ক্রিকেট, সুন্দরবন ও নিজেদের দায়িত্বহীনতা….

কাকলী তালুকদার:  এক লোকের দুই বউ, তো একদিন সেই লোক দুই বউকে একসাথে ডেকে বললো, তোমরা দুইজন আমার দুই পা টিপে দাও। দুই বউ স্বামীর কোন্ পা কে টিপে দিবে তা নিয়ে ঝগড়া শুরু করলো। দুজন দু পায়ে ধরে টানতে টানতে বলছে, এটা আমার পা, অন্য জন বলছে, ওটা আমার পা। এক পর্যায়ে বেচারা স্বামীর কথা কেউ শুনছে না, না শুনে পা ধরে টানাটানিতে সেই স্বামীর অবস্থা বেগতিক হয়ে যায়।

river-in-sundarbansবাংলাদেশকে আজ সেই স্বামীর ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি। ভারত আর পাকিস্তান নিয়ে আমরা টানাটানি করছি! মাঝখান থেকে আমাদের দেশ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন! আমি নিজেকে বা নিজের দেশকে রক্ষা করতে হলে নিজেদের  ক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও কৌশল, লক্ষ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
পাকিস্তানের সাথে হিসেব ৭১ এ চূড়ান্ত হয়েছিল, কিন্তু সেই হিসেবে কোন ঘাটতি ছিল কিনা, তা দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যাবে।
আর স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে ভারতের সহযোগিতার হাত অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের।
সকল দেনা-পাওনা হিসেব করেই আমরা আজ স্বনির্ভর বাঙালি জাতি। তবে রাষ্ট্রের স্বার্থ চিন্তা করলে প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজের লাভ বিবেচনা করবে। সেই দিক থেকে আমার দেশের প্রতিটি সমস্যা এবং সমাধানের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।

kakoliআজ ক্রিকেট নিয়ে যে অবস্থা তৈরী হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে ততটুকু ভাবনা কেন আমরা ভাবতে পারছি না, সুন্দরবন নিয়ে? সেই ভালবাসা কেন দেখতে পারছি না দেশের অন্য বিষয়গুলোতে? আমাদের ভালোবাসা, সাপোর্ট নিয়েই ক্রিকেট এগিয়ে যাবে অনেক দূর। সেই ভালবাসা, সাপোর্ট আজ সারা দেশের প্রতিটি সমস্যার জন্যই প্রয়োজন।
আমাদের সরকার কেন অটল থাকে সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে? সেখানেও তো ভারত লাভজনক হবে! আমরা কতটুকু লাভবান হচ্ছি বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, তা আমাদেরকেই হিসেব করে বের করতে হবে।
বাংলাদেশে হিন্দুদের বলা হয় দেশ ছেড়ে চলে যাও? কোথায় যাবে নিজের দেশ ছেড়ে? আমরা দাঁড়িয়েছি তাদের পক্ষে কখনও যতটা দাঁড়াচ্ছি ক্রিকেট নিয়ে?
আদিবাসীদের উপর নির্যাতন, তাদের শিশুরা স্কুলে যায় না ভয়ে, তাদের মেরে ফেলা হবে! আমরা দাঁড়িয়েছি তাদের পক্ষে? যতোটা দাঁড়াচ্ছি ক্রিকেটের জন্য!?
৮০০ কোটি টাকার তদন্ত লুকানোর জন্য জোহা নিখোঁজ, তার পরিবারের কথা ভেবেছেন? সেই মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন নিয়মিত, যে ধর্মের নৈতিক শিক্ষা পাঠ্য পুস্তকে যুক্ত করতে চাচ্ছে সরকার! সেই নৈতিকতার শিক্ষা, সত্য কথা বলার অপরাধে ছেলেটি আজ নিখোঁজ! আমরা দাঁড়িয়েছি তার জন্য? যতটা দাঁড়াচ্ছি ক্রিকেটের জন্য?

আমাদের নিজেদের জন্যই তো আমরা একত্র হতে পারি না! ভারত, আর পাকিস্তান কী করবে!

আমাদের ভিতর পাকিস্তানপ্রেমী আর ভারতপ্রেমী দুই জনই আছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের অবস্থান আজ কোথায়?
নিজের দেশের মানুষগুলোর পাশেই তো দাঁড়াচ্ছি না। আরেকজনের মন্দ কেন নিয়ে পড়ে আছি!

সরকার কি করছে? সুন্দরবন, ক্রিকেট, জোহা, ৮০০ কোটি টাকা ডাকাতি, ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যা, দখল,ধর্ষণ, বিতাড়িত কে করছি? প্রতিদিন শিশু হত্যার খবর পত্রিকা খুললে, ধর্ষিত হচ্ছে নারী আমাদের নিজের দেশের ভিতরে!
আমরাই করছি সব! নিজেদেরকে শুধরানোর চর্চাটা আমরা ভুলে যাচ্ছি। সমাজ যখন অভিভাবকহীন হয়ে যায়, তখন এমন হয়। তাই রাজনীতি হতে হয় স্বচ্ছ, নেতাদের হতে হয় নির্মোহ, তবেই দেশ সুন্দর হয়।

ধর্মের কথা বলছি আমরা, একজন ধর্ম গুরু বের করেন আমাদের দেশে যিনি অন্য ধর্মের মানুজনের উপর আক্রমণের পরে বুক পেতে দাঁড়িয়েছেন এই সকল অপরাধ বন্ধ করতে!
নেই, খুঁজে পাই না! সত্যিকারের ধার্মিক কখনও ধর্মকে পুঁজি করে মানুষের পাশে দাঁড়ায় না, সে দাঁড়ায় প্রাণের পক্ষে, সৃষ্টির পক্ষে, যে সৃষ্টি উপরওয়ালার দ্বারা সৃষ্ট বলে ধার্মিক বিশ্বাস করে।

একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন আমরা কী করছি?বার বার জিজ্ঞেস করুন নিজেকে, কী করছি, উত্তর মিলে যাবে, সেটাই উপরওয়ালা আমাদের দিয়েছিলেন নিজের পথ চলার জন্য, সমাজ গড়তে, রাষ্ট্র গড়তে, সভ্যতা গড়তে। তথাকথিত উপরওয়ালার সকল সৃষ্টিকে সম্মান জানাতে।

আমিও ভালোবাসি ক্রিকেট,বাংলাদেশ জিতলে মনে হয় আমি নিজে জিতে যাই। হেরে গেলে আমিও হেরে যাই। ঠিক তেমনি দেশের প্রতিটি খবর আমাকে হারিয়ে দেয় বা জিতিয়ে দেয়।
সুন্দরবন আর ক্রিকেট সবাই আমাদের সম্পদ, যেখানেই হারবো, সেটাই আমাদের সকলের হেরে যাওয়া, জিতে গেলে আমরাই জিতে যাবো।

শেয়ার করুন: