নাহরীন আই খান: কয়েক বছর আগের কথা। চীন মৈত্রী সম্মেলনে এক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দাওয়াত পত্র পাওয়া, বসেছি অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে, বয়সে ও অভিজ্ঞতায় যারা আমার অনেক প্রবীণ। পরনে সালোয়ার–কামিজ। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষককে আমাদের সমাজ সবসময়ই দেখতে চায় চশমা পরিহিত, তাঁতের শাড়িতে রাশ গম্ভীর তথাকথিত বাঙ্গালী মেয়ে হিসেবে। আর আমার মত কাঁধ সমান চুল, মাথার উপর খুব ঢং করে উঠিয়ে রাখা সানগ্লাস কোনভাবেই আমার সমাজ- বিনির্মিত সামাজিক পদমর্যাদার সাথে মানানসই নয়। তাই অপ্রস্তুত সহদর্শকদের প্রচুর কৌতূহলের লক্ষ্যবস্তু হলাম আমি।
আচমকা একজন আমাকে চোখ টিপ দিলো। অনুষ্ঠানের মাঝখানে আমি উঠে তার পিছু নিলাম। একটু ভড়কে গেল সে। তারপর হাঁটতে শুরু করলো। আমি পিছু নিয়ে তার শার্ট টেনে বললাম, কী চোখ টিপ দিলেন কেন? উল্টো চড়াও হল সে আমার উপর। চিৎকার করে কিছু দর্শক যোগাড় করে ফেললো, যাদের সবাই সাংবাদিক। একজন বললেন, “ম্যাডাম চেপে যান, এগুলো চেপে যেতে হয়”।
আমি দ্বিগুণ চিৎকারে বললাম, “লজ্জা করেনা সাংবাদিক হয়ে এধরনের কথা বলেন”।
একজন বলল “আপনি জানেন না উনি কে? উনি একজন নামকরা সাংবাদিক”।
আমি বললাম “আচ্ছা দেখা যাবে”।
পরবর্তীতে লোকটি যে পত্রিকায় কাজ করত, তার সম্পাদককে জানালাম। ঠিক ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফোনে লোকটি আমাকে বলল আমি তার মায়ের (?) মতন, তাকে যাতে ক্ষমা করে দেই। দুপুরে তার ‘কামনার নারী’ থেকে সন্ধ্যায় রাতারাতি ‘মা’ হয়ে যাওয়াটা নিতান্তই সহজ প্রাপ্তি ছিল না ।
ঘটনা ২:
আমার ডিভোর্সের পর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুরুষ সহকর্মী আরেকজন সহকর্মীর কাছে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে, কারণ তার ধারণা আমার মতন তরুণী (বিশেষণগুলো খুব শালীন ছিলনা) এখন তার নাগালে চলে আসবে, এতদিন তিনি শুধু আমাকে কামনার চোখে দেখেছেন, আর এখন আমাকে পাবার দুর্দান্ত সুযোগ। তিনি খুব ভাল করেই জানেন হয়ত পদবি জুটিয়েছেন শিক্ষকের, কিন্তু আমার কাছে আসলে চপটাঘাতে প্রাণ যাবে। এই বিধ্বংসী পদবী অর্জন করাটাও সহজ ছিলনা।
এবছর বাংলাদেশে আমার আর আমার ছেলের পাসপোর্ট রিনিউ করতে দিলাম। ফর্মে অভিভাবকের ছবি দিতে হয়। তাও আবার সাম্প্রতিক হতে হবে। আমার কাছে প্রাক্তন স্বামী ভদ্রলোকের কোন ছবি না থাকায় দিতে পারিনি। যার সাথে আমাদের গত ৬ বছর কোন সম্পর্ক নেই, তার ছবি না থাকাই তো স্বাভাবিক।
মহাপরিচালক আমাকে জানালেন কাস্টডির কাগজ দিলেই হবে। যথারীতি সব কাগজ জমা দেয়ার পর আরেকজন কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, ছবি দিতেই হবে। বুঝিয়ে বললাম। তিনি নাছোড়বান্দা, দিতেই হবে। এক পর্যায়ে আমাকে তিনি বললেন, “যে কারও একটা ছবি দিয়ে দেন ম্যাডাম”। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বললাম আমার নৈতিকতায় বাধবে, যে বাবা আমার সন্তানের জীবনে কথাও নেই, তার ছবি আমি কেন দেব অথবা অন্যের ছবি দিয়ে কেনই প্রমান করবো যে একজন পুরুষ অভিভাবক ছাড়া আমার একাকী অভিভাবকত্ব আমার সন্তানের দেখভালের জন্য যথেষ্ট নয়!!!
তখন আমার অনড় অবস্থান। পাসপোর্ট দিলে দিবে না দিলে নাই কিন্তু আমি ছবি দিবনা। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মাথার ওপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাস্যজ্জল ছবি আমার দিকে তাকিয়ে। হায়রে নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার!!! প্রায় ঘণ্টাখানেক যুক্তিতর্কের পর খুব বিরক্ত হয়ে আমাদের ফর্মে সাইন করলেন তিনি, পাসপোর্ট পেলাম আমরা। এই ন্যায্য প্রাপ্তিটাও খুব সহজ ছিলনা।
ঘটনা ৪:
আমার এক বন্ধুর সহকর্মী, যার সাথে আমার অল্প বিস্তর পরিচয়। বউ পাগল স্বামী হিসেবে পরিচিত, স্ত্রীর ছবি দিয়ে ফেসবুক ভর্তি। উনি আমাকে টেক্সট করলেন, “তুমি বাংলাদেশে”?
আমি লিখলাম “হ্যা”।
তারপরের উত্তর এলো, “তুমি তো আরও ইয়াং হচ্ছো, আমার সাথে ডেইট করবে”?
উত্তরে বললাম, “আপনার apple of my eye (স্ত্রী কে ভালবেসে ফেসবুকে এই নামেই ডাকেন তিনি ) কি জানেন ? তাকে কি জানাব”?
আর কোন উত্তর এল না। এই প্রতিবাদ করতে পারার সাহস অর্জন করাটাও সহজ ছিলনা।
ঘটনা ৫:
ঢাকায় আমার পরিচিত অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার স্বামী কেমন আছে? যেন তারা জানেই না যে গত ছয় বছর আমি একা। সিলেটে আমার পাশে বসা এক ভদ্রমহিলা বলেন, স্বামীকে জার্মানি রেখে এসেছি কিনা। আসলে এই সবক্ষেত্রেই আমার উত্তর, আমার স্বামী নেই, আমি একজন একাকী মা।
প্রথম প্রশ্নকর্তারা প্রায় আবেগে কেঁদে ফেলার মতন হয়ে যায়। “খুবই দুঃখিত” বলতে বলেতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন আর আমি তাদের অজান্তে হাসি এই ভেবে যে এত সোজাসাপটা উত্তর পেয়ে, আমাকে বিব্রত করতে না পেরে বেচারারা কতই না কষ্ট পেল, আহারে।
আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ভদ্রমহিলা আমাকে অস্পৃশ্য ভেবে উনার বসবার স্থানটি পরিবর্তন করেন। আমি আয়েশ করে আরেকটু আরাম করে বসি। খুব সহজ ভাবে নিজেকে একজন একাকী মা পরিচয় দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করাটাও খুব সহজ ছিল না।
এই বিচ্ছিন্ন প্রতিটি ঘটনা আর তার প্রাপ্তি আসলেই খুব সহজ ছিলনা আমার জন্য। আমরা মেয়েরা এই সাহস অর্জন করি অনেক তেল নুন খরচ করে । তারপর আমাদের এই অর্জন বার বার নিগৃহীত হয়, অসম্মানিত হয়। আমি একজন শিক্ষক, সামাজিক মর্যাদার কারণে আমার জন্য প্রতিবাদ করাটা এক ধরনের ক্ষমতার বলয়ে থেকে সমাধানের চেষ্টা করা, কিন্তু ভেবে শিহরিত হই একজন শ্রমজীবী নারী, অথবা গ্রামের একটি সদ্য কিশোরী হয়ে ওঠা মেয়ে কিভাবে তাকে বাঁচাবে এই বিকৃত মানুষগুলোর হাত থেকে।
যেখানে সাকিব আল হাসান এর স্ত্রী অপমানিত হয়, সাকিবের ন্যায় অন্যায়ের বিচার প্রক্রিয়ায় তার স্ত্রীর পোশাক পায় Talk of the Town এর মর্যাদা , সেই দেশে আর যাই হোক eve teasing টা নিত্যকারের মুদি দোকানের চা পান কেনার মতই নৈমিত্তিক ঘটনা। আমি অবাক হয়ে ভাবি, একজন নারী অপমানিত হলে তার প্রতিবাদ আমরা না করে আমরা রাতারাতি বিচারক বনে যাই, কেন হোল, কি কারনে হোল তাই নিয়ে মেতে উঠি। আচ্ছা পুরুষরদ্বয়, বলুন তো, আমরা মেয়েরা যদি স্বল্পবসনা হয়েই থাকি তবে আপনি গুনধর পুরুষ কেন কালো চশমা পড়েন না, অথবা চোখটা বন্ধ করে একটু আরাম করেন না??
আকরাম সাহেব আপনি যখন দীর্ঘ আকর্ষণীয় দেহ নিয়ে মাঠে দৌড়ান, কই আমরা নারীরা তো আপনাকে দেখে সিটি বাজাইনা। পাপন সাহেব যখন সাংবাদিক সম্মেলনে কাব্যিক ভাষায় কথা বলেন কই কোন নারী সাংবাদিক তো আপনাকে চোখ টিপে দেয়না? সুজন যখন ব্র্যান্ডেড শার্টের বোতাম খুলে আর দামি ঘড়ি পরে আবেদনময় হয়ে টক শোতে আসেন কই আমরা তো আপানাকে কামনার চোখে লেহন করিনা। আর করিনা বলেই আপনারা বোঝেন না একটা কামুক দৃষ্টি, একটা অশ্লীল শব্দ, একটা অনাকাঙ্খিত স্পর্শ আমাদের কত রাত নির্ঘুম রাখে।
ধিক্কার জানাই বিসিবি কে । আপনারা কি পারতেন না এর প্রতিবাদ করতে, মানুষকে জানিয়ে দিতে যে আপনারা শুধু খেলেন না, আপনারা প্রতিবাদও করেন। হয়ত বলবেন সাকিব কেন নিজ হাতে পেটাল? হয়ত বলবেন আইন নিজের হাতে কেন তুলে নেয়া। আরে যে দেশের কোর্টে হাজার হাজার মানুষের সামনে ধর্ষিতাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়, একাকী মাকে প্রতিনিয়ত তথাকথিত চারিত্রিক পরীক্ষার প্রশ্নবাণে রক্তাক্ত হতে হয়, যে দেশের আদালতের উন্মুক্ত এজলাসে ব্যাক্তিগত বলে কিছুই নেই, যে দেশ আজো একজন একাকী মাকে সহজভাবে ধারণ করতে পারেনা, সে দেশে এছাড়া আর কি উপায়।
সাকিবরা থাকেনা বলেই স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা সন্ধ্যায় মেয়েদের জামার ভেতরে অনায়াসে হাত ঢুকিয়ে দেয়, রিকশার পেছন থেকে আমাদের পিঠ চমকে ওঠে নোংরা স্পর্শে। কেন আমাদের উত্যক্ত করলে আপনাদের কাছে তা আটপৌরে বিষয় হয়ে যায়, কেন আপনাদের কাছে আমাদের সম্মান এতটা ঠুনকো?
আপনাদের অসম্মান থেকে সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারীরাও রেহাই পান না। কেউ তাদের ডাকে গোলাপি, কেউ বলে দুই মহিলাই দেশকে ডোবাল। কি নির্লজ্জ আমাদের সমাজ, কি নির্মম আমাদের চারপাশ ।আমাদের পোশাক আমাদের ভাল মেয়ের সার্টিফিকেট দেয়, যদিও ওড়না বোরকা আরও কত কি দিয়েও আমরা আমাদের ঢেকে রাখতে পারিনা, আমরা ধর্ষিত হই চোখ দিয়ে,কথা দিয়ে প্রতিদিন, শতবার । তাই আমাদের সম্মান যাদের কাছে কড়ি দিয়ে কেনার মতই সস্তা তারা প্রত্যেকেই এক একজন ভার্চুয়াল ধর্ষক।
জানিনা ভালো মেয়ে হওয়ার পাশ মার্কস কত? বা মানদণ্ড কি এই সমাজে। শুধু এতটুকুই জানি, আপনারা যারা নারী কে অসম্মানিত হতে দেখে প্রতিবাদ করেন না তারা আমাদের চোখে লোক দেখানো ধনাত্মক মানসিকতার এক একটা ঋণাত্মক মানুষ। তাই আমাদের ভালো মেয়ে হওয়ার পরীক্ষায় বসবার দরকার নেই, আমরা খারাপ হয়েই থাকতে চাই। বন্ধু পুরুষ, তুমি তোমার অন্তর্বাস পোশাকের উপরে পরে রাতারাতি সুপারম্যান হয়ে যাও, আর আমি তা ঢেকে রেখেও অজান্তে দৃশ্যমান হলেই হই কলঙ্কিনী!!! এ কেমন বিচার!!!
পুনশ্চঃ আমাদের সমাজেও অসাধারণ কিছু পুরুষ আছেন, যারা আমাদেরই সহযোদ্ধা, তাদের মতই হোক আমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি, শুভকামনা পুরুষ তোমার জন্য।
-নাহরীন আই খান, জার্মানী