মিনার্ভা সেঁজুতি: শুধু মেয়ে বলে ছোটবেলা থেকে বাড়তি কত সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে! শুধুমাত্র মেয়ে বলে! কাউকে বলতে পারিনি কখনো সেইসব গোপন দু:খের কথা, নিজের কাছে নিজের ছোট হয়ে যাওয়ার কথা, অপমানে-অসম্মানে কতরাত গোপন দু:খের ঝাঁপি খুলে অসহায় হয়ে কান্নার কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। মাকে বলতে পারিনি, “মা, আমায় আবার তোমার পেটে ঢুকিয়ে রাখো, নয়তো ক্যাঙ্গারু হয়ে তোমার থলেতে ভরে রাখো।”

নানারকম প্রশ্ন মনে হয়েছে, সব মেয়ে কি এতো সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়? নিজের বোনদের দিকে তাকিয়ে দেখতাম, বন্ধুদের কথায় বুঝতে চেষ্টা করতাম ওদের কি আমার মতো কোন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে কিনা? কিন্তু সবার সাথে কথা বলে মনে হতো, আমার মতো কারো কোন গোপন দু:খ নেই।
পরে বড় হয়ে বুঝেছি অনেক মেয়েই এসব ঘটনার সম্মুখীন হয়, কিন্তু তাদের সবার কষ্টটা আমার মতো হয় না, তারা এর প্রতিবাদও করে না। তারা সমাজে নিজেকে ভালো মেয়ে বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে এসব ঘটনা স্বীকার করে না। কারণ এসব ঘটনা তো “খারাপ মেয়েদের” ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। আমিও অনেকদিন কাউকে কিছু লজ্জায় বলিনি, সবাই যদি আমায় “খারাপ মেয়ে” ভাবে!
তখন আমার চার বছর বয়স। পাড়া-প্রতিবেশিরা আমায় খুব আদর করতো। সবার বাসায় যেতাম। একদিন পাশের বাসার রিপন ভাই আদর করার ছলে প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিল। ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম। ভয়ে আমায় ছেড়ে দিল সে। তাড়াতাড়ি বাসায় এসে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে ছিলাম।
এতো ছোট ছিলাম, কিন্তু এখনো আমার মনে আছে আমি ঐ বয়সেই ঠিকই বুঝেছিলাম, এটা খারাপ কাজ। মনে হতে লাগলো আমি খারাপ হয়ে গেছি। কাউকে বলতে পারিনি, কারণ আমি ঐ বয়সেই হয়তো জানতাম সবাই আমাকেই খারাপ বলবে। এই কষ্ট নিয়েই বড় হচ্ছিলাম। এর মধ্যেই বয়ো:সন্ধি এসে গেল। পিরিয়ড হলো। কিছুই জানতাম না।
ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে বড় বোনের বাসায় ময়মনসিংহ গেছি। প্রতিদিন সকালে উঠে দেখি পায়ে রক্ত লেগে আছে। প্রথমদিন ভেবেছি আগের দিনের মুরগি জবাইয়ের রক্ত বুঝি পায়ে লেগে আছে। সেইসময় আমি প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতাম, বিশাল গোলাপ বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দ্বিতীয় দিন দেখলাম বাথরুম করতে গেলেও রক্ত যাচ্ছে।
আপাকে বললাম, “আপা, আমার হিসুর সাথে রক্ত যাচ্ছে।” আপা ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিলো, ঐ সময়েই ইউরিন কালেকশনের সময় আপাই ধরতে পারলো যে আমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। আপা আমাকে বাথরুমে নিয়ে কাপড় পরা শিখিয়ে দিল। আপা আমাকে বললো, এখন থেকে সাবধানে চলতে হবে, ছেলেদের সাথে মেশা যাবে না, তাহলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এসব শুনে আমার মনে হলো, আমি বুঝি মরে যাচ্ছি, আমার সব আনন্দ শেষ হয়ে গেল। আমি সেই যে বিছানায় শুলাম, সারাদিন আর নড়নচড়ন নেই। নিজেকে কেমন বন্দী বন্দী লাগছিলো।
আমি বড় হচ্ছিলাম।স্কুলে যাই, স্যারের কাছে পড়তে যাই, বাসায় আসি। রাস্তায় ছেলেরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আর আমার বান্ধবী একসাথে যাওয়া-আসা করি। আমাদের দেখলেই ছেলেরা গান করে, নাম ধরে ডাকে, রিক্সায় চিঠি দিয়ে ঢিল দেয়। আমরা অনেক মন খারাপ করি, কিন্তু বাসায় বলার সাহস হয় না।
আমাদের বাসায় অনেক আত্মীয় বেড়াতে আসতো।আমি আর আপামণি এক বিছানায় ঘুমাতাম। একদিন রাতের বেলা ঘুমিয়ে আছি, ঘুম ভেঙে গেল আতংকে, আমার বুকে কেউ চাপ দিচ্ছে, ব্যথায় কেঁদে আমি চিৎকার করে উঠলাম, কে? কে? কে যেন দৌড় দিল। আমি তাকে চিনতে পেরেছি। চিনতে পেরে অবাক হয়েছি, কারণ সবার কাছে সে অত্যন্ত ভালো ছেলে। বাকি রাতটুকু কেঁদে কাটিয়েছি, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে বড় অশুচি লাগছিল। আমি বদলে যাচ্ছিলাম।
আমি লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলাম। সতেজ, সবুজ আমি মরে যাচ্ছিলাম। চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার বাসার কেউ আমার এ পরিবর্তন ধরতে পারেনি। তারা আমায় উল্টো সমালোচনা করতো। ঐ লোকটিও আমার সমালোচনা করতো। কিন্তু আমি বাবা- মা, ভাই- বোন কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না। কারণ আমি জানতাম কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না। এরই মধ্যে ছেলেরা যে আমায় বিরক্ত করতো, সেজন্য আমি শুনে ফেলেছি, “আমার দোষেই নাকি ছেলেরা আমায় বিরক্ত করে।”
এরমধ্যে একটা ছেলের সাথে আমার কথা হয়েছে, আমি তাকে বলেছি, বড় হয়ে তার সাথে প্রেম করবো। কিন্তু আমি আসলে তখন অস্থির ছিলাম, কারো সাথে প্রেম, বিয়ের বিষয়ে নিজেকে অসৎ মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি তাকে ঠকাবো হয়তো। নিজেকে খুব খারাপ মনে হতো। আমি সারাক্ষণ ঐ ঘটনা মনে করে গুটিয়ে থাকতাম। এরকম অসুস্থ মানসিক অবস্থার মধ্যেই এসএসসি পাশ করলাম। চট্টগ্রাম উইমেন কলেজে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে থাকি। সারাক্ষণ মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে, “তুমি খারাপ, তোমার মরে যাওয়া উচিৎ”। পড়াশোনায় মন বসাতে পারি না। কী অস্থির অবস্থা!
এর মধ্যেই কলেজ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটে জিএস নির্বাচিত হয়েছি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে উপস্থিত ও নির্ধারিত বিতর্কে দ্বিতীয় ও কবিতা আবৃতিতে প্রথম হয়েছি। কিন্তু পরিবারের চাপে জিএস পদ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন,”পদত্যাগ করার দরকার নেই, তোমাকে কাজ করতে হবে না”। জাতীয় প্রতিযোগিতায় ঢাকায় যাওয়া হলো না। এগুলোর সাথে যুক্ত থাকতে পারলে হয়তো বিষন্নতা কিছুটা হলেও কাটাতে পারতাম। হলো না।
আমি বিষন্ন হচ্ছিলাম……. হচ্ছিলাম….. হচ্ছিলাম। টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট আমাকে মনে করিয়ে দিলো, “এটাতো আমি না, আমি তো কখনো এমন হতে পারি না”। বোন এসেছিল দেখা করতে। অনেক বকলো। তার কোনকিছু আমার হৃদয়ে পৌঁছুলো না।আমি হেঁটে হেঁটে হোস্টেলের ছাদে পৌঁছুলাম। অনেক পরে বুঝেছি কী বোকা আমি সেই পেডোফাইল রুগীর খারাপ আচরণে আমি আমার কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছিলাম। এখন আমি সেই পেডোফাইল রুগীকে ক্ষমা করেছি।
কিন্তু ক্ষমা করতে পারিনি তাদের, যাদেরকে আমি এই ঘটনা বলার পরও আমাকে এই মানসিক বিষন্নতা কাটাতে সাহায্য করেনি। তাহলে হয়তো পরবর্তী জীবনের অনেক বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম তাই মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করতে না পেরে অন্যভাবে নিজের ক্ষতি করে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম। যেটা কখনোই ঠিক নয়। আমি কোন অন্যায় না করেও নিজেকে শস্তি দিতে চেয়েছিলাম। মেয়ে শোন, এটা ভুল পথ। যে অন্যায় করেছে শাস্তিটা তাকেই দিতে হবে।
সেজন্যই চাকরি ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের আফজাল যখন তার সাথে ডেটিংয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল অফিসের সবাইকে তার কথা বলে দিয়েছিলাম। তখন জেনেছিলাম আমার অন্য কলিগদের অনেককেই সে এরকম প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ঐসব কলিগরা কেউ আমার সাথে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেনি। দু’একজন আমার সাজ-পোশাকের দিকেও আঙ্গুল তুলেছিল।
যেমন, জিন্সের প্যান্ট পরি, চুড়িদার পায়জামা পরি, ববকাট চুল, চাকরিজীবি মহিলা হোস্টেলে থাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। কে, কী বললো আমার কিছুই যায় আসে না। আমি প্রতিবাদ করতে পেরেছি সেটাই আমার জিৎ।
আমি বলতে পেরেছি মুখের উপর, কোনো রাখ-ঢাক না রেখেই, “তুই খারাপ”। হ্যাঁ, এটাই আমার জিৎ। আমি মেয়ে এটা নিয়ে এখন আমার আর কোন খেদ নেই।