলে শারীরিক ক্ষুধা মিটাতে কোন ছেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বলে সাধারণত শোনা যায় না।

অন্যভাবে বলা যায়, মেয়েরা এই চাহিদাটাকে প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কে জানে হয়তো শারীরিকভাবে দুর্বল বলেই প্রকৃতি তাকে এই কৌশল শিখিয়ে দিয়েছে।

তবে কি জন্মগত কারণে যে শারীরিক পার্থক্য প্রকৃতি করে দিয়েছে, তার বোঝা আমরা টেনে যাবো সারা জীবন? আসলে কি মানুষ আর পশুর খুব বেশী পার্থক্য আছে? মানুষ তো আসলে এক ধরনের বুদ্ধিমান পশুই। বুদ্ধির আড়ালে মানুষ নামের পশু ঢেকে রাখে তার পাশবিক চাহিদা, চরিত্র। পশুদের জগতের নিয়ম সহজ-সরল। মেয়ে পশু জানে নিজেকে কখন সঁপে দিতে হবে, এ নিয়ে কোনো দরদাম চলবে না। আমাদের নিয়ম বড্ড ঘোলাটে।

আমরা মুখে বলি, মেয়েরা মায়ের জাত, নারী আর পুরুষের কোন ভেদাভেদ নাই। মেয়ে রাষ্ট্র প্রধান, বিজ্ঞানী, সবই মেনে নেই।  বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে মেয়েদের অবস্থা শুনলে ভয়ে শিউড়ে উঠি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে পথে, ঘাটে, বাসে, ট্রেনে সর্বত্র খোলাখুলি হচ্ছে সব কিছু, পুরুষ পশুর লালসা চরিতার্থ করার ক্রিয়া-প্রক্রিয়া। সেই বাতাস এসে ঢেউ তুলেছে বাংলাদেশেও।

পর পর অনেক গুলো ঘটনা শুনেছি মেয়েদের নিজ মুখে, ঘটেছে বাংলাদেশের চলন্ত বাসে, জনবহুল রাস্তায়, যেটা সরাসরি ধর্ষণ না হলেও তার চেয়ে কম কিছু নয়। আর পশ্চিমের কথা তো বলাই বাহুল্য। মেয়েদেরকে শিশু অবস্থা থেকে, নিজ নিজ পরিবার থেকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তুমি পণ্য, তুমি ভোগ্য, ভোগের বাজারে যেভাবে পারো নিজের দাম বাড়াও, শরীরটাই তোমার একমাত্র সম্বল।

সম অধিকার দিতে হলে প্রথমেই দিতে হবে নিরাপত্তার অধিকার। সেই অধিকারের জন্য আমাদের হাত পাততে হবে সবল পুরুষের কাছে? বুদ্ধির মুখোশে ঢেকে রাখা পশুর কাছে সেই মানবিকতা আমি আশা করি না।

তাহলে কে দেবে আমাদের নিরাপত্তা? কেন এখনো অন্ধকার পার্কিং লটে বা একলা ঘরে একটা ছেলের সাথে অস্বস্তি বোধ হয়, মনের কোনায় কোথায় যেন থাকে এক চাপা আশঙ্কা? আমার এই আশঙ্কা কি নিতান্ত অমূলক, দুর্বল মনের চিন্তা? নাকি প্রকৃতির শিখানো এক সাবধান বাণী? অথবা যুগ যুগ ধরে ঘটে যাওয়া তথাকথিত মানব সভ্যতায় নারী নির্যাতনের ইতিহাসের পরোক্ষ প্রভাব?

তবে কি জন্মই ছিল আমার আজন্ম পাপ?

 

শেয়ার করুন: