ভণ্ডামি ছাড়েন……. সুশীল ভাবটা ছাড়েন!

কাকলী তালুকদার: স্টাইল কইরা কইবেন, ক্ষমা করিস মা-বোন, অমুক-তমুক, তা হবে না। তনুর জন্য হাজার জন, ছবি রানী আর সবিতা চাকমার জন্য একদিনও দাঁড়াবেন না! তা কী করে হয়!
ধর্ষক ভাগ হয়ে যায় কেমনে ধর্ম আর বর্ণে? ভণ্ডামি ছাড়েন, দাঁড়াইলে সবার জন্য দাঁড়ান, দেশটারে আর অপমান করবেন না প্লিজ….
আপনার চুপ থাকার ফলাফল আজকের এই প্রতিদিনের ধর্ষণ উৎসব।

kakoliচৈত্র সংক্রান্তি, সাঁওতাল, চাকমাদের নিয়ে নাটক লিখবেন, নাটক মঞ্চস্থ করবেন মঞ্চে, বছরে একদিন আদিবাসী দিবস পালন করবেন আদিবাসীদের সাজিয়ে-গুজিয়ে প্রদর্শনীর মাধ্যমে, আর তারা নিগৃহীত হলে, উচ্ছেদ হলে, ধর্ষণ হলে ভাল পোশাক পড়ে সুশীল সেজে ঘুরে বেড়াবেন, তবে তো হবে না।

গরীব-ধনীর প্রেম, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-ক্রিস্টান নায়ক-নায়িকা বানাইয়া সামাজিক ছিনেমা বানাইয়া বাহবা কামাইবেন, তারা যখন সত্যিকারের বিপদে থাকবে তখন আপনি সেই সিনেমা উপভোগ করবেন বেড রুমে বইসা, তাইলে তো হইল না!
আপনার মুখখানও খুলতে হবে!
ভণ্ডামি করবেন না, মুখ খোলেন সবার জন্য, নিজের জন্য, দেশটার জন্য!

আপনি আমারে হিন্দু বলে বকা দিলেই আমি ভারতে দৌড় দেয়ার মানুষ না! এই দেশটা আমার, আমাদের ৭১ এর যুদ্ধে আমার বংশধররাও যুদ্ধে গেছে, দেশ স্বাধীন করছে। সেই যুদ্ধে আমরাও আমাদের আপনজনদের হারাইছি, তাদের রক্তের বিনিময়ে আজকের এই দেশ। তাই আজ এই দেশের খারাপ ভাল দুটোর অংশীদারই আমি-আমরা।

যাদেরকে আজ বীরাঙ্গনা বলেন আপনারা, তারা বাঙালী, উপজাতি, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, ক্রিস্টান হয়ে যুদ্ধ করে নাই।
হ্যাঁ, আমি এটাকে যুদ্ধ বলি, যোনির যুদ্ধ করছে, দেহের যুদ্ধ করছে সেই নারী গণ। আমাদের দেশটির মতো তাদের দেহটাও ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়েছিল! যার কারণে তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি জুটছিল। কিন্তু দেশ কি তাদের মনে রাখছে? মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ কইরা হয় মারা গেছে, নয়তো ফিরে এসে কেউ শান-সৌকতে দিন কাটাইছে, কেউ বা ভিক্ষা করছে। কিন্তু এই নারীরা? তাদের অনেকেই একাত্তরে মারা গেছিল, যারা বেঁচেছিল, তারাও সারা জীবনের মতোন মরেই ছিল। এটাকে বাঁচা বলে না।
আমরা ফ্যাশন করে বলি, মা-বোনেরা ‘ইজ্জত’ হারাইছে যুদ্ধে! এই ইজ্জতটা আবার কী? এটাকে যোনির মধ্যে থাকে?

তবে হ্যাঁ, ইজ্জত শব্দটা যতোদিন সার্বজনিন না হবে ততদিন মেয়েদেরই শুধু ইজ্জত যাবে। ছেলেদের ইজ্জত যাওয়ার ভয় নেই!
সেই নারী গণ, তারাও মুক্তিযোদ্ধা, তারা তাদের শরীরে শেষবিন্দুর বিনিময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন করছিল! স্বাধীন দেশে এখনো নারী তার দেহের স্বাধীনতা পায়নি! লুটে নিচ্ছে পুরান কায়দায়, হত্যা করছে নির্বিচারে, নারীর দেহের যুদ্ধ যেন শেষ হয় না আর!

আমি মুখ বন্ধ রাখতে চাই, সেদিনের জন্য অপেক্ষা করছি আর এইসব নিয়ে কথা বলতে হবে না আর!  বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে যায়, যাবেই তো, সবার মুখের কথা মাত্র কয়জন বলে, তাদের মুখে ফেনা উঠবে না তো কার মুখে উঠবে?
ভাল কিছু নিজে খাইয়া অন্যের জন্য খারাপটা দেয়ার অভ্যাস ছাড়েন, নিজেও একটু খারাপ খাওয়ার অভ্যেস করেন, তাইলে অন্তত সবার ভাগে কিছু ভাল খাবার পড়বে।

ভণ্ডামি কম করেন, ভাল মানুষ কখনোই অন্যায় সহ্য করে না, প্রতিবাদ করে। বিনা বিচারে কেউ মরবে না দেশে, একটি প্রাণীও না, সে যে দলের হউক, যে ধর্মের হউক, যে বর্ণের হউক সেটার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
রাষ্ট্র ন্যাংটা হইলে তারে কাপড় পরাইয়া দেয়ার দায়িত্বটাও আমাদেরই নিতে হবে, যেমন করে আপনার সন্তান বা ছোট ভাইবোনকে হাফ প্যান্ট-প্যান্টি পরান, জামা পরান।

তনুর পরিবারকে প্রশাসন ২০ হাজার টাকা দিচ্ছে, একখণ্ড  খাস জমিও দিবে বলে আশ্বাস দিয়েছে!
কেন? রাষ্ট্রের অপরাধ ঢাকতে ঘুষ? তাই খাস জমি?
তো চলেন, আমরা গরীব ঘরের মেয়েরা রাষ্ট্রের সৈনিকদের দ্বারা ধর্ষণের পর মৃত্যুকে বরণ করি, আর রাষ্ট্র সেই পরিবারকে ঘুষ দিয়ে ধনী বানিয়ে দিবে, খারাপ না!
ভণ্ডামি ছাড়েন, নারীবাদ- পুরুষবাদ কিচ্ছু লাগে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে!
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কমিউনিস্ট, জামাত, জাতীয় পার্টি চিন্তা করার দরকার নাই, মুখ খোলেন সবার জন্য, মানুষের জন্য।
আপনার পরিবার, আপনার প্রতিবেশী তারাই অন্যায়গুলো করছে! অন্যায় হচ্ছে আগুন, ধামা চাপায় দ্বিগুন শক্তি নিয়ে জ্বলে উঠে সমাজে, দেশে, পৃথিবীতে! নিজেকে দিয়েই শুরু করতে হবে চর্চ্চাটা।

মানব জীবনের মূল্যটা রাখেন, নিজের বিবেক দিয়া। নয়তো বনের পশু আর আমাদের কোন তফাৎ থাকলো না! আপনিই এগিয়ে নিচ্ছেন সমাজের সকল অন্যায়!
আপনার ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় চুপ থাকছেন তো?
অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে দুজনই সমান অপরাধী…. দেখুন তো মনে পড়ে কিনা কথা গুলো, কোথায় যেন পড়েছিলেন!

শেয়ার করুন:

অনেক অনেক ধন্যবাদ এই রকম একটি সচেতন মূলক লেখার জন্য,। আমরা এই মারামারি, হানাহানি, রাস্তাঘাটে মানুষ মরার বাংলাদেশ দেখতে চাই না। আমরা এমন একটা সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ চাই, যেখানে মারামারি, হানাহানি থাকবে না, যে যার মত স্বাধীন অধিকার নিয়ে বেচে থাকতে পারে।

সবাই কিছু করতে চাচ্ছি একই ইস্যুতে। প্রত্যাশা অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।কিন্তু সদা সংশয় একটাই সুবিচার হবে তো? আসলে সুবিচারের সূচক নিয়ে সন্দিহান আমরা সবাই। এরকম অনেক ঘটনার প্রাপ্তি ঘটনার ঘনঘটায় ঘাটে ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে সময়ের ঘূর্নীশ্রোতে হারিয়ে যায়। ঘটনার গরমে লজ্জা শরমে কিছুদিন চলবে গরম গরম শ্লোগান বক্তৃতা । গরম শেষ নরম সবাই চলবে সবই আগের মতন এভাবেই চলছে চলবে আমাদের সবার জীবন।

স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক আদিবাসী ভাইবোনেরাও প্রাণের ভয়ে মাঝে মাঝে গহীন জঙ্গলে আত্মগোপন করে। সেনাশাসন অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে উড়ে এসে স্থায়ীভাবে জুড়ে বসা বাঙ্গালী দখলকারীদের সংঘবদ্ধ কিংবা যৌথ আক্রমণের ভয়ে তাঁরা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে খাগড়াছড়িগামী বাস থেকে আদিবাসী চেহারার লোকদের নামিয়ে তাঁদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। [নেপথ্যে আমার স্বচক্ষে দেখার কথা স্মরণে আসে, একাত্তরে বাস থেকে নামিয়ে লোকদের সারিবদ্ধ দাড় করিয়ে কাপড় তুলে খৎনা করা আছে কিনা পরীক্ষা হত; আর এখন চেহারা দেখে আদিবাসীদের নামিয়ে নেয়া হচ্ছে। তখন খোঁজা হত হিন্দু; আর এখন হচ্ছে আদিবাসী] দুর্বৃত্তদের আক্রমণ ও নির্মম নির্যাতনের ফলে কেউ কেউ লাশে পরিনত হয়েছে বলেও শোণা গিয়েছে। একজন আদিবাসীর ঠিক মাথার তালুর উপর কুঠারঘাতে কাঠ কাটার মত ক্ষত করার বীভৎস এবং লোমহর্ষক একটা ছবিও পত্রিকাতে দেখেছি। প্রান্তিক ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মামলা, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা, মন্দির, প্যাগোডা ধ্বংস, প্রতিমা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, জায়গাজমি দখলের খবর কোন নতুন ঘটনা নয়। ২০১০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের এগারোটি আদিবাসী পল্লীতে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করা হয়েছিল। বেসরকারি হিসেব ও তথ্য অনুযায়ী, সেদিনের ঘটনায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সেটেলার বাঙ্গালীরা জড়িত ছিল। তাঁরা ৭৫০টি পরিবারের আবাসগৃহ পুড়ে ছাই করার মাধ্যমে আদিবাসীদেরকে তাঁদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের এই তাণ্ডবলীলায় লিপ্ত হয়েছিল। পাক সেনাবাহিনীর ন্যায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যদের কামনা ও লালসার শিকার হয়ে কতো অসহায় আদিবাসী যুবতী নারী, ললনার সম্ভ্রম ও সতীত্ব এযাবত বিনষ্ট হয়েছে, তার হিসেব কে রাখে? পাহাড়ে ও সমতলে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন অনেকটাই সিনেমার ছন্দময় জনপ্রিয় গানের কলির মত, যার খবর কেউ রাখেনা। পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পায় না। “তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়, দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়। প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে। স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে সরে চলে যায়, ধরণীর বুকে পাশাপাশি তবু কেউ বুঝি কারো নয়…।”

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে শান্তিতে বাস করে আসছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মূলত পাহাড়ের আদিবাসীদের জীবনে চরম অন্ধকার নেমে আসে। যুগ যুগ ধরে ভোগ দখলকৃত সম্পত্তি থেকে যখন তাঁদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে বাঙ্গালীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চালু হয়, তখন থেকেই এই অশান্তির সূত্রপাত। অপ্রত্যাশিতভাবে সেনাবাহিনী ও বাঙ্গালী সেটেলারদের দ্বারা আদিবাসীরা আক্রান্ত হতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে আদিবাসীরা তাঁদের মানসম্ভ্রম এবং আত্মরক্ষার জন্য “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি” নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল। প্রয়োজনে অনাহুত আক্রমণ মোকবেলা করার জন্য “শান্তি বাহিনী” নামে একটা সশস্ত্র শাখাও তাঁরা গঠন করেছিল। সমস্যার স্থায়ী শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সরকার পক্ষ থেকে আজও পর্যন্ত চুক্তির অনেক শর্ত পূরণ করেনি। ফলে, স্থিতিশীলতার পরিবর্তে দখলদার বাঙ্গালীদের হিংস্রতার শিকার হয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও আদিবাসী সম্প্রদায় নিগৃহীত হচ্ছে।

অথচ, এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মত মাথা উঁচু করে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার আকাংখা নিয়ে আমরা সবাই সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সেদিনের গানের কলি ছিল, “আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের – কুলি আর কামারের, চাষা আর মজুরের…হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান এক দেশ সকলের…।” অথবা, “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা…।” কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রতিশ্রুতি? দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের পরিবর্তে আজ ব্যভিচার, সামাজিক বৈষম্য এবং সবল কর্তৃক দুর্বলের উপর অত্যাচার, বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে জীবন ধারণের অধিকার বঞ্চিত হয়ে কত মানুষের স্বপ্ন সাধ আহ্লাদ যে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে, তার খবর কে রাখে? আজও কি, বিচারের বানি নিরবে নিভৃতে কাঁদবে?

প্রথমে ভাবছিলাম সুখি ভঙ্গি, লাল টিপ দেয়া নিজের সুন্দর ছবি দিয়ে যে এই লেখা লিখছে সে আর কি লিখবে, পরে লেখা টি পরার পর মনে হল এমন সহজ ভাবে কেউই লিখতে পারে না। আহব্বান এর সুরটা দারুন। লেখাটি সবার পড়া উচিত।

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.