সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: আচ্ছা ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কোন বিশিষ্টতা আছে কী? আগেকার নারী দিবসের সাথে এর গুরুত্ব কী আলাদা? সম্ভবত না। নারীসুরক্ষার দাবি আগের মতোই আছে, রাষ্ট্র নড়ছে কতটুকু সেটা বরাবরের মতোই এক প্রশ্ন।
আসলে এক যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যুদ্ধ অসাম্য দূর করার যুদ্ধ। নারীহিংসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যে যুদ্ধ শুধু প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে নয়, তাদের সাথেও যারা প্রগতির কথা বলে আমাদের আশা পাশে বিচরণ করে, সেমিনার করে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আমাদের নসিহত করে। রাষ্ট্র ও সমাজ যদি নারীর প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত না করতে পারে, তবে এই যুদ্ধ এমনভাবেই চলবে আগামী অনেক বছর, অনেক যুগ ধরে। নারী নীতি নিয়ে দুর্বল অবস্থানে থাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকার, যখন বাল্য বিবাহ বন্ধ করার কথা বলে ১৬ বছর বয়সকেই বিয়ের বয়স বলে জেদ ধরা হয় তখন বুঝতে হয় চিন্তার জগতে দৈন্যতা আছে, আছে সাহসের বড় অভাব, সুস্পষ্ট অঙ্গিকারের অভাব।
বস্তুত নারীর প্রতি সহিংসতার প্রশ্নে আমরা এখটা খণ্ডিত ভাবনার জগতে বাস করি। তবে আশার কথা এই যে নারীসুরক্ষার নানা দিক বিভিন্ন স্তরে উঠে আসছে, সাধারণ হিংসাত্মক কার্যকলাপের বাইরে গিয়ে দাম্পত্য ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ-তদন্তের প্রকার নিয়েও খোলামেলা কথা বলার পাশাপাশি নারীর যৌনসুরক্ষার ব্যবস্থা কতটা জরুরি ও আবশ্যিক, তাও উঠে আসছে স্তরে স্তরে।
কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা হ্রাস পেতে শুরু করেছে তা নয়। আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি নারী গৃহ-সন্ত্রাসের জন্য মাসে গড়পড়তা পাঁচ ডলার করে ক্ষতি হয়। অঙ্কটা অনেক মহিলারই আয়ের প্রায় পাঁচ শতাংশ। যে সব পরিবার মহিলাদের আয়েই চলে, তাদের গায়ে এই ক্ষতির আঁচটা আরও বেশি।
এই যে আর্থিক ক্ষতি তা কিন্তু পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে না, জনগোষ্ঠীর বাকি লোকজনদেরও তার ফল ভোগ করতে হয়। কারণ আইনি কাজকর্মের ব্যয় বেড়ে যায়, চিকিৎসার খরচ, নিরাপত্তার খরচও ঊর্ধ্বমুখী হয়। পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই এই অপরাধ থেকে নিস্তার নেই। আমেরিকায়, ২০০৩-এ সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল-এর একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হিংসাত্মক আচরণের দরুন ক্ষতির ব্যয়ভার বছরে পাঁচশো আশি কোটি ডলারের বেশি। তার মধ্যে চারশো দশ কোটি ডলার যায় সরাসরি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের খাতে, আর কর্মক্ষমতা হ্রাসের জন্য ক্ষতির মাত্রা একশো আশি কোটি ডলার।
হিংসাত্মক আচরণ যখন মেয়েদের অকর্মণ্য করে রাখছে আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জনগোষ্ঠীকে টানছে অবনমনের দিকে, তখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের যুক্ত করলে কিন্তু জাতীয় আয় এবং ব্যক্তিগত আয় লক্ষণীয় ভাবে বাড়ছে। সমীক্ষা বলছে অর্থনৈতিক কাজকর্মে মেয়েদের সফল ভাবে জুড়ে দিতে পারলে, সংশ্লিষ্ট নানা বাধাবিপত্তি দূর করলে মাথাপিছু আয় অনেক বেড়ে যায়। আয়বৃদ্ধি মানে আরও একটু ভাল খাওয়াদাওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো, আরও কিছুটা বেশি কেনাকাটা, ফলে স্থানীয় উৎপাদক বা ব্যবসায়ীদের লাভ, এই ভাবে চক্রাকারে একটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গল্প।
প্রতি বছর, ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস পালিত হয়। আছে আরো নানাবিধ দিবস। এসব দিবসে আমরা লিঙ্গ-চিহ্নিত হিংসার বিরুদ্ধে নানা রকম কর্মসূচি পালন করি। আমরা এই জাতীয় হিংসার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার শপথ নিই, বিশ্বজুড়ে নারীরা, ছোট মেয়েরা যাতে এই সংকটের শিকার না হয়, তাদের নিরাপত্তা যাতে আরও সুনিশ্চিত করা যায়, সেই মর্মে অঙ্গীকার করি। এ্ই প্রচেষ্টা শুধুমাত্র নারীর নয়। প্রতিটি নাগরিকের। এই কাজে প্রত্যেকের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। শুধু নারী কেন, বালক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, জননেতা বা ধর্মীয় নেতা, যুবক-যুবতী এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের জনতার অংশগ্রহণ ছাড়া মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া এই হিংসাকে প্রতিরোধ করা যাবে না।
বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে এই অত্যাচার ঘটতে পারে, যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটতে পারে, কারণ সেখানে ‘ধর্ষণ’ রীতিমত একটি অস্ত্র, ঘটতে পারে সেই সব জায়গায় যেখানে শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে মেয়েরা লাঞ্ছিত, সামাজিক অবমাননার শিকার হয়।
কর্পোরেট কিংবার নাগরিক সমাজ যখন নানা আয়োজনে কথা বলছে এই দিবস নিয়ে, তখনো জানা গেলো রাজধানীর কাফরুলে গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণের পর ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দরিদ্র পরিবারটি পুলিশের কাছে গেলে, থানা মামলাও নেয়নি, কারন গৃহকর্তা সরকারি কর্মকর্তা।
তাই সব আয়োজনের একটিই দাবি চক্রাকারে চলতে থাকা এ জাতীয় হিংসার অবসান হোক। পার্পেল রং-এ, ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপনের প্রচারে যখন বড় শহরের রাজপথ মুখরিত তখনো অজস্র মেয়ে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, অসংখ্য কিশোরী বাল্যবিবাহে বাধ্য। লিঙ্গ-বৈষম্যনির্ভর হিংসায় চিরজীবনের মতো স্তব্ধ কিংবা বিকৃত বিকল হয়ে গেছে বহু জীবন। ধর্ষণের শিকার হয়ে যে মেয়েটি মারা যায়, কিংবা প্রায় মৃত হয়ে ঘরে ফিরে, তার বাবা-মা যে কী যন্ত্রণা পায়, আমরা কি তা কল্পনা করতে পারি? এমন কষ্ট আজ স্থানে স্থানে, ঘরে ঘরে।
আমাদের রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক পর্যায়ে নেতৃত্বেও আছেন নারীরা। কিন্তু জাতি হিসেবে নারীদের অভিজ্ঞতা, ভাবনা এবং অন্তর্দৃষ্টির সাহায্য নিতে চাইনা। যদি করতে পারতাম হয়তো সমাজে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতো।
অসাম্য সমস্ত কোণে আমাদের অগ্রগতিকে থমকে দিচ্ছে। নারী দিবসে পুরুষের অঙ্গীকার হোক তার অবসান তারা করবে। এই শপথ আমাদের যে আমাদের কন্যারা নির্ভয়ে পথ হেঁটে হেঁটে, সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে পারে, আমাদের বোনেরা তাদের বিপুল সম্ভাবনা পূরণ করতে পারে এবং প্রতিটি নারী ও বালিকা তার মধ্যে নিহিত শক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন