নন্দিতা বৈষ্ণব: মাস্টার্সে ইথিক্স নামের একটা সাবজেক্ট পড়তে হয়েছিলো। ক্লাস করতে করতে ভাবতাম আচ্ছা এইগুলা কেন একজন মানুষকে একাডেমিক প্রক্রিয়ার শেষে এসে পড়তে হবে? যে পাঠগুলো একটা শিশুর জ্ঞান উন্মেষের শুরু থেকে নেয়া দরকার সেটার সাথে কেন তাকে এতোদিন পরে পরিচয় করানো হচ্ছে? শিশুকে শুরু থেকেই কেন নৈতিকতার পাঠ দেয়া হবেনা?
একটা একেবারে সিলি উদাহরণ দিই। বাচ্চাকালে প্রায় দেখতাম লোকেরা কেমন যেন লুঙ্গি দুই হাতে উচুঁ করে ধরে হাঁটে। আমি ভাবতাম হয়তো এই পোশাকটা পরে ভালো করে হাঁটা যায়না। এটা প্যান্টের মতো আরামদায়ক পোশাক না। অবশ্য আমার বাড়ির কাউকে আমি এভাবে হাঁটতে দেখিনি এবং অনেকদিন হয়ে গেলো রাস্তাঘাটে এরকম ভাবে হাঁটতে আর প্রায় দেখতে পাই না। এই দেখতে না পাওয়ার পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে।
আরেকটা উদাহরণ হলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অথবা বসে প্রাকৃতিক কর্ম সারা। এই কাজটি এভাবে সারতে দেখে দেখে বুড়ো হয়ে গেলাম। তবে এর হার কমেনি। কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণ টয়লেটের অভাব।
কথায় বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট। প্রকৃত অর্থে এই অভাবটা কোথায় এবং কিসের? এটা কি একেবারেই খাদ্য, অর্থ এবং সামর্থ্য সংশ্লিষ্ট?
প্রসঙ্গে আসি। কথা হচ্ছিলো নৈতিকতা শিক্ষা বিষয়ে। আসলে নৈতিকতা শিক্ষার কি কোন প্রয়োজন আছে? নৈতিকতা তো বাজারে বিক্রি করা যায় না। তাই নৈতিকতা অথবা দর্শন অথবা বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞানের দরকার কি?
আমাদের শিশুকালে পাঠ্যসূচির ভেতরে এতো পড়ালেখার মধ্যেও আমি পৃথিবীর মানচিত্র এবং ভূগোল বিষয়ে একধরনের অজ্ঞানতার মধ্যে বাস করেছি। একই রকমের অজ্ঞতা ছিল নক্ষত্ররাজি বিষয়ে এবং আমার নিজের শরীর বিষয়ক জ্ঞানছিলো একেবারেই নগণ্য।
অথচ আমরা সবাই অংক, বিজ্ঞান ,গণিত, সাহিত্য, ভূগোল ,সমাজ সবই পড়েছি! আমাদের দেশে সম্ভবত সমস্ত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে ধর্মশিক্ষাই অগ্রগণ্য। তাই আমরা ইহজাগতিক কর্ম ভুলে গিয়ে পরজগতের দিকে বেশী মনোযোগী হয়ে পড়ি।
আমাদের দেশের মতো এরকম একটা দেশের মূল সমস্যা কি খালি ওভার পপুলেশন আর সীমাহীন দারিদ্র?
আমি মনে করি একটা দেশের মূল সমস্যা হচ্ছে অশিক্ষা। স্বাধীনতার পর থেকে এই দীর্ঘ বছরগুলিতে আমরা কী কী পড়েছি? কেন পড়েছি কিভাবে এবং কতভাবে পড়েছি তার উত্তর কম বেশী আমাদের সবারই জানা আছে। এই বহুধাবিভক্ত শিক্ষার দর্শন খুব ভয়ংকর। যার ফলাফল আজকের দিনে এসে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
এবং এসব আরো বেশী তীব্রতর এবং ভয়ংকর হবে যদি আমরা শিশু শিক্ষার দর্শন কী হবে সেটা ঠিক করতে না পারি। শিশু শিক্ষার দর্শনে পারজাগতিক লোভ এবং ভয়ের সাথে পরিচয় করানোটা মুখ্য হবে? নাকি পৃথিবীকে কি করে আরো বেশী মানবিক করা যায় সে বিষয়ক হবে?
ইদানিংকালে আমি বড্ড বেশী অনিরাপত্তায় ভুগছি। রাস্তায় বেরুলে আপনি ফোনে কথা বলতে পারবেন না, ফোন টেনে নিয়ে যাবে। ব্যাগ থাকলেও টান দিবে। রাস্তায় হাঁটলে কেউ না কেউ ধাক্কা দিয়ে যাবে। বাসে উঠলে বাসের ড্রাইভার অথবা হেল্পার অমার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলবে। অথবা কেউ গাড়িতে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে দিবে। যখন ইচ্ছা হলো রাস্তায় ককটেল বাজি করে গেলো। বাড়িতে থেকেও কেমন যেন নিরাপদ বোধ হয় না। মন খুলে কথা বলেছি বলে কেউ হয়তো বাড়িতে এসে কুপিয়ে যাবে!
আর এই অনিরাপত্তাগুলো আমার কাছে খুব কম সময়েই দারিদ্র্য প্রসূত মনে হয়েছে।
এবার একটা ছোট উপসংহার। সংস্কৃতি হলো একটা প্রবাহমান প্রক্রিয়া। এটার সুনির্দিষ্ট কোন গতিপথ নাই। আজকে আপনার শিশুকে যেটা পড়তে দেয়া হয়েছে, আর আজকের শিশু যেটা জানছে, বুঝছে, ধারণ করছে সেটাই পরিচালনা করবে আগামী দিনের সংস্কৃতি। জয় হোক মানবিকতার!