শিরোনামহীন-১

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: ‘একটা মেয়ে কেন চাইলে একা থাকতে পারে না? পরিবার, সমাজ কেন তাকে  নিজের মতো করে থাকতে দেয় না? নিজের জীবনে একবার না বুঝে আমি ভুল করেছি। কিন্তু কত জনের জীবন তো দেখলাম। আমার আর বিয়ে নামের সম্পর্কের প্রতি কোন আস্থা নেই। তবুও কেন আমাকে কেউ আমার মতো করে থাকতে দিতে চাচ্ছে না। আমাকে কেন বাধ্য করছে একটা আস্থাহীন সম্পর্কে জড়িয়ে দিতে?’— কাঁদতে কাঁদতে এভাবে প্রশ্নগুলো করে যাচ্ছিলো স্মিতা।

স্মিতার সবগুলো প্রশ্নের উত্তর আমার জানা। কিন্তু কোন জবাব দিচ্ছিলাম না। কারণ আমি জানি এই মেয়ে হয়ে নিজের মতো থাকতে চাওয়াটা কতখানি দুঃসাহসের! কতখানি যন্ত্রণার! এই যন্ত্ণা সবচেয়ে বেশিই আসে পরিবার থেকেই, আপনজনদের থেকে। আর সমাজের রক্তচক্ষুতো কখনই কোন নারীর একা থাকাকে স্বীকার করতে চায়ই না, একা নারীর পরিচয় যেন সমাজের জন্য সংকট। তাই তাকে বাধ্য করে কোন না কোন পুরুষের পরিচয়ের পতাকা তলে দাঁড় করিয়ে দিতে। সে পরিচয় যত্ই ভারী হোক, যতই ঘৃনার হোক, নারীকে তা বহন করতেই হয় সমাজের দাবীতে।

Lailiআমার মা-বাবাকে বাঁচাতে আমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিলাম। আমি বিশ্বাস করিনা বিয়ে করে আমি সুখি হতে পারব। তবুও আমি বিয়েতে রাজী হলাম। আমার বিয়ে না হলে নাকি তারা বাঁচবে না। মরে যাবে। তাদের মৃত্যুর দায় আমি নিতে চাই না।’- আবারো কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে স্মিতা।

আমি নিজেও দেড় যুগ একা থাকি সকল যন্ত্রণা নিয়ে। আমি নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ ভাবি।সামান্য যোগ্যতা ও সামর্থ্য নিয়ে নিজের জন্য, সন্তানদের জন্য শরীরের রক্ত-ঘাম একাকার করে রোজগার করি। পরিবারের কারো কাছে কোনদিন কোন সহায়তা চাইনি। এমনকি অসুস্থ হলে একা বিছানায় পড়ে থাকি। একা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পড়ে থাকি। দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য গেলেও একাই যাই। কারো সঙ্গ, সহযোগিতাও নেই না। তিনদিন না খেয়ে থাকলেও কেউ নাই এতোটুকু খোঁজ নেবার। এমনকি মা-বাবা, ভাই-বোন, কোন স্বজন দাবিদারও না।

আমার এই দীর্ঘ একা জীবনের সবচেয়ে বড় সংকট আমি একটি গ্যাংগ্রিন বহন করে চলছি। পচা সম্পর্কের গ্যাংগ্রিন। যে রোগের যন্ত্রণা আমাকে ঘুমেও শান্তি দেয় না, চেতনায় তো নয়ই। তবুও আমি কেটে বাদ দিতে পারিনি সেই গ্যাংগ্রিন। ভুগে চলেছি নিরন্তর। সন্তানদের নিরাপত্তার দাবির অজুহাতে একটা কাগুজে তালাকে যাওয়া হয়নি আমার তাদের বাবার সাথে। কিন্তু মনের মাঝে সেই সম্পর্কের পরিচয়ের যে পাহাড়সম ঘৃণা জমে গেছে ক্রমাগত, তা সামান্য কাগুজে তালাকের চেয়ে কোটি গুণ দূরত্বে ছুঁড়ে দিয়েছে আমাকে। কোনভাবেই সেই ঘৃণার পরিচয়-পতাকা বহন আমার জন্য মৃত্যুসম। এই মৃত্যু রোজ আসে নারকীয়তা নিয়ে আমার কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকে।

পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বিত করে। তাই সব সময় এড়িয়ে চলতে চাই। কারণ এমন কোন আয়োজনে গেলে আমার নিজের পরিচয়ে আর পূর্ণতা পায় না। আমার পাশে সেই ঘৃণিত গ্যাংগ্রিন সম্পর্কের পরিচয়টি যেন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে আমার পরিবারের লোকজনের কাছে। আপনজনরা যখন আমাকে সেই পরিচয়টিতে পরিচিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে, ঘৃণায় আমার গা গুলিয়ে আসে, বমি বমি লাগে, কানে আঙ্গুল চেপে ধরি শক্ত করে, দূরে সরে দাঁড়া্ই। যতটা সম্ভব দ্রুত সটকে পড়ি সেখান থেকে।  

কিন্ত আমাকে রেহাই দেয় না কেউই। দূরে থাকলেও একই যন্ত্রণা দিয়ে সুখী হয় আমার এই যন্ত্রণাদায়ী স্বজনরা। যে কথাগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় সেই শব্দকেই তীর বানিয়ে সবচেয়ে বেশি আমার বুকে বিদ্ধ করে আমার পরিবার ও স্বজন। কোন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাসায় কেউ বেড়াতে এলে ইচ্ছাকৃতভাবে তারা্ আমাকে প্রশ্ন করে সেই ব্যক্তিটির কুশল জানতে চায়। যার সাথে আমার শুধু ঘৃণার অনুভূতির সম্পর্কটি ছাড়া আর কিছু নেই।আমি যার কোন খোঁজও জানি না। ফোন করে করেও আমাকে একই ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে রোজ।

পারিবারিক কোন আয়োজনে তারা যেমন চায় আমি উপস্থিত থাকি, তেমনি তারা এটাও নিশ্চিত হতে চায় সেই মানুষটির উপস্থিতি যার ছায়াটাও আমাকে পোড়ায়। আমি অসহায় বোধ করি যন্ত্রণার তীব্রতায়। বাধ্য হই অসামাজিক হতে, দায়িত্বহীন হতে। খারাপ মানুষের তকমাটিকে আশির্বাদ হিসেবে নিয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখি। আপন পরিবার আমার আপন যন্ত্রনা হয়ে উঠে। আমার সাধ্য ছিল বলে আমার পাসপোর্টে, পরিচয় পত্রের কোথাও আমি সেই পচা গ্যাংগ্রীন রাখিনি। কিন্তু জীবন থেকে সরাতে যুদ্ধ করছি আজো নিজের সাথে। এই যুদ্ধ অসাধ্য করছে শুধুই সামাজিক সংকটগুলো।

কাজের জায়গাগুলোতেও কি কম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়! সহকর্মীরা সারাটা সময় আমাকে সকল সংকটে–সুখে একা চলতে দেখে এসেছে। তবুও তারাও অপ্রয়োজনে যেন সেই মানুষটির ছায়া আমার পাশে দেখে। কাজের প্রয়োজনে দূরে কোথাও গেলে বা অপরিচিত কেউ আমার কাজের জায়গায় এলে পরিচিত হতে গিয়ে জানতে চায় কোন খুটিতে ভর দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি বা পথ চলি? অনেকে তো আবার আমার ভালো কোন কাজের প্রশংসা করতে গিয়ে অনুমান করে কোন দেবতাকে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেই দেবতার দর্শন পেতে আমার গ্যাংগ্রিনের ক্ষতের ভেতরের সুরঙ্গ পথে যাত্রাও শুরু করে তারা।

কারণ সমাজ কখনই মানতে চায় না একজন নারী একাতেও পূর্ণ হতে পারে। তাকে বিয়ে করতেই হবে। সে বিয়েতে তার ইচ্ছে থাকুক না থাকুক। সে বিয়ের সংসারে ভালবাসা থাকুক না থাকুক। নারীর সকল ভালো কাজের হকদার কোন পুরুষকে দিয়ে দিতে চায় সমাজ। তার শক্তি, সাহস, ত্যাগ সবকিছুর উৎসও কোন পুরুষকেই যেন দিতে হবে। যদিও তা সম্পূর্ণই সামাজিক ভুল।

মা-বাবা ও স্বজন এই সমাজেরই মানুষ। তারা সমাজ রক্ষা করতে চায়, সন্তানের সুখ নয়। তারা সুখের ভান চায়, জীবন নয়। এমন একটি বিষময় সম্পর্কেরও তারা বিচ্ছেদ চায় না। গ্যাংগ্রিনের যন্ত্রণা নিয়েও তারা হাসি হাসি মুখের ভান দেখতে চায়। যা আমি পারিনা। পারবও না কোনদিন। শেষযাত্রার আয়োজনেও আমাকে যেন সেই পরিচয়ে পরিচিত হতে না হয়, আমার শবের্ দাবি তাদের কাছে, যারা আমার শেষ যাত্রায় সঙ্গী হবে।  

আমি কী জবাব দেব স্মিতাকে? যে আগুনে আমি জ্বলছি সারা জীবন, একই আগুন যেন অপেক্ষা না করে স্মিতার জন্য  এমন নিশ্চিত আশঙ্কাও করতে চাই না আমি। কিন্তু বুকটা কেঁপে ওঠে। স্মিতার একা থাকার বাসনাকে যে আগুন পুড়িয়েছে সহজে, ধুকে ধুকে পোড়াবে সে মন, যেখানে লালন করেছিল তার সেই বাসনা। সবকিছু মানিয়ে নেয়া যায় না। সব ঘৃণার ভার বহনযোগ্যও নয়। তাই স্মিতার জন্য সমানুভুতি নিয়ে অপেক্ষা করে তাকিয়ে  থাকি আমি। গ্যাংগ্রিন হলে কেটে ফেলো পা। পা ছাড়াও বেঁচে থাকা এতোটা কষ্টকর নয়।

লেখক সাংবাদিক

শেয়ার করুন: