‘ভালোমেয়ে’ এক অলীক ধারণা মাত্র

কাবেরী গায়েন: আমার দিদিমা, মানে যাকে আমরা দিদিমা বলে জানি, অনেক গুণীমানুষ ছিলেন। খুব ছোটবেলায় তাঁর বিয়ে হয়েছিলো বান্ধবীর বাবার সাথে। বান্ধবীর বাবা তখন বেশ টাকাওয়ালা মানুষ। ততোদিনে তাঁর ছয় সন্তান মারা গেছে। এগারো বছরের এই দিদিমাকে তিনি যখন বিয়ে করেন, তাঁর বয়স তখন নাহলেও ত্রিশের উপরে। আমার যিনি প্রকৃত দিদিমা, তিনি তাঁর সন্তা্নদের একের পর এক হারিয়ে তখন দিশেহারা। অসুস্থ।

আমার মায়ের বয়স যখন এক বছর, তখন, দিদিমা মারা যান। মারা যাবার আগে তাঁর কিশোরী সতীনকে দিয়ে যান এই মেয়েকে। তিনিই মাকে মানুষ করেছেন। আমরা বড় হবার বহু বছর পরে দিদিমা আমাদের মায়ের নিজের মা নন শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তো এই দিদিমা লীলাবতী রায়ের গুণের কথা লিখে কিছুই প্রকাশ করা যাবে না।

Kaberi Gayenঅত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ। তাঁর রান্না শিল্পের চেয়ে কিছু কম ছিলো না। ঘর-সংসার আলো করে রেখেছেন। ধান সেদ্ধ করা, শুকানো, মালিদের দেখাশোনা, আত্মীয়-কুটুমদের দেখে রাখা, ঘর ঝকঝকে রাখা আর নিজেকে পরিপাটি রাখা। সেলাই করা। পুতুল বানানো মাটির। চুলায় পুড়িয়ে স্থায়ীত্ব দেয়া। তারপর তুলিতে নাক-মুখ-চোখ বসানো। শুধুই শখের বসে। অন্যের কাজ পছন্দ হতো না বলে কোনদিন নিজের কাপড় কাউকে কাচতে দেননি। চুলা লেপতে দেননি। পিঠা বানাতে দেননি। রান্নার দায়িত্ব দেননি। সতীনের মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে মানুষ করেছেন। এবং তাঁর চেহারা আশেপাশে তো বটেই, অতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী আমি দেখিনি আমার চারিপাশে।  

আমার দেখা প্রথম আমূল নাস্তিক। আছাড় খেয়েও কোনদিন ঠাকুরের সামনে বসেননি। এহেন সর্বগুণে গুণান্বিত নারীর সুনাম বেশিদিন টেকেনি। কারণ ষোল বছর হয়ে যাবার পরও যখন নিজে সন্তান জন্ম দিতে পারেননি, তখন দাদু ফের বিয়ে করেন আরেক জনকে। সেই সময়ে তাঁর নাম হয়ে যায় বাঁজা। সেই নতুন দিদিমা’র সন্তান না হলেও আমার এই দিদিমা এক মেয়ের জন্ম দেন। আমার একমাত্র মাসিমা। দাদু মারা যান দু’তিন বছরের মধ্যেই।

ঘোর পাকিস্তান আমলে সুন্দরী এক অল্পবয়সী বিধবা, অগাধ সম্পত্তি নিয়ে সংসারের হাল ধরেন। দুই মেয়ে নিয়ে। আমার মা-কে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হয় আর লাইব্রেরি থেকে বই এনে দেবার ব্যবস্থা করে দোতলায় জীবন কাটানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। স্নানও মা করতেন দোতলায় তোলা জল দিয়ে।

আমার মায়ের গলা না  কি কেউ কোনোদিন শোনেনি বিয়ের আগে। এই পর্যায়ে এসে শরিকদের কাছ থেকে মেয়েদের জীবন আর সম্পত্তি ঠিক রাখার জন্য সেই অতি গুণবতী, লক্ষীশ্রী দিদিমা সাদা শাড়ি পড়া এক ‘কঠিন মেয়েমানুষ’-এর আখ্যা পান। যিনি কোর্ট-কাচারিতে যান, পুরুষরা যাঁকে দেখলে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়, তাঁর অসম্ভব বুদ্ধির কাছে অন্যদের সম্পত্তি বাগানোর চেষ্টা ধরা পড়ে যায়। অতএব, তিনি আর ভালোমানুষ নন। অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিতে হয়। কিন্তু তিনি এক মেয়ের বাড়ি থেকে আরেক মেয়ের বাড়ি যান একা একা- নারিকেল, নাড়ু, বড়ইকোটা, চালের গুড়ি, পিঠা সব কুলির মাথায় চড়িয়ে।

কী জাঁহাবাজ মহিলা রে বাবা! তিনি লঞ্চ থেকে নেমেই মেয়ের বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকে যান মেয়েকে কয়েকদিনের জন্য রেহাই দিতে। তিনি যতদিন মেয়ের বাড়ি থাকেন, সেক’দিন জামাইরা মেয়েদের কিছু বলতে পারে না, নাতিদের বকা বা মার দিতে পারে না। সামনে সিগারেট খেতে পারে না। অথচ তিনি গলা উঁচিয়েও কথা বলেন না।

প্রায় সমবয়সী জামাইদের বাবা বলে ডাকেন। খুব মৃদুস্বরে কথা বলেন। আত্মীয়-স্বজনেরা তাঁর চরিত্র ব্যবচ্ছেদে বসেন কখনো কখনো। সাব্যস্ত হয় যে, তিনি খুব ভালো না। কারণ বিধবা হয়েও মাছ-মাংস খান, উপবাস করেন না, ভুলেও পূজা করেন না, কোন বার-তিথি মানেন না। তাবিজ-কবজ দেখতে পারেন না। ঠাকুর-ফকিরের শত হাত দূরে থাকেন। এবং তিনি কোন মেয়ের বাড়িতে থাকেন না। আসেন, দেখাশুনা করে ফের চলে যান, ‘আপন মাটি, দমায় হাঁটি’ বলে।

বাড়িতে তাঁর কতো কাজ! কতো মানুষ আসবে সাহায্য নিতে! কতো ধরণের সাহায্য! ‘কারো বুন্ডি’, কারো ‘মাইজাদ্দি’, কারো ‘জেঠিমা’। আপন মাটিতে তিনি সম্রাজ্ঞী। এই সম্রাজ্ঞী মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন কেউ ঘর থেকে বের হয় না, পালিয়ে থাকে- তিনি দালানেই রইলেন। একা। অন্য সবাইকে নিরাপদ আস্তানায় পাঠিয়ে। কোথায় তার জামাই-মেয়ে তাঁর খোঁজ নেবে, তা না তিনি জন-মানবহীন প্রান্তর পেরিয়ে ছুটে গেলেন একা, নাতি-নাতনীদের দেখার জন্য। আমার শোনা বর্ণনাটা অনেকটা এমন যে, আমাদের পরিবার যাত্রা করবে ভারতীয় শরণার্থী শিবিরের উদ্দেশ্যে।

তখন দেখা গেলো, মধুমতিতে অনেক দূর থেকে একটা নৌকা আসছে, একজন মাত্র যাত্রী নিয়ে। তাঁর নিজ হাতে ধোয়া সাদা ধবধবে শাড়ি জানিয়ে দেয়, এক লীলাবতী রায় ছাড়া এমন সাহস কোন একা পুরুষেরও নেই। দেখা করে, চিড়া-গুড়-নাড়ুর গাঠটি তুলে দিয়ে ফের তিনি নৌকায় ফিরে যান নিজ গন্তব্যে। কতো বয়স তখন? চল্লিশের কিছু বেশি হবে হয়তো!

আমার চেয়ে ছয় মাসের বড় মাসীমার মেয়ে ভিন ধর্মে বিয়ে করার পর যিনি একদিনও দেরি করেননি মেনে নিতে, তিনি এই মানুষটি। সেই দিদিমা, নিজে কোর্টে গিয়ে দুই মেয়ের জন্য সমানভাগে সম্পত্তি লিখে দিয়ে আসার পরে প্রায়ই বলতেন, এখন তো অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে।

না, তাঁকে বেশিদিন নির্ভর করতে হয়নি। দেমাগ দেখিয়ে তিনি চলে গেছেন সকল নির্ভরতার ওপারে। হিন্দুধর্মে নারীদের আজও সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হয়নি এদেশে। তাঁরা কেবল জীবন-সত্ত্ব পান। জীবনে যে পরিসরে মিশেছেন, কোনদিন ‘একখান চেয়ার’ পেতে অসুবিধা না হলেও, অন্দরমহলের আলোচনায়, জ্ঞাতি পুরুষদের ঠাট্টায়, নিকট আত্মীয়রা আর কিছু না পেলেও, তিনি যে ধর্ম-কর্ম করলেন না, তিনি যে ঠিক স্বাভাবিক মানুষ না, বিধবা হয়েও কোনদিন একাদশী-দ্বাদশী করলেন না, নিরামিষ খেলেন না সেইসব আলোচনা শেষে পরিতৃপ্ত হয়ে সেই রাতের মতো গল্প শেষ করতেন, ‘আরে, উনি তো মরবে না, দেইখো, সবার মৃত্যুর পর সেন উনি মরবে।  

না, তার গুণকে অস্বীকার করা না গেলেও, তাঁর আভিজাত্যকে উপেক্ষা করা না গেলেও, চরিত্রের কোন দোষ ধরা নয়া গেলেও তিনি যে ঠিক ভালো বউ ছিলেন বংশের, একথা কেউ বলেনি। সবাই তাঁর কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে, কেউ তাঁর বন্ধু ছিলো না। এবং তাঁর ভয়াবহ আরেক দোষ ছিলো, তিনি দিনমান নাটক-সিনেমা দেখতেন। দিদিমা আমাদের বাসায় বেড়াতে এলে আমাদের সিনেমা দেখতে যাওয়া অবধারিত ছিলো। টেলিভিশনের যুগে সব নাটক-সিনেমা দেখতেন। এ কি কম অন্যায়! হরিগুরুর নাম নেয়া নাই!!

দুই।

সেই যে দোতলায় জল তুলে স্নান করানো হতো এক মেয়েকে, যে মেয়ে সারাদিন বই পড়তো? সেই মেয়ে আমার মা। বিয়ের আগে তাঁর গলা কেউ কোনোদিন শোনেনি। তাঁর গায়ের রঙ ছিলো দুধে আলতায় মেশানো, চোখ সবুজ। দিদি জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে মা গেলেন বেড়াতে।

উনি কি কৃষ্ণার আপন মা? সেই একই প্রশ্ন শুনলাম আমি তার কুড়ি বছর পরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে ঢোকার পরে। ‘আল্লাহ! কাবেরীর আপন মা’? সত্যি বলতে কি, ছোটবেলায় এতো ফর্সা, সারাদিন কাজ করা, সবুজ চোখের মা’কে আমাদের কাছেই কখনো কখনো অপরিচিত মনে হতো। তাঁর নিজস্ব জগত ছিলো। বই-এর জগত। আর ধ্যানের জগত। নয় সন্তানের জন্ম দিয়ে, সৎ গরীব অফিসার স্বামীর ঘরে উদয়াস্ত খেটে, ছেলেমেয়েদের মানুষ করে, পড়িয়ে, স্বামীর অতিথিপরায়ণতার খেসারৎ দিয়েও যিনি ক্রমাগত বই পড়তে পারেন, তাকে খানিকটা নির্মোহ হতে হয়।

তাই অকারণ আড্ডা দেয়া, অন্যের সমালোচনার জন্য খানিক সময় দেয়া জাতীয় অতি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর অংশগ্রহণ সম্ভব ছিলো না। টেলিভিশন নাটক দেখতে বসে আমরা সমালোচনা করলে হয় আমাদের বলতেন উঠে যেতে, নয়তো নিজে উঠে যেতেন। তো এ জাতীয় মানুষদের তো বন্ধু না থাকলেও কোন নিন্দা থাকার কথা না। কিন্তু আমার মায়ের নিন্দা ছিলো।

দিদিমা বলতেন, ‘তোর মা তো খালি গাব্বা গাব্বা কথা কয়। কারণ কারো মন যুগিয়ে মিষ্টি কথা বলার মানুষ তিনি ছিলেন না। নারী আত্মীয়দের কাছে তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন, বলা যাবে না। কোনদিন স্বামীর নিন্দা করেননি কারো কাছে। সংসারের কারো কাছে কিছু চাওয়া-পাওয়ারও ছিলো না বোধহয়। তিনি ক্রমাগত করে যেতেন। এই পর্যায়ে বাবা বোধহয় একটু অনিশ্চিত বোধ করতেন। ফলে অতিথিরা এলে, বিশেষ করে তাঁর বাড়ির লোকজন এলে বাবা ভাবতেন, সম্ভবত, যে, মা তাঁর গ্রামের বাড়ির লোকজনদের নিশ্চয়ই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন। যা ছিলো অমূলক। বাবা খুব তটস্থ থাকতেন। তাছাড়া বই, গান, আর পূজার জগত তো আছেই। এই একটু ফাঁক বাবা কোনদিন মেনে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা হলেও খুব মাঝারি মানের স্বামী ছিলেন।

আমার মা’র বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ থাকতে পারে, এ অবিশ্বাস্য। কিন্তু আমার বাবার ছিলো। অজস্র অভিযোগ ছিলো। সবসময়েই একটা অসন্তোষ ছিলো যেনো। অথচ নিজের মেয়েদের ব্যাপারে এমন বাবা কোটিতে একটা মেলে কি না সন্দেহ। আমরাও মনে করতাম, বাবাই আমাদের কাছের।

এখন বুঝি, এই দেখাটা আমরা দেখতাম বাবার চোখে। মা সংসারে উদয়াস্ত খেটেও শুধু নিজের বই পড়ার জগতটাকে বাঁচাতে গিয়ে ভালো বউ হয়ে উঠতে পারেননি বাবার কাছে। কারো গল্পের সংগী হয়ে উঠতে পারেননি। বাবা ‘নাটক-নভেল’ পড়াটাকে খুব অপছন্দ করতেন। অথচ তাঁর ছোট মেয়ে যখন লিখতে শুরু করলো, তখন সজল চোখে পড়তে এবং প্রশংসা করতে শুরু করলেন, তাকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করলেন। অথচ মা-বাবার ভেতরে মা’র নিজস্ব জগত কেমন বাধা হয়েই থেকে গেলো।

তিন।

শুনলে অবাক লাগতে পারে, আমি ছোটবেলায় ভালো মেয়ে হতে চাইতাম। সেই আখ্যাও আমি পেয়েছিলাম। আমাদের বাসায় পড়াশুনায় একটু ভালো হলে, রেজাল্ট ভালো করলে, বই পড়লেই  যথেষ্ট আদর পাওয়া যেতো। আমি তাই খুব সহজেই ভালো মেয়ে হতে পেরেছিলাম। বড়দা অজস্র ছড়া আর কবিতার বই পাঠাতো ঢাকা থেকে। মা সেসব মুখস্ত করিয়ে রাখতেন। বড়দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।  

ছুটিতে বাসায় এলে, ঘরে ঢুকেই জামা-কাপড় না ছেড়ে আমাকে নিয়ে বসতেন। গোটা বিশেক কবিতা ঠিকঠাক শোনানোর পরে ছাড়া পেতাম। মানে বই-এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।  সাথে নতুন বই। অনেক পরে বুঝেছি, আমি যখন বড়দার ঘাড়ে চেপে কবিতা শোনাতাম, আমার দিদি তখন মা’কে রান্নাঘরে সাহায্য করতো। খুব অল্প বয়স থেকে দিদি মা’কে সাহায্য করতো ঘরের কাজে, অতিথি আপ্যায়ণে। ভালো মেয়ে। সেই দিদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে ঢোকার পর বাসায় তার ভালোত্বের ইমেজ খানিকটা মিইয়ে গিয়েছিলো। আমি আর আমার ছোটবোন অদিতি পাঁচ ভাই আর এক বোনের ছোট বলে আমাদের আদর ছিলো প্রচুর। ক্লাসে, বিতর্কে, রচনা লিখে কিছু পুরস্কার পেয়ে আমাদের আদর আরো বেড়েছিলো।

আমি সারা দুপুর রাজ্য ঘুরে সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতাম এবং একমাত্র দায়িত্ব হ্যারিকেনের চিমনি মোছার কাজ বা শীতের দিনে সন্ধ্যার আগে জানালা বন্ধ করার কাজ ঠিকঠাক করে ফেলতাম। খুব আদর করতাম ছোটবোনকে। ওর দাঁত ওঠার পরে আমার কাঁধে কামড়ে ফুলিয়ে দিলেও কোনদিন মারিনি বলে খুব সুনাম ছিলো।

আরো মেলা কারণে সুনাম ছিলো। কাপড় ময়লা হতো না। অতো ব্যক্তিত্ববান দিদিমা পর্যন্ত সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন যে আমার পাশে ঘুমালে মনেই হয় না কেউ ঘুমিয়ে আছে। জামাকাপড়ের বায়না ছিলো না।

কীভাবে যেনো বুঝেছিলাম, বাবা আত্মীয়বাড়ি বা বিয়েবাড়ি যাওয়া পছন্দ করেন না। আমি যেতাম না। বড় হবার আগেই ফুল হাতা আর কলার-ওয়ালা জামা পড়া শুরু করলাম। দিদির দেখাদেখি হাল্কা রঙের কাপড়। বিশাল সুতির ওড়না। পথেঘাটে ছেলেরা কী বলে না শুনে মাথা নীচু করে চলে যাই।

আমার বান্ধবীর বাবা, খুব ধার্মিক মানুষ। আমার বান্ধবীকে বলেন, কাবেরীর মধ্যে মুসলমান মেয়ের তরিকা আছে। দেখতো, ও তো শব্দ করে হাসে না!  সব মিলিয়ে আমি দারুণ ভাল মেয়ে। ইন্টারমেডিয়েটে পড়ার সময় আমাদের বাসা বরিশালে চৈতন্য স্কুলের বিপরীতে। তখন গান শিখতাম। যতক্ষণ রেওয়াজ করতাম, পাড়ার ছেলেরা ততোক্ষণ হা হা করে চিৎকার করতো। আমার ঘরে ক্রিকেটের বল ঢুকিয়ে দিতো। জানালা আটকে দিতাম। তখন জানালায় বল মারতো।এটা প্রত্যেক দিন হতো। চারপাশে ব্যালকনি দেয়া আমাদের দোতলা ঘর। শীতের দুপুরগুলোতে সেখানে রোদের সালতামামি। কিন্তু আমি কখনো সেখানে দাঁড়াতাম না। তবুও প্রতি সন্ধ্যায় ছেলেরা সুর করে বলতো, ‘কা-বে-রী, এ কা-বে-রী’। আশেপাশের বাড়ির আন্টিরা মা’র কাছে দুঃখ করতেন, আপনার মেয়েটা এতো ভালো, কী যে সহ্য করে! একটু বারান্দায়ও দাঁড়াতে পারে না। আমার সুনাম আরো ছড়ায়।

একদিন সেইসব ছেলেরা বাসায় এলো দলবেঁধে বাবার সাথে কথা বলতে। কী ব্যাপার? না, অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে না। কাবেরী খুব ভদ্র মেয়ে। অভিযোগ তাদের অদিতির বিরুদ্ধে। অদিতির বিরুদ্ধে? ও কী করেছে? এতো ছোট মেয়ে! ও না কি ওদের দেখলেই থু থু ফেলে রাস্তায়। ওর বিচার করতে হবে। হৈ চৈ শুরু করলো।

দাদারা তখন কেউ বাসায় থাকে না। বাবা তখন বিভাগীয় সমবায় কর্মকর্তা। বরিশাল নতুন বিভাগ হয়েছে। কিন্তু এইসব মাস্তানদের কাছে অসহায়। অদিতিকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে, এই অভিযোগ কি সত্যি? ও খুব সহজভাবে বললো, হ্যাঁ। ও তখন খুব নরম ভালো একটা মেয়ে। অসুস্থতা ছোবল দেয়নি। পৃথিবীর কোন বিরুপতা স্পর্শ করেনি। দারুণ গান করে, কবিতা লেখে। সবার আদরের।

দাদারা ছুটিতে বাড়ি ফিরলে কুস্তি লড়ে। জিজ্ঞেস করলাম, কেনো? ও বললো, তোমার সাথে যা করে প্রতিদিন, সেজন্য। হঠাৎ করে ওর কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হলো। ভালোমেয়ে আমি ‘বেয়াদব’ ছোট বোনটার কাছে খুব ঠুনকো হয়ে গেলাম। বাবা ওদের সাথে কিভাবে মিটিয়েছিলেন, মনে নেই। কিন্তু অদিতিকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, অদিতি ফের সহজভাবে কারণটা বললো। ও বোধহয় ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাবা খানিক চুপ করে থাকলেন। বললেন, এমন আর করো না। বাবা রুম থেকে চলে যাবার পরে, ও আমাকে ফিসফিস করে বললো, আমি ওদের দেখলেই থু থু ফেলবো। কেনো, আমার থু থু আসতে পারে না?

তবুও, ওই মহল্লায় যতোদিন ছিলাম, আমি ছিলাম ভালোমেয়ে নামে পরিচিত আর অদিতি ওই ছেলেদের কাছে বেয়াদব, খারাপ মেয়ে। সেই থেকে আমি জানতে শুরু করেছি, ‘ভালোমেয়ে’ আসলে এক অলীক অস্তিত্ব। নিজেকে অস্তিত্বহীন করেই কেবল ভালোমেয়ে হওয়া সম্ভব। জেনেছি আরো বহুভাবে। সে’সব কথা ফের বলা যাবে কোন একদিন বা বহুদিন।

শেয়ার করুন:

ছোট এই লেখাটি একটা এপিক যেনো বা। দিস্তা দিস্তা লিখেও এমন সত্যে পৌঁছানো যায় কি না সন্দেহ। লেখকের দেখার ভেতর যেমন নিস্পৃহ সত্য আছে, তেমন আছে টান টান গদ্যে শক্তিশালী সাহিত্যিকের প্রত্যয়-এক টানে সব নারীর ভালো মেয়েত্বের পেছনে ছুটে চলার নিষ্ফলতা সম্পর্কে অকপট বয়ান তিনি দিয়েছেন উপন্যাসের সাবলীলতায়। লেখকের প্রবন্ধে উপন্যাসের ইঙ্গিত স্পষ্ট। তিনি এ বিষয়েই উপন্যাস লিখবার কথা ভাবতে পারেন। উইমেন চ্যাপ্টারকে ধন্যবাদ কাবেরী গায়েন-এর এমন এক লেখা পাঠককে উপহার দেবার জন্য। বার বার তাঁর লেখা পড়তে চাই।

আপনার উপলব্ধি লিখাটির শীরোনামকে সমর্থন করে শতভাগ। সকল অন্যায়কে প্রতিবাদ হীন যেতে দেয়ার নাম “ভালো ” যা কেবল স্বপনঘোরের সম্পওি। বাস্তবেও তা হবে কখনো ভাবিনি। সেই বাস্তবতা নিয়ে আজ আমাদের বসবাস। এখানে ব্যক্তির অস্তিত্ব, সমস্টির অস্তিত্ব মূল্যহীন। অস্হিত্ব নিয়ে যে এগুবে সে হয় খারাপ নয় পাগল আখ্যা পাবে। সাহসী লিখা। লিখুন। হাল্কা হোন। লিখাটি হৃদয় গহীনে পৌঁছে দিলাম যেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। আমি আমার অস্তিত্ব নিয়েই সেখানে থাকি। ভালো থাকুন।