‘ও পাখি, নারী হইলো জহরত, বুঝলা?’

এই গোবরে শালিক, তুমি কি নারী পাখি নাকি পুরুষ পাখি? 

– কেন বলেন তো ভাইজান, হঠাৎ এই প্রশ্ন
– না আজকে নারী দিবস কিনা, তুমি নারী পাখি হলে…
– ও আজকে কি নারী দিবস নাকি?
– হ্যাঁ, তোমরা পাখিরা আসলেই বোকা, এইটুকু খবরও রাখো না
Imtiaz Mahmood– ও, আপনি যেন কত বুদ্ধিমান, বলেন তো গরু দিবস কবে?
– ধুর, গরু দিবস আছে নাকি আবার?
– বলেন তো পক্ষী দিবস কবে?
– কি বল এইসব?
– জি ভাইজান, পাখির জন্যেও দিবস আছে, গরুর জন্যেও দিবস আছে।
– লে বাবা, এইসব তো জানতাম না।
– জি, নারী দিবসের মতোই
– কি বল এইসব, কোথায় নারী আর কোথায় গরু আর পাখি
– ভাব ধইরেন না, নারীকে যেভাবে ট্রিট করেন তাতে…
– না না না, এইটা তুমি ঠিক বললা না, নারী হচ্ছে…
– কি? নারী হচ্ছে কি?
– নারী হচ্ছে আমাদের কাছে মহামূল্যবান জহরতের মত
– হে হে হে, ভালোই বলছেন
– হাসির কি আছে, ভুল কি বললাম
– না, হাসির আর কি আছে, নারী হইলো জহরত আর আপনে তার মালিক, নাকি?
– না, মানে সেটা না, মহা মূল্যবান বুঝাইতে আরকি
– ক্যান, নারীকে মানুষ বলতে শরম লাগে? নাকি ভয় পান?

ইমতিয়াজ মাহমুদ: না, শুভেচ্ছা দিলাম। নারী দিবসের শুভেচ্ছা সকল নারীকে। আপন পর সবাইকে। যে নারী হিজাব পরে নারী জন্মের লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখেন তাকেও। যে নারী মন্ত্রীটি পুরুষের চেয়েও পুরুষবাদী কণ্ঠে নারীকে বলে, ‘ও মেয়ে তুমি হরিণের মত, তোমার মাংসই তোমার শত্রু’ শরীরের মাংস ঢেকে রাখ’ সেই মন্ত্রীটিকেও নারী দিবসের শুভেচ্ছা দিই। কেননা এই যে হিজাব পরেছে যে মেয়েটি আর এই মন্ত্রীটি ওদের মধ্যে ওদের নারী দেহকে কেবলই মাংস ভাবার যে ভাবনা, সেটা তো আমরাই শিখিয়েছি। শিখিয়েছি হাজার বছর ধরে। সেই ভুল শিক্ষার অন্ধকার থেকে ওরা বের হতে পারেনি, সে ওদের অক্ষমতা হতে পারে দোষ নয়।

দোষ আমাদের। আমার পুরুষ বন্ধুরা, নতমস্তকে এই কথাটা যদি স্বীকার করতে পারেন যে নারীকে মানুষ থেকে মেয়েমানুষ করে রাখার এই কুকর্মটি আমরাই করেছি, তাইলেই আপনি ভাই প্রকৃত পুরুষ। আপনি যেদিন বুঝতে পারবেন যে নারীকে মানুষ না ভেবে ঊন-মানুষ বানিয়ে রেখে আমরা আমাদের নিজেদের জন্যেই বড় ক্ষতি করেছি, সেদিন আপনি প্রকৃত মানুষ হবেন। এর আগে, যতদিন না আপনি এটা স্বীকার করতে পারবেন, আপনি প্রকৃত মানুষ হতে পারলেন না। যে পুরুষ এখনো নারীকে কেবল মেয়েছেলে বলে ভাবে, মাফ করবেন, আপনি অর্ধবিকশিত মানুষ।

আমরা কি না বানিয়েছি। আইন বানিয়েছি, ধর্ম বানিয়েছি, সাহিত্য করেছি আর এই সবের মাঝে নারীকে বলেছি, তুমি সম্পূর্ণ মানুষ না। নারীকে আদর করেছি, গদগদ গলায় বলেছি, তুমি আমার শস্য ক্ষেত্র, তুমি আমার হীরা জহরত তুমি আমার খেলনা পুতুল, তুমি আমার ভোগের রসগোল্লা। কখনো আমরা নারীকে বলিনি তুমি আর আমি আমরা সকলেই মানুষ, সমান মানুষ।

(২)
হিজাব নিয়ে বলছি বলে রাগ করবেন না। হিজাব পরা আপনার অধিকার- এই তর্ক আমি জানি। আপনার অধিকার আছে নিজেকে আড়াল করার, নিজের কেশ ঢেকে রাখার। আপনার শরীরের মালিক আপনি, সুতরাং শরীরের কোন অংশটুকু ঢেকে রাখবেন আর কোন অংশটুকু ঢাকবেন না সে আপনার ইচ্ছা, আপনার অধিকার। সেখানে আমার দ্বিমত নাই। একই যুক্তিতে আপনাকেও মানতে হবে হিজাব না পরাও একটি মেয়ের নিজের পছন্দের ব্যাপার। সে ইচ্ছা হলে পরবে আর ইচ্ছা না হলে পরবে না।

এবং মনে রাখবেন আপনি হিজাব পরেছেন বলে আপনি একজন অ-হিজাবি নারীর চেয়ে বেশী মডেস্ট হয়ে গেলেন না। যে মেয়েটি হিজাব ছাড়া শাড়ী পরে, বা হাওয়ায় চুল উড়িয়ে অফিসে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যায়, বা কাঁধ বা পা উম্মুক্ত রেখে পোশাক পরে অফিস আদালতে যায় সে আপনার চেয়ে কম মডেস্ট না। মডেস্টি আপনার মনে, আপনার পোশাকে নয়। আর আপনার শালীনতার স্ট্যান্ডার্ড আরেকজনের স্ট্যান্ডার্ডের সাথে মিলবে কেন?

অবশ্য কথাটা নারীকে না বলে পুরুষকেই বলা দরকার বেশী। একটি মেয়ে পা দেখিয়ে বা কাঁধ দেখিয়ে পোশাক পরেছে বলে ভাবেন না তাকে বিনা সম্মতিতে স্পর্শ করায় দোষ নাই। এইরকম ভাবনা কেবল আপনার অসুস্থ মনের রোগের লক্ষণ মাত্র। পুরুষকেই শেখানো দরকার, যে মেয়েটা মিনি স্কার্ট পরেছে সে আপনাকে অনুমতি দিচ্ছে না। মায়েদেরকেও বলি, আপনার পুত্রকে শেখান, যে নারীর পোশাকে স্তনের আভাস দেখলেই সেখানে খাবলা দেওয়ার অধিকার জন্মায় না।

আমার কথা যদি বলি, বেশিরভাগ হিজাবি নারীর সাথে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে। কাজের ক্ষেত্রে একটা মেয়ে যদি ইয়া বড় একটা ন্যাকড়া পেঁচিয়ে মাথা মুখ ঢেকে এসে আমার সামনে এসে বসে আমার মনে বেশিরভাগ সময়ই প্রথম যে চিন্তাটা আসে সেটা হচ্ছে, ‘এই মেয়ে নিজেকে একটা রসগোল্লাভাবে আর আমাকে একটা মাছি’।

(৩)
নারী দিবসে এরকম ঝগড়াঝাটি টাইপ কথা বলা ঠিক না। শুভেচ্ছার মধ্যেই সীমিত রাখা উচিৎ। কিন্তু কী করবেন বলেন। মেজাজ ঠিক রাখা তো কঠিন। চারিদিকে সব ইতর ধরনের লোক গিজগিজ করে। মহা বিজ্ঞের মত ভাব ধরে বসে আছে। জজ হয়ে বসে আছে, উকিল, মন্ত্রী, প্রফেসর, সম্পাদক কি নাই। সব। সাফ সুতরা কাপড়ের ভিতর একেকটা পুরুষবাদী নোংরা শুকর। কিন্তু মুখে মন ভাব ধরে যেন কি লিবারেল শিক্ষিত আধুনিক!

এমন বিজ্ঞের মত গলা করে কথা বলবে, শুনে আপনার বেশ লাগবে। দুই চার মিনিট কথা শুনতে ইচ্ছা করবে। যেই না আপনি নারী আর নারী অধিকার প্রশ্ন তুলবেন, তখন বের হয় আসল চেহারা। আর যদি কোনভাবে তসলিমা নাসরিন বা অন্য কোন নারীবাদী ধরনের কারো কথা তুলবেন, তাইলে দেখবেন কিভাবে সব ঝাঁপিয়ে পরে।

দুই তিনদিন আগে কথা। তসলিমা নাসরিন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। তো প্রধানমন্ত্রীকে যদি তসলিমা নাসরিন নিন্দা করে থাকেন, তাইলে আপনার খারাপ লাগতে পারে, আপনি উল্টা তসলিমা নাসরিনকে দুই কথা শুনিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু কী কথা শোনাবেন? আপনি কি তসলিমা নাসরিনকে অকথ্য গালিগালাজ দেওয়া শুরু করবেন? এইসব গালিগালাজ দেওয়ার সময় আপনার মাথায় কি এই কথাটা একবারও আসে না যে এইসব গালিগালাজে তসলিমার কিছু হোক বা না হোক, আপনি তো নিজে ল্যাংটা হয়ে যাচ্ছেন!

এমনিতে খুব ভাব ধরবে যে ‘আমি ধর্ম মানি, নারীকে সম্মান করি’ ইত্যাদি। মুখ থেকে যখন গালিটা বের হয় তখন তো দেখি নারীর প্রতি সম্মানের ছিটেফোঁটাও নাই। আসিফ মহিউদ্দিনের ওয়ালে গিয়ে দেখবেন গালাগালি কাকে বলে। এইসব গালি কিন্তু কোনটাই আসিফকে দেওয়া হচ্ছে না, দেওয়া হয় আসিফের মা বোন এদেরকে। এই আপনার নারীর প্রতি সম্মান? অপরের মা বোন তুলে গালি দেওয়া নারীর প্রতি এটা কি ধরনের সম্মান?

(৪)
আফসোস, আজকে এই দুই হাজার ষোলতে এসেও আমাদেরকে এইসব দেখতে হচ্ছে। আমি বড় বড় পাকা পাকা সব দুঁদে উকিলদের সাথেও কথা বলে দেখেছি। পেশাগত কারণেই এনাদের সাথে বাৎচিত হয়। এমনিতে মানুষের অধিকার, লিবার্টি, সাম্য সবকিছুই বেশ বুঝেন। যেই না আপনি পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর সমান উত্তরাধিকারের কথা বলবেন, তখনই দেখবেন সব জ্ঞান প্রজ্ঞা কোথায় উড়ে যায়। যে না আপনি হিন্দু নারীর বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারের কথা বলবেন দেখবেন বাঘা প্রগতিশীল চেহারাও উল্টা দিকে ঘুরে যায়।

প্রতিটা পুরুষের ভিতরেই একেকটা পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র বাস করে। হয়তো আমার ভিতরেও আছে, হয়তো নিজের কথা নিজের আচরণ নিজে টের পাই না। হাজার বছরের সংস্কার যাবে কই? যেভাবে আমাদের মনোজগতে বাসা বেঁধে আছে, বের হয়ে আসাও কঠিন। আর আমি তো পুরুষ, নারীদের মধ্যেও দেখবেন যতোসব নারীবিদ্বেষী ধারণা।

এই আজকে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে আমাদের সরকার প্রধান রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে নানান জন নানারকম বাণী দিতে থাকবেন, বক্তৃতা দিবেন, খবরের কাগজে লেখা পাঠাবেন আর টকশোতে গিয়ে গলা ফাটাবেন, এদের কথাবার্তা যদি শোনেন তাইলে দেখবেন এনাদের বেশিরভাগই এমনকি নারী দিবসেই নারীবিদ্বেষী বক্তৃতা চালিয়ে দেবে। আর বেওকুফ কিছু নারীও এগুলি শুনে হাততালি দিবে।

আর নারীর প্রতি পুঁজির আচরণ? পুঁজির কাছে নারী হচ্ছে নেহায়েতই একটি পণ্য মাত্র। পুঁজি নারীর কেনাবেচা করে।

(৫)
নারী দিবসে সকল নারীকে শুভেচ্ছা তো দিয়েইছি। আবারও দিচ্ছি। নারীর প্রতি সালাম জানাচ্ছি। সেই সাথে জোর হাতে এই কথাটাও বলি, আমরা পুরুষরা আপনাদের জন্যে যে অসহায় দুখিনী দুর্বল ভঙ্গুর নারীর চরিত্রটিকে নির্ধারণ করে দিয়েছি, সেই চরিত্র থেকে বের হয়ে আসেন। হাইহিল খুলে মাটির উপর শক্ত করে পা রেখে দাঁড়ান। মাটির দিকে তাকিয়ে না থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে ঘাড়টা তেরচা করে পৃথিবীর দিকে তাকান। চোখের নজর আনত না রেখে সোজা আমাদের চোখে চোখ রেখে নিজের অধিকারের কথা বলুন।

পুরুষের জন্য আর কতদিন নিজেকে তৈরি করবেন? ইভ এন্সলার একটা কথা বলেছিল, “Stop fixing your bodies, and start fixing the world!”

নিজের স্বার্থেই বলছি, ইটস এবাউট টাইম, জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা। আমি তো ভাই জেনে গেছি, নারী মুক্তি আর মানুষের মুক্তি এক সূত্রে গাঁথা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.