ফারজানা নীলা: ‘নিম্ফোমেনিয়াক’ নামে মেডিকেল ডিকশনারিতে একটি টার্ম আছে। যার অর্থ, যে নারীর মধ্যে সেক্সের ইচ্ছে প্রবল। কিন্তু এই শব্দটি কেবলমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কেন?
যেখানে আমরা দেখতে পাই নারীদের যৌন চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত থাকা তো অনেক দূরের কথা, স্বাভাবিক যৌন চাহিদাও ঠিকমতো প্রকাশ হয় না, হলেও সেটি পূরণ হয় না। যেহেতু এই টার্মটি শুধুমাত্র নারীদের জন্যই প্রযোজ্য, সে থেকে এটা খুব সহজেই বুঝা যায় যে সমাজ নারীর জন্য খুব চমৎকার একটি সীমানা টেনে দিয়েছে যে নারীকে তাঁর সঙ্গীর মাধ্যমেই যৌন চাহিদা পূরণ করতে হবে। তাতে তাঁর চাহিদা অপূর্ণ থেকে গেলেও কোনো সমস্যা নেই। যদি সীমা অতিক্রম করে তবেই সে আক্রান্ত, মানিয়াক।
ধরেই নেয়া হয় যে একজন নারী তাঁর স্বামীর কাছ থেকেই যৌন চাহিদা পূরণ করবে। এটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় দেখা যায় স্বামীরা স্ত্রীর যৌন চাহিদা পূরণের ব্যাপারে আগ্রহী নয়, বা অনেক পুরুষ তো জানেই না নারীদের তৃপ্তি কীসে আসে! স্বামী তাঁকে তৃপ্তি দিচ্ছে কি দিচ্ছে না, আদৌ স্বামী তাঁর চাহিদা পূরণ করছে কিনা, সেটি মুখ্য নয়।
মুখ্য হলো তাঁকে স্বামীর ইচ্ছে মতোই শারীরিক সম্পর্ক করে যেতে হবে। তবেই সে সতী এবং “ভাল” মেয়ে। সর্বোপরি কোনো মেনিয়াতে আক্রান্ত নয়। নারীরা লজ্জা আর সতী থাকার লোভে বা বাধ্য হয়ে নিজের চাহিদার কথা গোপন রেখে স্বাভাবিক যৌন চাহিদাই পূরণ করতে পারে না, আর পূরণ করলেও সে সংখ্যা সন্তোষজনক নয় মোটেও।
আদিকাল থেকেই “অতিরিক্ত যৌন চাহিদা’ শব্দের সাথে “সতী” শব্দের একটা দ্বন্দ্ব আছে। সমাজের ডিকশনারিতে সতী সেই নারী যে নারী নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে নিজের চাহিদা পূরণ করবে, পূরণ না হলেও আজীবন তাঁর সঙ্গীর প্রতি সৎ থাকবে। যার “অতিরিক্ত যৌন চাহিদা” থাকে, সে তাঁর সঙ্গীর প্রতি সৎ থাকে না, আকারে ইঙ্গিতে নিম্ফোমেনিয়াক এই ধারণারই প্রচারণা চালায়। যুগ যুগ ধরে সতী নারীর যে চিত্র আমাদের সমাজে বহাল, তাঁর অন্যথা যেন না ঘটে তার জন্য এই নিম্ফোমেনিয়াক টার্মের উদ্ভব।
বিস্ময়কর হলো, পুরুষদের জন্য নিম্ফোমেনিয়াক জাতীয় কোনো টার্ম নেই। এখন এ থেকে খুব সহজ একটি ধারনায় আসা যায় যে পুরুষরা সহজাতভাবে বহুগামী হবে, তাদের যৌন চাহিদা সবসময় অতিরিক্তই হবে, তারা ঘরে-বাইরে বহু প্রেমিকার সাথে যৌন সম্পর্ক করবে; এটাই স্বাভাবিক এবং কোনভাবেই কোনো মেনিয়া নয়। পতিতালয় বলে যে জায়গা সমাজে আছে, সেখানে উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তর সব শ্রেণীর পুরুষের আগমন ঘটে। সোজা বাংলায় বলা যায় পুরুষদের চাহিদা অধিকাংশ সময় মাত্রাতিরিক্তই হয়।
এমন নারীর সংখ্যা অবশ্যই কম যারা তাদের যৌন চাহিদার কথা মুখ ফুটে বলতে পারে। যারা বুঝতে পারে কীভাবে তারা তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। লজ্জা কাটিয়ে নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেওয়া নারীদের কপালে জোটে নানারকম কুৎসা- রটনা- অভিযোগ- বদনাম- খারাপ মেয়ের ট্যাগ।
এখন প্রশ্ন করা যায় যে কতটুকু চাহিদা প্রকাশ করলে তাঁকে নিম্ফোমেনিয়াক বলা যাবে। নারী যদি বলে সে তাঁর সঙ্গী দ্বারা সন্তুষ্ট না, তবে কি তাঁকে নিম্ফোমেনিয়াক বলা যাবে? সন্তুষ্ট না হয়ে নারী যদি অন্য সঙ্গী বাছাই করে তবে কি তাঁকে নিম্ফোমেনিয়াক বলা যাবে? অথবা পুরুষরা যেমন অহরহ বাইরে সম্পর্ক করে বেড়ায়, তেমন যদি নারীরাও করতে চায়, তখন কি তাঁকে নিম্ফোমেনিয়াক বলা যাবে? হয়তো এই সব প্রশ্নের উত্তর “হ্যাঁ” হবে।
কারণ যে কাজ পুরুষ করলে তাঁকে কোনো মেনিয়াতে আক্রান্ত বলা হয় না, বিপরীতে নারী করলে তাঁকে আলাদা করে মেনিয়াতে আক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করা হয় তখন এই সত্য অত্যন্ত প্রবল ভাবে দীপ্ত হয়ে উঠে যে, পুরুষের জন্য শারীরিক সম্পর্কের অর্থাৎ যৌন চাহিদার কোনো সীমা নেই। কিন্তু নারীদের থাকতে হবে সীমারেখার ভেতরে। পুরুষদের সীমা লঙ্ঘন করা সহজাত, আর নারীদের সীমার মধ্যে থাকাই সহজাত।
হাতিয়ারের অভাব নেই নারীদের শরীর মন তাঁর চাহিদা চাওয়া পাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার, তাঁকে বদ্ধ রাখার।
পুরুষ যেন নারীর অধীশ্বর। নারী যদি তার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে পুরুষদের মতো তৃপ্ত হওয়া শুরু করে, তবে পুরুষ কর্তৃত্ব ফলাবে কার উপর? কার শরীরকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করবে? কাকে শেখাবে “নারী তোমার যৌন চাহিদার জন্য তুমি শুধুমাত্র তোমার সঙ্গীর উপরই নির্ভর”? মেনিয়াতে আক্রান্ত বলে যদি একবার ঘোষণা দেওয়া যায় তবে তো পথ আরও সোজা হয়ে যায় পুরুষদের। সতী বানাতে না পেরে রোগীই বানিয়ে দিল!
নারীকে বলি, পুরুষ তোমাকে তাদের নির্ধারিত “ভাল” “খারাপ” সংজ্ঞায় বর্ণনা করার জন্য হাজারো নিয়ম বানাবে, সতী থাকার লোভ দেখাবে, মেনিয়াকে আক্রান্ত বলে ভয় দেখাবে। কিন্তু এসবের চাপে একটি সত্য ভুলে যেও না, যে তোমার শরীর তোমার একান্ত ব্যক্তিগত। এই শরীর কী চায়, কী চায় না, তা নির্ধারণ করার অধিকার শুধু তোমার। তোমার সঙ্গী তোমাকে খুশি করতে না পারলে, তোমার চাহিদা যদি অন্য কারো প্রতি জাগে, তবে কেন নিজেকে বঞ্চিত করবে?
সমাজের চোখে সতী হওয়ার লোভে, নাকি খারাপ বলবে এই ভয়ে? যে সমাজ পুরুষদের জন্য বহুগামীতায় কোনো সীমা নির্ধারণ করে না, তার জন্য কোনো “টার্মের” জন্ম দেয় না , তাঁকে সৎ থাকতে বাধ্য করে না, সেই সমাজের ভয়ে নিজেকে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ করা কেন? বৈষম্য সৃষ্টি করে সততার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় না।
জন্ম হয়েছে নারী তোমার অন্যকে খুশি করে চলার জন্য না। কারো ভাল খারাপ বলার তোয়াক্কা না করে নিজের জন্য বাঁচো। নিজের চাহিদাকে মূল্য দিতে শেখো। সমাজ তোমাকে নিম্ফোমেনিয়াক বলে গালি দিলেই বা কী!
সাহসের সাথে এখন এসব কথা বলার সময় এসেছে। যৌনজীবনের অনেক অবদমন, অনেক হীনম্মন্যতা আমাদের ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে, আমাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, নষ্ট হয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। আমরা ভালো করে ভালোও বাসতে পারি না, এ যে কতো বড় অপচয় জীবনের, যে জানে সেই জানে। ‘হ্যাভিং সেক্স’ কে ‘মেকিং লাভ’ করতে না পারলে এক দুর্লভ আনন্দ থেকে মানবজন্ম বঞ্চিত হয়। এই বঞ্চনা পুরুষের তুলনায় নারীদের অনেক বেশি। একবারও চরমতৃপ্তি বা রাগমোচন বা অর্গাজম ছাড়াই সারা জীবন কাটিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাই বেশি এই দেশে। তাই নারীদের মধ্যেও খোলামনে সেক্স, অর্গাজম, অর্গাজম ডেফিসিট, ফেইক অর্গাজম নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে। শরীরজাত আনন্দ উপভোগ করার অধিকার নারী পুরুষ সবার সমান। এটাও তাঁর মানবাধিকার। নিজেকে ভালবাসতে পারলে, নিজের শরীরের মধ্যে অবস্থিত অনির্বচনীয় আনন্দকে উপভোগ করতে পারলে আমরা অন্যকেও আরো বেশি ভালবাসতে পারব, অন্যের আনন্দ – অধিকারেরর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারবো।
satyriasis in men, do not write anything without researching
but no ‘mania’ type of indication in it, right?