মারজিয়া প্রভা: আমার একটা আড্ডার জায়গা আছে। সেগুনবাগিচায়। শিল্পকলা একাডেমী, গুলামের চায়ের দোকান, বাগিচা রেস্টুরেন্ট, দুদকের গলি আর গলির হোটেলে নানরুটি ডাল! আর আমার ‘গড়বো বাংলাদেশ” এর ভাইয়াবন্ধু এবং তাদের আরও আরও বন্ধুরা। আমার খুব প্রিয় ভাইয়া শাকিল ভাই, যাকে আমি ব্ল্যাক ম্যাজিক বলি, সে গান গায়। প্রিয় তরিকুল ভাই লালন গায়। পুরা রাস্তায়, রাত ১১ টায় আমি একা একটা মেয়ে বসে থাকি। আমার ভালো লাগে, প্রতিটা মুহূর্ত। মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হয়ে উঠি।
আমি ইচ্ছামতো জড়িয়ে থাকি সেই ভাইয়াদের। তারা আমাকে ইচ্ছেমতো গাল টিপে দেয়। আমি সেই জড়ানোতে কোন কাম অনুভব করি না। আমার মৌ, অন্তরা মেয়ে ফ্রেন্ডদের মতোই আমি তাদের জড়াতে পারি। আমি ভাবি, তারাও তেমনি অনুভব করে। আমাকে বন্ধু ভাবে।
আমাকে দু’একজন মাঝেমধ্যে সাবধান করে দিত “নাহ! ঠিক এত জড়াচ্ছ, ঠিক হচ্ছে না। ছেলেদের সাথে এতো ঢলাঢলি চোখে লাগে”। ঐ দুই একজনকে আমি পাত্তা দিতাম না। আমি স্টারের ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে কথাগুলো উড়িয়ে দিতাম।
তারপর দেখি কথা বাড়ছে! নোংরা কথার ফুলঝুরি! দুজন থেকে চারজন হচ্ছে। কেউ বলছে “সিগারেট খেও না”। কেউ বলছে “রাস্তায় এবার কাউকে জড়াতে দেখলে, গালিগালাজ করবো”। কেউ বলছে “ঘেন্না করি তোমাকে”।
আমি বন্ধুত্বের জড়াজড়িটা বন্ধ করে দিতেই শিল্পকলায় যাওয়া ছেড়ে দিলাম। ঐ দুদকের গলি, কিংবা চায়ের দোকান আমাকে হয়তো মিস করে না!
আমি ইচ্ছে করলে একটি ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে পারি না! আমি ইচ্ছে করলে যেখানে-সেখানে সিগারেট খেতে পারি না! অথচ আমি বা আমরা জেন্ডার ইকুয়েলিটির কথা বলি। লড়ছি রাতভর!
একটা ছেলেকে যতটা আমি জড়িয়ে ধরেছি, সেও ধরেছে। কিন্তু এজন্য তাকে নোংরা কোনো কথা শুনতে হয়নি, শুনলেও তার পাত্তা দিতে হয়নি! মাঝখান থেকে আমার মুক্ত আর আনন্দের জীবনটা ধুপ করে হারিয়ে গেল।
আচ্ছা! কথা হলো, আমি পাত্তা দিলাম কেন!
পাত্তা কি দিয়েছি? হয়ত সত্যিই দেইনি! তাহলে? ক্লান্ত হলাম কি!
একটা গল্প বলি! আমার জীবনে যত প্রেমিক এসেছে, সবাইকে কোন প্রকার দ্বিধা না রেখেই খোলা ময়দানে চুমু খেতে চেয়েছি। তারা রিকশার হুড তুলে, চিপাচাপায় আমার শরীর ছেনে দেখতে চেয়েছে। আমি ঘেন্নায় সরে এসেছি। অথচ সেই তারাই মেনে নিতে পারেনি আমার ছেলেদের সঙ্গে ফ্রি মেশামেশি (যেটাকে তারা ঢলাঢলি বলেছে), মেনে নিতে পারেনি আমার ঔদ্ধত্যপূর্ণ চলাফেরা, মারকাট আচরণ আর কথার বিতর্কে জিতে যাওয়া।
তারা মেনে নিতে পারেনি আমার লেখালেখি, আমার ধর্ম না মানা, আমার এতো এতো মানুষের সঙ্গে ওঠাবাসা, এতো ঘুরাঘুরি।
সমানধিকার নিয়ে তো অনেক লড়লাম। পদে পদে লড়েছি। জিতেও এসেছি অনেকখানে। কিন্তু মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে, যখন দেখি এই চেনা শহর প্রতারণা করছে। আমাকে বারবার রাত দিনের তফাৎ দেখিয়ে ঘরবন্দি করছে। কাছের মানুষগুলো নোংরা গীত গাচ্ছে, না জেনে, না বুঝে। আমার দেখা স্বপ্নেরা বারবার ধাক্কা খাচ্ছে আমারই বিশ্বাস করা মানুষদের কাছ থেকে। আজকাল এই ক্লান্ত থাকতে থাকতে আমি রাস্তা বদল করি। চেনারাস্তায় চেনা লড়াই আর ভাল লাগে না।
আমার আদারবক্স খ, ব আর বিচে ভরপুর। নাম না জানা, অচেনা কত পারভার্ট হামলে খেয়ে সেক্স করতে চায় আদারস মেসেজে।
আমিও রেগে না গিয়ে উল্টো তাদের বলি “ মেল এস্কোর্ট বুঝি। একটা ডকু বানাচ্ছি, ক্যামেরার সামনে কথা বলবেন?” তখন তাদের সাহসে কুলায় না।
সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরি না। শিল্পকলার রাস্তায় ঐ আদরে আহ্লাদে ভরপুর সন্ধ্যা বাই বাই নিয়েছে। আমি অন্যত্র আড্ডা খুঁজে নিয়েছি। উইড, সিগারেটের আসর জমে কোথাও না কোথাও। টুক করে গিয়ে বসে শচীন দেব বর্মণ শোনার কিংবা সিনেমা নিয়ে তর্কের আসরের অভাব আমার হবে না জানি।
কিন্তু আবারও কোন না কোন গ্রুপে কারও কাঁধে মাথা দিলে, ওড়না ঢাকা বুকে জড়িয়ে ধরে কিংবা আমার গালে ইচ্ছেমতো কারও আদর খেলে, আবার আমাকে নিয়ে নোংরা কথার ফুলঝুড়ি উঠবে। আমি পাত্তা না দিয়ে কাজ করে যাবো। একসময় আগ্রহ আমারও ফুরিয়ে যাবে। হয়ত গ্রুপ বদলাবো। কিন্তু বদলাতে পারবো না আমার চারপাশকে। কেউ হয়ত চুপিচুপি কখনও না কখনও না বলে উঠবে, “শি ইজ দি বিচ”।
হ্যাঁ! আমার কাছের মানুষরাই বলবে। যাদের আমি মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু তারা শুধুই পুরুষ হয়ে থেকেছে! যাদের মধ্যেই ঘুরে ফিরে থাকে আমার কাপুরুষ প্রেমিকেরা, আমার আদারস বক্সের মেসেজদাতারা, আমাকে রাস্তায় হেনস্থা করা লম্পটরা। আমি রাস্তা বদলাই, আসর বদলাই। বদলাতে পারি না ঐ চোখগুলোকে। যেখানে আমি নিখাদ বন্ধুত্ব দেখতে চেয়েছিলাম কোন এক সন্ধ্যায়।