জীবন মানে আর কিছু নয়, জীবন তো উৎসব

ফারজানা শাম্মী: ছোট বেলায় যখন থেকে পড়তে শিখেছি, তখন থেকেই ছাপার অক্ষরে যে কোনো লেখা পড়তেই আমার ভালো লাগতো, তা সে যাই হোক না কেন। পাঠোদ্ধার করা গেলে অবশ্য হাতের লেখাও বাদ যেত না। বিকেল বেলা বাদাম খাওয়া হলে সেই ছোট ঠোঙ্গা ফেলে না দিয়ে যত্ন করে ভাঁজ খুলে পড়তাম… এমনকি রান্না ঘরে রাখা সদাই পাতি’র ঠোঙ্গাগুলোও। নিউ মার্কেট এর বই এর দোকানগুলো দেখে মনে হতো, বড় হয়ে আমি ঠিক ঠিক বই এর দোকানদার হবো। আহা কত্ত বই না পড়া যাবে তাহলে! 

Zanaছাপার অক্ষরের প্রতি এই ভালবাসা আমাকে বড়দের ভাষায় “ইচড়ে পাঁকা” করে তোলে। নিজের জন্য বরাদ্দ বইগুলো পড়া শেষে হাতের বাড়াতাম মা’র “সানন্দা”, বাবা’র “যায় যায় দিন” এ। “যায় যায় দিন” আশির দশকে’র ভীষণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক ম্যাগাজিন। তখনও আমি স্কুল এর গণ্ডি পেরোইনি। তাই অলস দুপুরে মা যখন বিছানায় সানন্দা হাতে গড়িয়ে নিচ্ছে, সেই ফাঁকে লুকিয়ে আমি তুলে নিতাম যায় যায় দিন।

“দিনের পর দিন” বিভাগের মিলা আর মইন এর রাজনৈতিক ভাবনা সেই বয়সে কতোটা বুঝতাম তা আজ আর মনে পড়ে না, তবে তাদের প্রেমের কথোপকথনটাই যে ছিল মূল আকর্ষণ সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কী ভীষণ রোমাঞ্চকর যে লাগতো!

যায় যায় দিন এর প্রতিটি বিভাগই এক সময় পড়া শুরু করলাম। আর এভাবেই একদিন পরিচয় তসলিমা নাসরিন এর লেখার সাথে – ‘নষ্ট কলাম’ তাঁর নিয়মিত কলাম তখন।  আজিমপুরে আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন কবি মহাদেব সাহা। তসলিমা নাসরিন, নির্মলেন্দু গুণ, আরো অনেক কবি সাহিত্যিকদের আনাগোনা তাঁর বাসায়। লেখার সাথে পরিচয়ের অনেক আগেই আমি তসলিমা নাসরিনকে চিনতাম। আর তাই যখন তার লেখা পড়তাম তখন মনে হতো আমার চেনা মানুষটার কথাই তো পড়ছি আমি। কী সহজ ভাষায় নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ, আমাকে অধিকার নিয়ে ভাবতে শেখাচ্ছে, আমাকে বোঝাচ্ছে এ পৃথিবীতে আমার অধিকার কোনো অংশেই কম নয়। মুক্ত চিন্তা, নারীবাদ এসব শব্দ তখনও আমার কাছে দুর্বোধ্য, তবু বুঝেছিলাম এই বৈষম্য অন্যায়, চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের অধিকার। আজকের স্বাধীনচেতা, ব্যক্তি আমি এবং আমার উপলব্ধি, ভাবনা, ও মতাদর্শ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সেদিনের তসলিমা নাসরিন এর লেখাগুলো ষোল আনাই দায়ী।  

যে বয়সে মেয়েরা ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে পাড়ার বড় ভাইদের নিয়ে রোমান্টিক ভাবনায় বিভোর হয়, আমি তখন সমবয়সী ছেলেদের সাথে ব্যাডমিন্টন, কিংবা গোল্লাছুট খেলায় ব্যস্ত। ক্লাস টেন এ যখন আমি, তখন এক বিকেলে বন্ধুরা খেলতে ডাকতে এলে, মা জানিয়ে দিলেন আজ থেকে ছেলেদের সাথে খেলা বন্ধ! আমার বয়সী আর কোনো মেয়ে তো এমন ছেলেদের সাথে খেলে বেড়ায় না। তা ঠিক। আমিই একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমাদের পাড়ার খেলার দলটাতে। কিন্তু খেলতে গিয়ে আমার তো কখনো মনে হয়নি একবারও যে আমি মেয়ে, আমি ওদের চেয়ে কোনো অংশে কম ।  

সেই থেকে রোজ বিকেলবেলা আমিও ছাদে বেড়াই। ছাদের যে কোণ থেকে খেলার মাঠটা দেখা যায় আমি বেছে বেছে সেই কোণে এসে দাঁড়াই। বুকের খাঁচায় পাখিটা ডানা ঝাপটায়। আমি মেয়ে, আমি চাইলেই খোলা আকাশে উড়তে পারিনা।  

স্কুল এর গণ্ডি পেরিয়ে যখন আমি কলেজ এ – খাঁচার পাখি তখন খোলা আকাশ ফিরে পাবার সুযোগ খোঁজে। ততদিনে তসলিমা নাসরিন এর কবিতা “চরিত্র” আমার জীবনের মন্ত্র হয়ে গেছে।  

“তুমি মেয়ে, তুমি খুব ভালো করে মনে রেখো
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গোবে
লোকে তোমাকে আড় চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নিবে , শিস দিবে।
তুমি যখন গলি পেড়িয়ে বড় রাস্তায় উঠবে,
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।  
তুমি যদি অপদার্থ হয়
তুমি পিছু ফিরবে,
আর তা না হলে – যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।”

আমি জানি আমি মেয়ে। স্রোতের বিপরীতে জীবনে চলার পথ কঠিন হবে, সেটা জেনেই পথে নেমেছি আমি। যে পথে আমার চলা বারণ, সে পথই আমাকে টানে সবচেয়ে। খাঁচার পাখি কখন যেন ডানা মেলে দেয় দূর আকাশে!

এই পথ চলতে চলতে আমি শিখেছি নিজেকে ভালবাসতে, নিজেকে শ্রদ্ধা করতে, এবং নিজের অভিমত প্রকাশ করতে। বুঝেছি সংস্কারের শেকল নিজেকেই ভাঙ্গতে হয়, নিজেই নিজের সহায় হতে হয়। লোকে যতো না মন্দ বলেছে, তার চেয়ে বেশি গালিগালাজ করেছে বন্ধুরা, অভিশাপ দিয়েছে কাছের মানুষেরা – “তসলিমা নাসরিন হতে চাও! কপালে বর জুটবে না! বাকি জীবন একলা কেঁদে মরবে, কেউ সঙ্গী হবেনা।”

হেসে বলেছি, হ্যাঁ, আমি তাই হতে চাই। আর বর জোটানোর জন্য যদি নিজের সত্ত্বা বিসর্জন দিতে হয়, এমন বর না জোটাই ভালো। আমার কাছে ভুল মানুষের সাথে, ভুল পথে হাঁটার চেয়ে – নিজের পথে একলা চলাই পছন্দের। পরকালে বিশ্বাসী নই আমি। একটাই জীবন আমার, আমি সেটা উদযাপন করে যেতে চাই। বেশি পড়াশুনা জানা মেয়ে যে নিজেই নিজের জন্য অভিশাপ আর তার জলজান্ত প্রমাণ যে আমি, সেটা বলতেও ছাড়েননি আমার এক আত্মীয়।

এই সুযোগে বলে রাখি, সেসব আত্মীয়’র মুখে ছাই দিয়ে শাপে বর হয়েছে – সঙ্গী জুটেছে তাও আবার মুক্তমনা, নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। যার সঙ্গে পথ চলার নয় বছর হতে চললো। আমার আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পেছনে তার অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতা কোনো অংশেই কম নয়।

বিয়ে’র ক’বছরের মধ্যেই বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় -স্বজন, পরিচিত, অপরিচিত সবাই এক, দুই কথার পর, ওমা! আর কত বছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবে? এবার বাচ্চা নাও। বয়স হয়ে যাচ্ছে, শেষে তো আফসোস করে মরবে । মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলি, আমরা দুজনেই হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি- বাচ্চা নিতে চাইনা। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে চোখ কপালে তুলে শাপ শাপান্ত করেও খ্যান্ত দেয় না কেউই – না আমার সমবয়সী বন্ধুরা, না মুরুব্বি শ্রেণীর আত্মীয় পরিচিতজনরা।

সন্তান জন্ম দেয়া- না দেয়াটা যে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের আওতায় পরে সেটা মানতেই কেউ রাজি না। এমন কথা নাকি কেউ জন্মেও শোনেনি। বাঙালি মেয়ে পশ্চিমের হাওয়া লেগে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে – যখন হুঁশ হবে কপাল চাপড়ে কেঁদেও কুল পাবে না। শুভাকাঙ্খী দলের বেশিরভাগই কিন্তু মেয়ে। ওদের উপর আমার রাগ হয় না, বরং মায়া হয়।

অনেকেই আমাকে বলে, দেখেছো, মেয়েরাই তো মেয়েদের শত্রু! আমি ওদের কাউকেই দোষ দেই না। ওরা তো ধারণ করে বেড়াচ্ছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। মন ও মননে নারী আধুনিক হয়, তা সে আধুনিকার লক্ষ্য রেখাও টেনে দেয় পুরুষ।  

নারী যখন নিজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে – কোনো পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পদ নয় – নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারবে, একক সত্ত্বা হিসেবে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার নিয়ন্ত্রক হবে, তবেই সম্ভবত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের এই দায় থেকে মুক্তি ঘটবে। একজন নারী তখন অন্য একজন নারীর শক্তি হয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াবে ।  

যে ভীষণ ভালবাসায় নারী নিজের সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয় ভালবাসার পুরুষটির জন্য! তেমনি ভীষণভাবে যদি নারী নিজেকে ভালোবেসে মাথা তুলে দাঁড়াতো, তার প্রতি অন্যায় এর প্রতিবাদ করত, শ্রদ্ধা করতো নিজের সত্ত্বাকে, নিজেকে মানুষ ভাবতো – তাহলে কি সে ভুল মানুষের জন্য ভুল পথে হাঁটতো! কক্ষনো না। এ সংস্কার থেকে নারীর মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন সে নিজে বিশ্বাস করতে শিখবে যে এ পৃথিবীতে স্বাধীন ভাবে বাঁচার, এবং জীবন যাপন করার অধিকার নিয়েই সে জন্মেছে। কেবল তখনই পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি নারীর।

চলচ্চিত্র নির্মাতা
কানাডা

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.