ফারহানা আনন্দময়ী: যুগ যুগ ধরে পুরুষকেই আমরা একমাত্র বিরুদ্ধপক্ষ ভেবে আসছি, এরাই নারীর মুক্তির পথে বাধার দেয়াল হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। এটা প্রচলিত এবং অনেকাংশেই একটি সত্য ধারণা। এই ধারণাকে আরো শক্ত-পোক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে সত্যটি অনেকগুলো খুঁটির সঙ্গে সহায়ক খুঁটি হয়ে সমাজে বিরাজমান, তাহলো নারীরই সগোত্রের আচরণ… যারা নারী হয়েও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণ এবং বহন করে চলেন। তাঁরা তা করেন কখনো নিরাপত্তাহীনতা থেকে, কখনো নিজের অপারগতা থেকে, কখনো বা ঈর্ষাকাতরতা থেকে।

আমার এক বন্ধুকে জানি, ডিভোর্সি… একমাত্র ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে জীবনধারণ করেন, জীবনযাপন করেন। তিনি যে পেশায় আছেন, তাতে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, পুরুষের সঙ্গে মিলেমিশেই কাজ করতে হয়। কর্মসূত্রেই হোক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ সূত্রেই হোক, তাঁকে দিনের বেশিরভাগ সময়ই পুরুষের সঙ্গেই ওঠাবসা করতে হয়। আমাদের সমাজে একজন স্বাধীন, উপার্জনক্ষম একা নারীর জীবনধারণে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পুরুষেরা, সেই ‘একাকী নারী’ হয়ে থাকার সুযোগ নিতে চায়।
একজন বিবাহিত, মাথার ওপরে স্বামীর সার্টিফিকেট থাকা নারীকে তারা আহবান জানাতে যতটুকু দ্বিধায় থাকেন, একজন ডিভোর্সি বা অবিবাহিত নারীর বেলায় তাদের সেই দ্বিধা কাজ করে না, অনায়াসে নির্লজ্জ আচরণ করতে পারেন।
আমি দেখেছি, সমাজের যে পুরুষগুলো আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু বা প্রতিযোগী বা ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে সময় দিচ্ছেন, তারাই নারীটির পেছনে তাঁকে নিয়ে রসালো আলাপ করছেন, ব্যবসায়িক লাভের প্রাপ্য ভাগটুকু থেকেও বঞ্চিত করছেন। এই পুরুষশাসিত ও পুরুষশোষিত সমাজে বেশিরভাগ পুরুষই এই আচরণ করবেন, এটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে পারিপার্শ্বিক আমাদেরকে অভ্যস্ত ক’রে তুলেছে।
কিন্তু কষ্ট পাই, লজ্জিত হই, যখন দেখি বা শুনি ঘরোয়া আলোচনায় পরিচিত নারীরাই সেই একলা থাকা স্বাধীন নারীকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে অসম্মানজনক আলাপ করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন।
আমি বুঝতে পারি, এটা তাদের অক্ষমতাপ্রসূত ঈর্ষা। সেই ঈর্ষা থেকে তিনি অন্য নারীর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছেন। স্বাধীন নারীর কাজ, তাঁর জীবনসংগ্রামকে আড়াল ক’রে তাঁর মুক্ত-স্বাধীন জীবনযাপনের দিকে কালো আঙুল তুলতেই যেন তাঁদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ এবং কুৎসিত-আনন্দ।
কী অক্ষম আক্রোশে তারা ফেটে পড়েন… যেন, আমি উড়তে পারছি না, তুমি কেন উড়বে ? তাঁর ডানা ছাঁটতে পুরুষের সঙ্গে এই নারীরাও প্রবল উৎসাহে কাঁচি হাতে ছুটতে থাকেন।
স্বাচ্ছন্দ্য জীবনে থেকেও স্বাধীন নারীর স্বচ্ছন্দ জীবনের প্রতি তাঁদের অকারণ বিরাগ দেখতে পাই। তাঁরা যে শুধু নিজ সংসারেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তা নয়, সেই একলা নারীটির স্বাধীনতা যেন তাদের নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। তাঁকে টেনে নিচে নামাতে পারলেই যেন তিনি সফল পুরুষের স্ত্রী হিসেবে অনেকখানি উপরে উঠে গেলেন!
অতি সম্প্রতি রাজধানীতে দুইজন শিশুকে (ভাইবোন) হত্যা করা হয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, শিশু দুজনের হত্যাকারী তাদের মা। নিঃসন্দেহে খুবই দুঃখজনক ঘটনা, শিশুদের মনে একটি অনাস্থার জায়গা তৈরি করে দেয়ার মতোন প্রবল নেতিবাচক ঘটনা। কিন্তু অবাক হলাম কোথায়, ঘটনা প্রকাশের অব্যবহিত পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই মা’কে লক্ষ্য ক’রে চরম আপত্তিকর সব মন্তব্য প্রচার হতে থাকলো।
এক বন্ধু তো সরাসরি অভিযুক্ত নারীকে ‘ডাইনী’ আখ্যা দিলেন। আমিও দুই সন্তানের মা, সেই বন্ধুও একজন মা। আমরা মায়েরা তো অন্ততঃ অভিযুক্ত মা’কে ডাইনী ডাকার আগে অনুধাবন করার চেষ্টা করবো, একজন মা হয়ে স্বাভাবিক, মানসিক অবস্থায় কি নিজের সন্তানকে নিজ হাতে হত্যা করা সম্ভব ? না, আমরা সেই জায়গায় গেলামই না… তদন্ত, আত্মপক্ষ সমর্থন, বিচারিক প্রক্রিয়া, যুক্তি-প্রমাণ সব সবকিছুর আগে তাকে নিজেরাই অভিযুক্ত এবং অভিশপ্ত করে আপন মাতৃত্বভাবকে (?) মহিমান্বিত করলাম।
বেশিরভাগ নারীর স্বতন্ত্রবোধহীনতার জন্ম হয় জীবনের শেকড়বেলায়। এই সমাজে বুঝতে শেখার বয়সের পর থেকেই পরিবার থেকে একজন কন্যাশিশুর মগজে পেরেক ঠুকে গেঁথে দেয়া হয়, “ভাল মেয়ে হও।“
বিয়ের সময় থেকে সেই মেয়েটিকে দীক্ষা দেয়া হয়, “ভাল স্ত্রী হও।“ ভাল স্ত্রীরা যখন গর্ভধারণ করেন, তখন থেকেই শুরু হয় আমৃত্যু কানের কাছে ব’লে যাওয়া… “ভাল মা হও।“ কারা এই কাজটি করে চলেন… বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের নারীরা… মা এবং আত্মীয়ারা।
কয়টা পরিবারে, কয়জন মা তার কন্যাশিশুকে একজন ভালো মেয়ে, ভালো স্ত্রী এবং ভালো মা হওয়ার পরামর্শ দেয়ার আগে বলেন, “সবকিছুর আগে একজন ভালো মানুষ হও এবং মাথা উঁচু ক’রে বাঁচো।” অধিকাংশ অভিভাবকই বলেন না। ঘরে ঘরে খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে ১% ভাগ পরিবারে এই শুভবোধের চর্চা হয়।
আমাদের চারপাশে একজন কন্যাকে কেবলই জীবনযাপন করতে উৎসাহিত করা হয়, জীবন-উদযাপন করতে নয়। যাপনের বাইরে বেরিয়ে উদযাপন যেন মন্দ নারীর কাজ। যে নারী কল্যাণী মূর্তি ধারণ করে সংসারকে জয় ক’রে চলেছেন তাঁর জন্যে অবিরাম হাততালি পড়ে।
যেইমাত্র নারী একটু এই ছকের বাইরে বেরোলো, সামাজিক সংসারের আরোপিত, আধাআধি জীবনের বাইরে নিজস্ব একটা জগৎ গড়ে নিতে চাইলো, তখনই ছুরিতে শান দেয়া শুরু হয়ে যায়… সেই কার্যক্রমে অংশ নিতে পুরুষের সঙ্গে অনেক কাছের নারীর মুখও দেখা যায়।
একজন নারীর জন্যে এটাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যের। নারীই যদি নারীকে না বোঝে, আমরা কী করে আশা করবো এই সমাজে পুরুষেরা নারীর প্রতি সহমর্মী হবে। নারীই সবার আগে হয়ে উঠুক নারীবান্ধব।
অনার কিলিং এর শিকার সাবাকে নিয়ে তৈরী তথ্যচিত্রের জন্য জয়ী শারমীন ওবায়েদ চিনয় অস্কার পুরস্কার হাতে যথার্থই বলেন, “ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নারীরা যখন একত্র হয়, তখনই উজ্জ্বল কিছু ঘটে।“