এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে- ৭

লীনা হাসিনা হক:  আমার বন্ধু সু, সুপ্রীতি বকা ঝকা করছে বেশ কদিন ধরে, আমার হাতে কি কুঁড়ে ধরেছে যে আমি লিখছি না? কেন সু লিখতে বলে, লিখি তো আবজাব, মানুষ মনে হয় পড়েও না, কাগজে ছাপা হলে তাও হয়তো টয়লেট টিসু হিসাবে ব্যবহার করা যেতো! লিখতে পারছি না আজকাল। আর আসলে লিখিই বা কি? নিজের মনের ভেতরের কথা যে সাজিয়ে উঠতে পারছি না। আজকাল মন বড্ড উচাটন।

Leenaনাহ, বয়স যদি তিরিশের কোঠায় হতো বা নিদেনপক্ষে চল্লিশের এপারে তবু নাহয় কিছু একটা ধারণা করে অনেকে কৌতূহলী হতেন, নিজেও কি পুলকিত বোধ করতাম না? কিন্তু বয়সের হাফ সেঞ্চুরি পার হতে বেশি দেরি নাই। এখন মনের মধ্যে যত সব চিন্তা আসে তা কেমন যেনো অদ্ভুত। তবু লিখছি। পাগল যে আমি, ইনসেইন, তাইতো বলে বোধহয় ইংরেজিতে!

কী ভাবি আমি? পত্রিকা খুললেই খুন,জখম নারী নির্যাতন, রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির সাথে মিডিয়া জগতের সম্রাটের বাকযুদ্ধ, আইনী লড়াই। কোন এক কোনায় ছোট করে লেখা থাকে হিন্দু বা বৌদ্ধ বা অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করা অথবা হত্যা চেষ্টা করার কথা! পরের দিন সেই খবরের ফলোআপ ভেতরের পাতায় চলে যায়। দুর্বৃত্ত (!) দের কাউকে কাউকে পুলিশ ধরতে পারে। তৃতীয় দিন খবরটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমাদের সাথে কাজ করেন সনাতন ধর্মের এমন সহকর্মীরা মনে করছেন হয়তো ধীরে ধীরে দেশ ত্যাগ করাই বাঁচার একমাত্র উপায়। কেউ কেউ উন্নত দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন , অর্থনৈতিক অবস্থা এমন নয় যাদের, তারা প্রতিবেশী দেশে যাবেন কিনা ভাবছেন। একজন সম্প্রতি পাশের দেশ থেকে ঘুরে এসে জানালেন, সেখানেও যে তেমন কোন সুবিধা করা যাবে তেমন নয়, তবে প্রাণে বেঁচে থাকা যাবে।
শুনি এসব কথা আর ভাবি। আমার অবস্থান কি তাঁদের থেকে ভিন্ন?

ছেলে যখন জানায়, মা আমার পিএইচডি ডিগ্রি শেষ হওয়ার আগেই আমার একটা ভালো জব অফার এসেছে। তার না বলা কথা আমি শুনি, মা, আমি কিন্তু আর দেশে ফিরছি না।
মেয়ে জানায়, মা, আমি কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষের সামারে এখানেই ইন্টার্নশিপ করবো, দেশে আসতে হয়তো পারবো না। আমি তার না বলা কথাটুকু শুনি, আমি এই দেশেই থেকে যেতে যাই।
আমার ছোট ভাই, তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে উন্নত দেশে থিতু হয়েছে। তার ছেলেমেয়েদের জন্য সেই দেশই তাদের দেশ। বাংলাদেশ হচ্ছে তাদের বাবার দেশ।
আমার বন্ধুর ছেলেমেয়ে সবাই বাংলাদেশের বাইরে চলে যেতে যায়।
বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে, জিডিপি গ্রোথ বাড়ছে, এমডিজি গোল পূরলে সাফল্য পেয়েছি, এসডিজি গোল পূরণে এগিয়ে যাচ্ছি, নারী শিক্ষা বাড়ছে, মাতৃমৃত্যু হার কমছে, রফতানি বাড়ছে, কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কমছে।

নারীদের, শিশুদের, রাষ্ট্রধর্মের অনুসারী ছাড়া অন্য ধর্মের, অন্য জাতিসত্তার মানুষদের জীবনের নিরাপত্তা নাই হতে হতে প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
একটা ব্যক্তিগত গল্প বলি। গল্পই তো!

অফিসের কাজে গিয়েছিলাম উত্তর পূর্বের এক জেলা শহরে। কাজ শেষে বেড়াতে বের হলাম। জায়গাটি বেড়ানোর জন্য নামকরা। শুক্কুরবার দুপুর। স্থানীয় বাজারে মসজিদ। দলে দলে মুসুল্লিরা আসছেন নামাজ পড়তে। আমার সাথে তরুণ সহকর্মী। আমার পরনে জিনসের প্যান্টের সাথে একটি পাঞ্জাবী, ছেলেদের জন্যই দোকানদার বানিয়েছিলেন, আমার পছন্দ হওয়াতে কিনে নিয়ে পরেও ফেলেছি। আবার কপালে টিপও আছে।

মুসুল্লিদের কেউ কেউ আড় নয়নে তাকাচ্ছেন আমার দিকে। কারো চোখের মনি কালো, কারো ঘোলাটে, কারো খয়েরি, কারো ধূসর, কিন্তু দৃষ্টির ভাষা সবার এক- কঠিন সরোষ সেই দৃষ্টি, পুরুষের জন্য পাঞ্জাবী পরিহিত কপালে টিপ খোলা চুলের এই অবিমিশ্রকারী নারী এই মসজিদের পবিত্র প্রাঙ্গনে বেমামান, অপাংক্তেয়। আমি ছবি তুলছিলাম। তরুণ সহকর্মী তাগাদা দিলো, ‘আপা, এখন এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো’।
নেমে যাচ্ছি ঢালু পথ ধরে পাহাড়ী নদীর ধারে, উল্টো দিক থেকে আসা একজন মুসলমান (পাঞ্জাবী টুপি আর শ্মশ্রু থাকাতে বুঝলাম) পার হয়ে যেতে যেতে জোরে জোরে মন্তব্য করলেন, ‘কেয়ামতের দেরি নাই, শহর থেকে আসা এইসব বেআব্রু, বিধর্মী (কিভাবে আমার ধর্ম বুঝলেন জানি না) বুনি (স্তন) বের করা মাইয়া লোকের কারণেই পৃথিবীর এই দশা’!

মাথায় রক্ত উঠে গেলো, ঘুরে দাঁড়িয়ে জোরে বললাম, ‘এই থামেন, কী বললেন, কাকে বললেন’? লোকটি আরো দ্রুত হাঁটতে শুরু করে বলতে থাকলো, ‘এইসব শহরের ‘নটি মাগী’ রা এসে এই জায়গা নষ্ট করে ফেললো’!

আমি তখন রাগে দিশেহারা, চিৎকার করে উঠলাম, ‘এই থাম তুই, হারামী, কারে নটী বললি তুই? তুইতো নামাজে যাইতে যাইতে আমার বুকের দিকে চাইতেছিলি, তুই নটী। তুই খানকি’। আমার স্টকে যত গালি ছিল প্রায় সবই দিলাম। সেই লোক দৌড় লাগালো। আশেপাশের দু একজন পাথরভাঙ্গা কর্মী এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপা, ছাড়েন, এরা মানুষের পয়দা না। এরা পারলে নিজের মা-বইনেরেও এই চক্ষে দেখে’।
আমার কান মাথা গরম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার অল্পবয়সী সহকর্মীটি আশেপাশে নাই। তাকিয়ে দেখি সে বন্ধ দোকানগুলির পেছন থেকে বের হয়ে আসছে। জিজ্ঞ্যেস করলাম, কোথায় ছিলে তুমি?

সে পাংশু মুখে জানালো, ‘আমি তো হিন্দু, মসজিদের প্রাঙ্গনে আমার উপস্থিতি টের পেলে আমাকে মেরে ফেলতো! আপনাকে দেখতে নেপালী মনে হয় বলে তেমন কিছু বলে নাই’!
আক্ষরিক অর্থেই আমার কথা বন্ধ হয়ে গেলো, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করলো, নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে করলো, রাষ্ট্রের মুখে ( আছে নাকি!) থুথু ছিটাতে ইচ্ছে করলো। ওই পর্যন্তই। করার মধ্যে বাজারে গিয়ে একটা গামছা কিনে ‘বুনি’ ঢেকে (যেনো আমি স্তন উন্মুক্ত করে রেখেছিলাম) এই দুনিয়া জাহানকে আসন্ন কেয়ামত থেকে রক্ষা করলাম। হাজার হলেও আমি মুসলমানের সন্তান!
হায়, এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে… পারবো না…পারবো না………(চলবে)

শেয়ার করুন:

আপা,
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো। কিন্তু এই অবস্থা শুধু উত্তর পূর্বের এক জেলা শহরে নয়। এমনকি ঢাকা শহরে শুক্রবার জুমমার নামাজ পড়ে যথন মুসুল্লিরা বের হন এবং সে সময় যদি কোনো মেয়েকে দেখে তখন তারা এমনভাবে তাকায় যেন এই মুহুর্তে কেয়ামত নেমে এল। তারা এমনভাবে তাকায় যেন আমি বের হলাম কেন সব দোষ আমার, আমার আরো পড়ে বা আগে বের হলে কি এমন হত !! আবার কোনো লোকও বাধ যাবেনা যে তাকাবে না ….সকলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ময়নাতদন্ত করবে এবং চোখের সামনে থেকে চলে না যাওয়া পর্যন্ত ময়নাতদন্ত শেষ হবেনা।