শামীমা মিতু: নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রায় ১০৬ বছর পার হয়ে গেছে। মজুরি বৈষম্য, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে নারীর জন্য বিশেষ যে দিবসের সুচনা হয়েছিল, বর্তমান সময়ে তা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই না! এই দিবসে, প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক পুরুষটিও কোনো নারীকে ফুল দিয়ে সম্মান জানায়, ঠিক পরের দিনই ‘খেলা হবে’ বলে পেশিশক্তির পৌরুষ নিয়ে হাজির হয়, তখন নারী দিবসের চেয়ে হাস্যকর বলে আর কিছু থাকে না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও মোল্লাদের ভয়ে নারীনীতি বাস্তবায়ন করতে পারেন না, কিন্তু এই দিবসে অনেক গালভরা কথা বলেন তখনও নারী দিবস হাস্যকর হয়ে ওঠে।
যে দেশের মন্ত্রিসভায় পুরুষের চাহিদার কারণে দামড়া দামড়া রাজনীতিবিদদের সমর্থনে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ তে নামিয়ে আনার ব্যাপারে আলোচনা চলে, যেদেশে ৯০ শতাংশ বিবাহিত মেয়ে স্বামীর হাতে মার খায়, প্রতিবছর হাজার দশেকেরও বেশি নারী ধর্ষিত হয়, প্রতিদিন খবরের কাগজে ছাপা হয়েও বাতাসে মিলিয়ে যায় অসংখ্য লাঞ্ছিত, নিগৃহিত, ধর্ষিত, আক্রান্ত, নিহত নারী-কন্যার কাহিনী, সে দেশে নারীর নামে বিশেষ দিবস পালন হাস্যকর নয়কি!
মজুরি বৈষম্য কিংবা কাজের অমানবিক পরিবেশের অবস্থারও তো এখনো পরিবর্তন হয়নি, যার জন্য দু’শ বছর আগে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল সুতা শ্রমিকরা। দুশো বছরে আকাশ সমান পরিবর্তন এসেছে পৃথিবীতে, শুধু নারীর জীবনের পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা অর্থনীতিকে সচল রাখলেও তাদের জীবন কিন্তু অচল। সেখানে সুখ নেই, শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই। তাদের ঘামে অর্জিত অর্থনীতির সুফল দেখা যায় রাজধানীতে বিএমডব্লিউ এর সংখ্যাবৃদ্ধিতে, বা ঘন ঘন থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় ঘুরতে যাওয়া ব্যবসায়ীদের জীবনে।
এখনো মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর ঘর করতে যায়। শ্বশুরবাড়ি। সেই বাড়ির মালিক শ্বশুর, তার অবর্তমানে স্বামী। মেয়ের নিজের কোনো বাড়িও নেই, কামরাও নেই।
এখনো কন্যা সন্তানকে জন্ম দিতে চান না কোনো কোনো মানুষ, পরিবার, সমাজ। মেয়ে হবে জানলে ভ্রুণ হত্যা করছেন। আর যারা অতটা নিষ্ঠুর নন, তারা কন্যা সন্তান জন্মে বাধা দেন না বটে, কিন্তু অনেকেই কন্যা সন্তান জন্মে ঝিমিয়ে পড়েন। যারা কন্যাজন্মকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেন এবং আহ্লাদিত হন, তারাও কন্যাকে পুত্রের তুলনায় কম সুযোগ, কম পুষ্টি, কম শিক্ষা দিয়ে পালন করেন।
যারা ছেলের মত সমান সুযোগ দিয়ে মেয়েকে বড় করেন, তারাও সহজে মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ারিং বা এগ্রিকালচার পড়াতে পাঠান না, মাউন্টেনিয়ারিং শিখতে পাঠান না, নাটক করলে ভয় পান, রাজনীতি করলে শিউরে ওঠেন, প্রতিবাদ করলে ধমকে উঠেন।
যারা এসবও মেনে নিয়ে মেয়ে যা করতে চায় করতে দেন, তারা মেয়ের ক্যারিয়ার ও বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টিকে গুরুত্ব দেন।
একই রকম পড়াশোনা করে, একই রকম চাকরি করে বর-বউয়ের যখন দু জায়গায় পোস্টিং হয়, একজনকে চাকরি ছাড়তে হলে ছাড়বে কে? অবশ্যই মেয়েটি। ধরুন চাকরি ছাড়লো না কেউই, দুজনে দু জায়গায় থাকলো, সপ্তাহে, মাসে একবার দেখা হলো, দুজনেরই মনে কষ্ট, সন্তান হলে একজনকে মিস করবে, সেক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধব, সমাজ, বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি এই পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবে? মেয়েটিকে। কার মনে অপরাধবোধ জাগবে? মেয়েটির।
দুজনে একই জায়গায় চাকরি পেল, চাকরি শেষে সংসার কে সামলাবে? মেয়েটি। না সামলাতে পারলে দোষ কার? মেয়েটির।
চাকরি ক্ষেত্রে কোনো পুরুষ যদি মেয়ের সাথে ফষ্টি নষ্টি করতে চায়, কেউ যদি যৌনহেনস্থার অভিযোগ করে, তাহলে পুরো অফিস কার বিরুদ্ধে যাবে? কাকে চরিত্রহীন বলবে? মেয়েটিকে।
বিয়েটা ভেঙে গেলে দোষ কার? মেয়েটির। আবার বিয়ে করাই যায়, কিন্তু পুনর্বিবাহের সম্ভাবনা কার বেশি? পুরুষের।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ না অপারেশন? প্রয়োগ স্ত্রীর শরীরে না স্বামী? সিদ্ধান্ত নেবেন স্বামী, মেনে নেবেন স্ত্রী। গর্ভপাত বা বন্ধ্যাকরণ করা হবে কিনা সিদ্ধান্ত স্বামীর, শরীর স্ত্রীর। গর্ভধারণ এবং সন্তান লালন পালনে যাবতীয় ঝক্কি সহ্য করবেন মা, কিন্তু সন্তানের অবিভাকত্ত্ব কার? বাবার।
আজকে টিভিতে প্রধানমন্ত্রীকে দেখাবে, নারী দিবসের ভাষণ দেবেন, দেশে নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র তুলে ধরবেন, আমি সোফায় বসে নারী নীতি বইয়ের শেষ পাতাটা খুলে থাকবো যেখানে লেখা আছে ‘কোরান ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক কোনো নীতি বাস্তবায়ত হবে না।‘
নারীর ক্ষমতায়নের কথা শুনে আমি বিদ্রুপ করবো, আরো বহু নারী বিদ্রুপ করবে।
এইসব নারী দিবসে কিসসু আর হবে না। ক্ষমতাহীনদের বর্ষপূর্তিতে বিশেষ কী আর থাকতে পারে? লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় সমাজের ঘুণে ধরা আস্তরনে আসলে বিরাট কোনো ঝটকা দরকার।
সর্বশেষ ঝটকাটা এসেছিল সেই সত্তর দশকে। কেট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিক্স ও তার কিছু আগে বেটি ফ্রাইডেনের ফেমিনাইন মিস্টিক প্রকাশের পর নারী আন্দোলনে নতুন জোয়ার আসে। তারপর কেমন চুপসে গেছে। পুরুষতন্ত্র যেন ব্যাকটেরিয়ার মতো মানিয়ে নিয়েছে না্রীর প্রতিবাদের সাথে।
কোথায় কোথায় প্রয়োজন পুননির্মাণ? কোথায় নয়?
সাহিত্যের পাতায় পাতায় চোখে পড়ে লিঙ্গ বৈষম্য। ধর্মের বইয়ের পরতে পরতে নারী বিদ্বেষ।বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী হয়, বোন বা বউয়ের জন্য কোনো আলাদা পার্বন হয় না। মেয়েরা শিবের মতোন স্বামী কামনায় শিবলিঙ্গে দুধ ঢালে, শিবরাত্রির উপোস করে। এছাড়াও স্বামী ও পুত্রের কল্যাণে বছরব্যাপী নানা উপোস-ব্রত তো লেগেই আছে। সেইখানে এরকম সমঅধিকারের দাবিতে দিবস পালন হাস্যকরই বটে!
পিতৃতন্ত্রের এক মোক্ষম প্রতীক সিঁদুর। কৌম আদিম সমাজে পুরুষ যখন কোনো নারীর দখল নিতো, ওই নারী তার সম্পত্তি এ কথা জানান দেয়ার জন্য শকুনের ডানার পালক দিয়ে সিঁথি চিরে মেয়েটিকে রক্তচিহ্নিত করে রাখতো। উপজাতি অনুসারে নখ বা অস্ত্র দিয়েও সিঁথি চেরা হত। এটা সম্পূর্ণভাবে মালিকানার চিহ্ন, যেভাবে গরুর গলায় পুতি বা ঘন্টা বেঁধে দেয়া হয়। যেন হারিয়ে না যায়।
কালক্রমে এই প্রথাই বাংগালি হিন্দু সংস্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে এবং একুশ শতকের নারীকেও পুরুষের মালিকানাধীন করে রেখেছে।
ধর্মের নামে বহু বিয়ে চালু আছে, নারীর সতীত্ব নিয়েও টানাহেঁচড়া বন্ধ হয়নি।
আদমের জন্ম আগে, হাওয়ার পরে
পুরুষের শরীর থেকে নারীর জন্ম
পুরুষের প্রয়োজনে নারীর সৃষ্টি
ঈশ্বরের মহিমার প্রতীক পুরুষ, পুরুষের মহিমার প্রতীক নারী
ঈভ ছলনাময়ী ও পতিত
গির্জা যেমন যীশুর প্রতি দায়বদ্ধ, নারীরা তেমনি পুরুষের প্রতি
ধর্মের এইসব নারীবিরোধী বক্তব্য এখনো মনে প্রাণে লালন করে সমাজ।…………
এসব আক্ষেপ, হতাশা, প্রতিবাদের কথা আর ভাল লাগে না। আসলেই সময় এসেছে একটা ঝটকা দেবার! বড়সড়!
শাজাহান খানের ওই কথার পরও সেই অনুষ্ঠানে বিনা প্রতিবাদে তার হাত থেকে হাসি হাসি মুখে “সম্মাননা” নিতে আমাদের গুণী নারীদের বাধেনি। এবং “মন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মাননা নিয়েছি”-র গর্বে সেসব ছবি শেয়ার করতে তারা ব্যস্ত। কী হবে এইসব দিবস দিয়ে!
কোরান সুন্নাহর বিরুদ্ধে নারী নীতিমালা বাস্তবায়ন যদি সরকার করতে পারত তবে বড়সড় ধাক্কা দেওয়া হয়ে যেত, এর চে ভালোরকম ধাক্কা দেওয়া তো আর হয় না। মৌলভীদের উপেক্ষা করে এই কাজটা যদি শেখ হাসিনা আপা না করে তবে আর কে করতে পারবে!