লীনা পারভিন: বাংলাদেশে বর্তমানে মনে হচ্ছে এক মহা অন্ধকারের দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। অর্থনৈতিক মুক্তির আলো ঝলমল করলেও সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদেরকে ছেয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা আমাদের স্বপ্নের বাইরে। বর্তমান সময়ে যে ঘটনাগুলো আমাদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে তার মধ্যে শিশু হত্যা ও নির্যাতন এক মহামারী আকৃতি নিয়েছে। সম্প্রতি একজন মায়ের হাতে দুই সন্তানের খুনের ঘটনা আমাদেরকে নতুন করে সম্পর্কগুলোকে মূল্যায়নে বাধ্য করছে।
এই যে এত অধো:পতনের চিহ্ন তার অন্তর্নিহিত কারণ কি আমরা ভাবছি? না ভেবে দেখার মত প্রয়োজন অনুভব করছি?
সমাজের একজন সাধারণ এবং সচেতন নাগরিক হিসাবে আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছি। একজন নাগরিক এবং মা হিসাবে নিজেকে পুন:মূল্যায়ন করছি প্রতিনিয়ত।
বর্তমান যুগ হচ্ছে পুঁজি নিয়ে খেলার যুগ। এই সমাজের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে পুঁজি, যেখানে নীতিনৈতিকতা অতি নগণ্য হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে শেখাচ্ছেন কি করলে বেশি অর্থ কামাই করা যাবে এবং সমাজের উচুঁতলায় উঠার জন্য যেকোনো উপায়ে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে হলেও প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। তারই পালে হাওয়া দিচ্ছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যারা মূলত ভোগ্যপণ্যের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি এমনই একটি বিজ্ঞাপন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পোষাকের বিজ্ঞাপনে ফ্যাশন শো করা একটি নিত্য ঘটনা। ফেইসবুকের পাতাজুড়ে ছেয়ে গেছে একটি বিজ্ঞাপনের ছবি। দেখা যাচ্ছে, একজন নারী তার শরীরের পুরোটা জুড়ে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ছবিওয়ালা এক পোষাক পরে বিড়াল হন্টন (ক্যাট-ওয়াক) করছেন।
কথা হচ্ছে, নজরুল ইসলামের ছবির সাথে এই ফ্যাশন-শো এর কি কোন সম্পর্ক আছে? নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় সম্পদ। তিনি কারো ব্যক্তিগত সম্পদ বা সম্পত্তি নয়। তার ছবির সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় চেতনা, মূল্যবোধ অনেককিছু। তিনি আমাদের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রতীক। যে সমাজে প্রতিনিয়ত মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে এবং এমন ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে, যা সমাজের অগ্রগতির জন্য বিরাট হুমকির শামিল।
আমাদের ছোটবেলাতেও আমরা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নাম উচ্চারণ করতাম অত্যন্ত সম্মানের সাথে। তাদের জীবনী থেকে শিক্ষা নেবার শিক্ষাই আমরা পেয়েছি। তাহলে প্রশ্ন উঠে, নজরুল ইসলামের এই ব্যবহার আমাদের প্রজন্মের মধ্যে কোন নৈতিক বা মূল্যবোধের শিক্ষা দিবে? নজরুল নিজে সারাজীবন ভোগবাদী মানসিকতার বিপক্ষে ছিলেন।
নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু এবং এরকম আরো যারা সার্বজনীন এবং জাতীয় সম্পদ, তাদের নাম/ছবি যদি কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই একটা নীতিমালা বা কিছু একটা থাকা উচিত। কে দিবে, কিভাবে হবে তা জানিনা< তবে যাদের কমনসেন্স নেই তাদের জন্য কমনসেন্স তৈরি করাটা খুব জরুরি। দিনে দিনে অবক্ষয় এবং মুল্যবোধের ঘাটতি যেভাবে তৈরি হচ্ছে, তাতে করে একদিন আমরা ঘিলুবিহীন জাতিতে পরিণত হবো। এবং তা খুব শিগগিরই।