পাঁচালির প্যাঁচাল-১

অনুপা দেওয়ানজী: লক্ষীপূজো।পূর্ণিমার জোছনা উছলে পড়েছে চারিদিকে।পুরো বাড়ি জুড়ে আলপনা দেয়া হয়েছে।ছেলেরা বাদে, বউ, ঝিরা সবাই উপোস।সিংহাসনে মা লক্ষীর মূর্তি।তিনি সর্বালংকারা, মাথায় শোভা পাচ্ছে শোলার ছাতা। দেবীর সামনে ফুলে,ফলে,ধূপ,দীপ,নৈবেদ্য, পঞ্চশষ্য।ভারি পবিত্র এক দৃশ্য।

Hindu 1সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পুরোহিত কখন আসবেন।

ওদিকে তোলা উনুন থেকে বাতাসে ছড়াচ্ছে নারকেল নাড়ু আর ঘন দুধের পায়েসের গন্ধ।ধামায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে তিলের নাড়ু, মুড়ি আর চিড়ের মোয়া, খই এর মুড়কি। সকাল বেলায় জেলে দিয়ে গেছে বড় এক জোড়া মাছ। সে মাছ দুটোকে তেল আর সিঁদুর দিয়ে পাঁচ এয়ো মিলে উলু দিয়ে বরণ করেছে। এ মাছ আজ এয়োদের জন্যে। কারণ লক্ষ্মী পুজো হচ্ছে সধবা রমণীদের পুজো। সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় রাখা বা স্বামীর মঙ্গলের জন্যে এ পূজো। মা লক্ষ্মীর বিধবা মেয়েদের এখানে তেমন কোন ভূমিকা নেই। কারণ স্বর্গের দেব-দেবীরা চির অমর। তাই ওখানে কোন বিধবা নেই। এ জন্যে মর্ত্যের বিধবাদের আলাদা কোন দেবীও নেই। মর্ত্যের মানুষেরা তাই নিজেদের মতো করে বিধবা মেয়েদের জন্যে নানা নিয়ম কানুন বেঁধে দিয়েছে।

নিরামিশ রান্না ঘরে বিধবাদের জন্যে রান্না করা হচ্ছে খিচুড়ি আর লাবড়া। আর স্বামীর মঙ্গল কামনায় উপোসি সধবা নারীদের জন্যে রান্না করা হচ্ছে মাছের নানা পদ। যেমন মাছ ভাজা, মুগ ডাল দিয়ে মাছের মুড়ো, মাছের কালিয়া, এ ধরনের নানা পদ। আজ যে তাঁদের নিরামিশ ছোঁয়া নিষেধ।

আচ্ছা ব্যাপারটা যদি এমন হতো সব ছেলেরাও মিলে পত্নী প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একই সাথে পত্নীদের মঙ্গলের জন্যে কোন দেবীর অর্চনায় মেতেছে! কেমন হতো তাহলে? কিন্তু তাতো হবার নয়। কারণ স্বর্গের দেবীদেরও যে ‘পতি পরম গুরু’ এই আপ্তবাক্যটি মেনে চলতে হয়।কাজেই এই দায়িত্ব নেবার মতো কোন দেবী সাহস করে আর এগিয়ে এলেন না।

কিন্তু পুরোহিত আসতে এত দেরী করছে কেন?  

সেই গতকাল রাতে খাওয়া হয়েছে। এখন প্রায় আটটা বাজতে চলল। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। পূর্নিমা তো শুরু হয়েছে। পুরোহিত এলেই পূজো শুরু হবে। এই পরিবারে মেয়ে আর বউদের তিনবার বিশেষভাবে নুতন শাড়ি উপহার দেয়া হয়। পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপূজো আর লক্ষ্মীপূজো। বিধবাদের লক্ষ্মী পূজোতে কোন শাড়ি দেয়া হয় না। কারণ এটা সধবা রমণীদের পুজো। সবাই নুতন কাপড় পরে পুজোর কাজ করছে, দেখতে ভারি সুন্দর লাগছে। বি-ধ-বা তিন অক্ষরের এই শব্দটি যেন সমাজের চোখে অকল্যাণ, অলক্ষ্মী, অশান্তি, গলগ্রহ আর করুণার এক প্রতিমূর্তি। কারণ তার স্বামী নেই। কিন্তু সত্যিই কি তাই! প্রকৃতির নিয়মে মানুষের মৃত্যু হয় জানি, এতে বউটার কি অপরাধ! অথচ তার উলটো পিঠে তাকালে দেখি যার বউ মারা গেছে তাকে পরম ভাগ্যবান মানা হচ্ছে।হা হা হা ! কী অদ্ভুত নিয়ম! এক সময়ে এইসব অসুবিধা ছিল না স্বামী মারা গেলে জ্যান্ত বউটাকেও সেই সাথে পুড়িয়ে মেরে বউটাকে স্বর্গে নাকি যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হতো। ওই যে পতির সাথে সতীর দাহ। কারণ স্বর্গে তো বিধবা তখন ছিল না। কিন্তু রাজা রামমোহন রায় যখন এ ব্যবস্থা রোধ করে দিলেন, তখন বিধবাদের নিয়ে সমাজ পড়লো বিপাকে।

আমরা জানি পৃথিবী যখন পাপে পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে তখন নাকি স্বয়ং ঈশ্বর মানুষরুপে জন্ম নেন এই পৃথিবীতে আর সে পাপ তিনি নিজে মোচন করে দেন মানব কল্যাণের জন্যে। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন তেমনই একজন মহামানব বা নরনারায়ণ।

Anupa Dewanji
অনুপা দেওয়ানজী

বিধবাদের প্রাণ তো রক্ষা হলো, কিন্তু সুবিধাভোগী শ্রেণীর মাথায় যে হাত! এতোদিন মৃত স্বামীর সাথে জ্যান্ত স্ত্রীদের সতীদাহের নামে পুড়িয়ে মেরে, তাদের নাবালক সন্তানদের সম্পত্তি দখল করার পথটি যে বন্ধ হয়ে গেল। কী করা যায় এখন! উপরন্তু এতো সব সুন্দরী বিধবাদের রুপ লাবণ্যে নিজেদের কাম প্রবৃত্তিও সংযমে রাখা যে দায়।

ঠিক হলো বিধবাদের রঙিন শাড়ি পড়া চলবে না, গয়না পড়া চলবে না, আমিষ খাওয়া চলবে না। উঁহু তাতেও হলো না, দাও এবারে ওদের মাথা ন্যাড়া করে। তাতে যদি কিছুটা কাজ হয়। অর্থাৎ ধীরগতির বিষক্রিয়া বা স্লো পয়জনিং শুরু হলো এতে যদি ওরা অন্তত তাড়াতাড়ি মরে। অথচ নিজেরা কিন্তু বউ মারা যাওয়ার সাথে সাথে মুখাগ্নিটা সেরেই কনে দেখার জন্যে ঘটকের কাছে ধর্না দেয়।

এমন সময়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের আনন্দধ্বনি ভেসে আসলো পুরোহিত এ- সে- ছে। (চলবে)

শেয়ার করুন: