ফরিদা ইয়াসমিন: আজ অনেক বছর পর আমার মেয়ে হুট করে, এক প্রকার জোর করেই বললো, “মা, তুমি তোমার কথা কিছু লিখো”। এখন যেমন চোখের দৃষ্টি অনেকটা ঝাপসা, আর মনের জোর বলতে সেই আগের ঝলসানো ভাব নেই। তারপরও মেয়ের কথা ফেলতে না পেরে হঠাৎ করেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা প্রতিবাদ অনুভব করলাম। আর তাই লিখতে বসলাম।

পরিবারে আমরা আট ভাইবোনদের মধ্যে আমি মেজো। মেজোরা এমনিতেই একটু স্বাধীনচেতা মনোভাবের হয়। যেটা আমার মধ্যেও ছিল। আট ভাইবোনের মধ্যে বাপ-মায়ের আদরটা ছিল একটু অন্যরম, অর্থাৎ অন্যদের তুলনায় বেশী। আর এটাই আমাকে পেয়ে বসতো। যেটা করতে চাইতাম সেটা অনায়াসে করার সুযোগ পেতাম। এর মানে এই নয় যে, যা খুশি তাই। আমি বলতে চাইছি, ছোটবেলা লেখাপড়ার পাশাপাশি গান-নাচ-নাটক ইত্যাদি করার অনেক সুযোগ পেয়েছি। কোন বাধা পাইনি। যদিও মা একটু মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ করে থাকলেও, বাবা একদমই উদারমনস্ক ছিলেন।
তারপর দিনে দিনে জীবন ভালোই চলছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি খুলনা বেতারে নিয়মিত শিল্পী হয়ে গিয়েছিলাম। তখন নতুন বলে সপ্তাহে একটা করে গান রেকর্ড হতো। মাঝেমধ্যে নাটকের কথা বলতো। কিন্তু রাতে রিহার্সেল করতে হবে বলে মায়ের একদম বারণ ছিল। আর ঐ সময় আমার বিয়ের কথা পাকাপাকি হচ্ছিল বলে বাবাও মায়ের সঙ্গে প্রথমবারের মতো একমত হয়ে গেলো।
আমি হতবাক ও নিরুপায়। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের পরিবারকে আমি বড্ড বেশী ভালবাসতাম বলে তাদের কথাই মেনে নিয়েছিলাম, প্রতিবাদ করিনি। শুধু অভিমান হচ্ছিল, বাবা আজ আর আমার দিকে রইলো না। কতো স্টেজ ফাংশন করেছি। কখনও না করেননি। বরং আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। আজ আমার বাবার মুখেই ‘না’ শুনতে হলো!
ইতিমধ্যে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেল।
লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটলো। চট্টগ্রামে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। বাবার বদলি হলো খুলনাতে। খুলনাতেই বিয়ে হলো। খুলনায় কোন ভার্সিটি সেসময় ছিল না। তাই মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া হলো না। কিন্তু গানটা নিয়ে বেশ থাকলাম।
নয় মাস পর সংসারে পুরোপুরি ঢুকলাম। যা হয় আর কী মেয়েদের জীবনে। আর আমি সংসার করতে আসলাম ঢাকা শহরে। আমার গানের প্রোগ্রাম খুলনাতে। প্রতি সপ্তাহের প্রোগ্রামগুলোর চিঠি ডাকে করে ঢাকাতে ঠিকই চলে আসতো। কিন্তু তখনই আমার পেটে বাচ্চা চলে এলো। শক্তিও হলো না অতদূর যাওয়ার।
আমার হাজবেন্ড বলতেন “থাক! বাচ্চা হয়ে গেলে আমার সাধনা করা যাবে”। আমাকে নিরাশ করতেন না ঠিকই, কিন্তু সব জায়গায় ভীষণ বাধা পেতাম। যে ধাঁধায় আজও আমার জীবন বাঁধাই রয়ে গেল।
ঠিক সময়ে আমার ছেলে হলো। ধীরে ধীরে বড় হলো। ছেলের বয়স চার বছর তখন নতুন করে সাধনার জন্য বাফাতে ভর্তি হলাম। মনে মনে ঠিক করলাম “চার বছর ভালভাবে চর্চা করে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে নিবো, যাতে করে গানের জগতটা আরও ভালভাবে প্রসারিত হয়”। এভাবেই মনোবল ঠিক করছিলাম। সংসারে তখন তেমন সমস্যাও হচ্ছিল না। আমার বাবুর তখনও লেখাপড়া শুরু হয়নি। সংসারে মানুষ বলতে তখন তিনজন।
মেয়ে তখনও কোলে আসেনি। তবে যাতায়াতটা সমস্যা ছিল। মিরপুর থেকে ধানমন্ডি। মাঝে-মধ্যে মাসের কোন কোন সপ্তাহে বাদ পড়তো। আর এই নিয়ে বাবুর আব্বুকে বলতাম, “তুমি শুক্র-শনিবার বাবুকে রাখবে, আর আমি এই দুইদিন বাফাতে যাব”।
কিন্তু বাঁধ সেধেছিল আর একটি কারণ। আমি ঢাকার রাস্তা চিনতাম না। আজকের মতো কোথাও একা একা চলাফেরা করতে পারতাম না। ভাগ্নেদের মধ্যে কাউকে না কাউকে নিয়ে যেতে হতো। কিন্তু আর কতদিন এভাবে চলবে! একটা সময় কেউ না কেউ কাজে আটকা পড়তো! বছর খানেক চালানোর পর আর পেরে উঠলাম না।
আস্তে আস্তে ঘরেই সাধনা চালালাম। ভাবতাম বাবু বড় হয়ে গেলে কোনো সুযোগ করে নেবো। রেডিও টেলিভিশনে আবার অডিশন দিব। কিন্তু মনের ইচ্ছাটা মনেই রয়ে গেল।
বাবা মাঝেমাঝে বাসায় এসে আফসোস করতেন “ছোট থেকে মা’টাকে গান শিখালাম, কিন্তু গলায় সে গান একেবারেই শুনি না”। অথচ আমার মা বলতেন “মেয়েকে বিয়ে দিয়েছ, সংসার করছে, এটাই তো ভাল। গান না শুনলে কি হবে?”
কথাগুলো বলেছিল আমার মেয়ের সামনে। মেয়ে যখন আমাকে জানায় তখন আমার ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠে। লেখাপড়ার চাইতেও গানকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম বেশী। শিশুকাল থেকে সকাল সন্ধ্যা রেওয়াজ! কী প্রতিদান পেলাম!
আমি বলছি না, আমার গানের যশ খ্যাতি চেয়েছিলাম। কিন্তু গাইতে পারবো না, এটাই আমাকে কষ্ট দেয়। সেই গলা, সেই সুর সব হারিয়ে ফেলেছি। এরজন্য অবশ্য আমি কাউকে দায়ী করতে পারি না। নিজের দৃঢ়তা, মনোবলের বড় অভাব ছিল। দিনরাত সোনামণিদের কথা ভাবতাম। নিজের জন্য সময় ব্যয় করার কথা মাথাতেই আসতো না।
আজ যখন মেয়ে কোন ফাংশনের কথা বলে, “মা তুমি-আমি ডুয়েট করব”, তখন সত্যিই খুব বিচলিত হই। মুখে ঠিকই বলি “করবো”। কিন্তু নিজের উপর তখন বড্ড রাগ হয়।
কী হত সংসারের ফাঁকে না হয় আধঘণ্টা করে গলা সাধতাম! তাহলে আজ এতোটা পিছিয়ে পড়তে হতো না! বড্ড ভালো লাগতো।
প্রতিবাদী হয়েও নারীদের একটা সময় কেন যেন নেতিয়ে পড়তে হয়। আর তখন আমাদের সমাজ আমাদেরকে পেয়ে বসে। সমাজ বলতে বুঝাচ্ছি ঘরে বাইরে কিছু মানুষের নজর।
আজ আর নারীরা পিছিয়ে নেই। তাদের দিকটা তারা ঠিক নির্ণয় করতে শিখেছে। আর এটাই আনন্দের। জেগে উঠো নারীরা, জাগো। আমার স্বপ্নের মতো তোমাদের স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলো না।