তাসলিমা আক্তার: আজো সীতাকে অগ্নিপরীক্ষায় নামতে হয়। আজো নারীকে সন্তান জন্মের কল বানিয়ে রাখা হয়। এখনো নারীর জন্য দিবস পালন করার প্রয়োজন হয়। আমরা জানি, শিক্ষা অন্ধকার দূর করে। কিন্তু অশিক্ষিত থেকে শুরু করে অতি শিক্ষিত ভদ্র সমাজেও নারী প্রতিনিয়ত বৈষম্য, নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। নারীকে শেখানো হয়, “তুমি এই করো, তুমি এই করো না-এতে তোমার মঙ্গল নিহিত আছে”।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দুটি দৃশ্যপট চিত্রায়ন করিঃ
নিত্য দিনের মত সেদিনও অফিস যাচ্ছিলাম। রিক্সা করে যাচ্ছি। কোকাকোলার মোড় পার হচ্ছি। দেখলাম,রাস্তার পাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। এ ধরনের দৃশ্য ঢাকা শহরে নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু চোখ পড়লো, যাকে নিয়ে দৃশ্যপট তৈরি-সে একজন কুড়ি- বাইশ বছরের মেয়ে। অসহায় চাউনি। আমি আগ্রহ তাড়িত হলাম। রিক্সা থেকে নেমে ঘটনা জানার চেষ্টা করলাম। ঘটনাটা এইরকম,
মেয়েটি একটা রিক্সা করে কোথাও যাচ্ছিল। রিক্সাচালক এলোমেলো চালাচ্ছিল, মেয়েটির বার বার বারণ সত্ত্বেও। দু’বার দুর্ঘটনা হতে হতে বাঁচা গেছে। মেয়েটি কোকাকোলার মোড়ে এসে রিক্সা থেকে নেমে পড়লো। রিক্সাচালক পুরো ভাড়া দাবি করল। এ নিয়ে দুজনে বেশ কথা কাটাকাটি।
মেয়েটি চলে যেতে উদ্যত হলে রিক্সাচালক মেয়েটির কাঁধে ধাক্কা দেয়। মেয়েটি এবার চালককে চড় মারে। ঘটনার এই পর্যায়ে আমার দৃশ্যে প্রবেশ। দুজন ট্রাফিক পুলিশ, বেশ কজন পুরুষ পথচারী, কিছুসংখ্যক নারী ঘটনাস্থলে উপস্থিত।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, প্রত্যকটি মানুষ মেয়েটিকে দায়ী করছে একজন পুরুষের গায়ে হাত তোলার দায়ে। অথচ মেয়েটিকেই কিন্তু প্রথমে নির্যাতন করা হয়েছে। সে কথা কেউ বলছে না। একজন নারীকন্ঠ বললো, কত বড় সাহস তোমার-পুরুষ পুলার গায়ে হাত তুলছো!
মেয়েটি অসহায়ভাবে শুনছে, প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছে। মেয়েটির অসহায়ত্ব নিজের মধ্যে অনুভূত হতে থাকে। আমি লাজে নুয়ে পড়া মেয়েটিকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগোই। পেছন থেকে তীব্র কন্ঠস্বর ভেসে আসে। ভালো মাইয়া না, এগুলা টু নাইনটি। আমি বুঝে নেই, টু নাইনটি সম্ভবত যৌনকর্মীদের কোড নাম্বার।
অনেক নামী ঘর, দামী পাত্রের জন্য বাছাই করা হচ্ছে গ্রামের কোনো অখ্যাত ঘরের স্বল্প শিক্ষিতা সুন্দরী পাত্রী। উদ্দেশ্য, যেহেতু এরা শহুরে চালচলন কম বুঝে-গাছেরটাও খাওয়া যায়, আবার তলারটাও কুড়ানো যায়। ডমিনেটও করা যায় ঠিকমত।
ফোনে এ্যাপলক, থাম্বলক। যাতে ঘরের জন কিছু জানতে না পারে। এতো কিছুর কী দরকার বাবা! বৌ উল্টা-সিধা কিছু জিজ্ঞেস করলে সোজা উত্তর, “মৌলভী সাহেবকে ডেকে তালাকের ফতোয়াটা জানতে হবে” (সুত্র: ঘেটুপুত্র কমলা)। ব্যস, বৌয়ের মুখ জন্মের তরে বন্ধ। হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর দিয়ে চিহ্নিত করণ -“ব্যাক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি”। উদ্দেশ্য যদি এতেও সাধন না হয়, তো শেষ খোঁটা গাড়-ধর্মের স্মরণ নাও, “স্বামীর পায়ের তলে স্ত্রীর জান্নাত”। সুরসুরিয়ে স্ত্রীধন পদতলে।
আসছে বৈশাখ
আবার আমাদের লাঞ্ছিত হবার পালা। কিন্তু এবার ঘুড়ে দাঁড়ালে কেমন হয়? আমার একটু আধটু কবিতা লেখার বাতিক আছে। বৈশাখের এই কবিতাটি যদি ভালো লাগে তবে গেঁথে নেই মনে আর শক্তি নেই,
তখন আমার কিশোরী বেলা
সবে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছি, ফুল আর লতা পাতা
চামড়ার ভেতর ফুসে উঠ্ছে অচেনা ডিগে শরীর
বৈদ্যতলার মাঠে মেলা বসেছে, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা
তীলের নাড়ু দলা পাঁকাতে পাঁকাতে বলেছিলাম
মাগো মেলা দেখতে যাবো, সকলে যায় দেখো না-
বাড়ন্ত মেয়েদের মেলায় যেতে নাই, অনাসৃষ্টি হয়
সোজা চরণে পড়ে বলেছিলাম, যাই-না মা।।
বৈশাখের রোদে মাটি পোড়ে বিলের পানি শুকায়
কদমা বাতাসা বাঁশের বাঁশী, ডুগডুগি আর আনন্দ
আমার লাল শাড়ির আঁচলে ভ্যাটের খই নিয়ে ভিড় দেখি
বায়োস্কোপওলার গানের সুরে নেশা লাগে, ঘোর জাগে
আরে কী চমেতকার দেখা গেলো, কী চমেতকার!
ঝুঁকে থাকা ডিগে শরীরের অসমান ভাঁজে কুটিল নখর
দৌড়ে পালানো পুরুষটির ঘাড়ে অসুরের মূর্তি দেখি
হাত ছাড় হারামজাদা, আজ আমি খড়গ হাতে চণ্ডি
বুকের উপর পা রেখে শুরু হবে বিজয়ের সূচনা।