নিমফুল চোখের জলে ভেসে যায়

লুতফুন নাহার লতা: পশ্চিমের নিমগাছটা সকল ভালোবাসা মেখে চেয়ে থাকে তার খোলা জানালার দিকে। অগুনতি সবুজ টিয়ে এসে ছেয়ে যায় গাছ্টা। এসময় ফুল শেষে ফলের টসটসে রসে পাগল সবুজ টিয়েরা। লাল বাঁকা ঠোঁটে টুক টুক করে খায়, উড়ে যায় আবার আসে। সারা দিন সারা রাত অনন্ত আকাশজুড়ে কেবল টিয়েদের আনাগোনা। মা নামাজ পড়েন, কখনো কোরান পড়া শেষে তাঁর খোলা জানালার পাশে বসে সুপারি কেটে পান মুখে দেন। জানালা দিয়ে তাকালেই নিমফুল ঝরে যায় আঙিনায়।Lata pa write up

মাটির চুলোর ভেতর ঠিক মাঝখানটাতে একটা বাঁশের ফুকনি বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে করাত কল থেকে আনা কাঠের তুষ গাদানো হলে আস্তে করে ফুকনিটা তুলে নিত মা। মাঝখানে একটুখানি কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে জ্বল জ্বল করে জ্বলত সেই চুলো। নতুন এই পদ্ধতি খুব সাম্প্রতিক শেখা তাঁর। রান্নার চেলা কাঠের অভাবে আজ কিছুদিন ধরে আমাদের পাড়ায় প্রায় সব বাড়িতেই এভাবে রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। এতে অবশ্য ভালই হচ্ছিল দুপুরের যাবতীয় রান্না শেষ হয়েও গনগনে আগুন থাকতো চুলোয়। মাঝে মাঝে মা সেই চুলোতে আমাদের জন্যে ডিমের পুডিং বা ডিম ময়দা পামওয়েল চিনি মিশিয়ে একটা ছোটমোটো পাউন্ড কেক বানাবার একটা রিস্ক নিয়ে ফেলতেন।

তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র দু’ এক বছর হলো। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। পৃথিবীর অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো সকল মানুষের জন্যে রেশনের মাধ্যমে খাবারের সমবন্টন শুরু করেছেন। প্রতিটি পরিবারে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনের সামগ্রী বিতরণ হচ্ছে।

আমাদের পাড়ায় প্রতি বাড়িতে ছেলেবুড়ো সবার নামে একটার বদলে দুই তিনটা করে রেশন কার্ড আছে। সব বাড়িতে রেশনের চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, ঘি, সয়াবিন, পাম অয়েল বাড় বাড়ন্ত। কিন্তু কোথায় যেন তবু একটা নেই নেই হাহাকার। একবার দুধের অভাব হলো খুব মনে পড়ে, ঢাকায় আমাদের এক আত্মীয় বাচ্চার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে একটিন দুধ কিনতে গিয়ে নাজেহাল হলেন। কেরোসিনের অভাব, চালের অভাব খুব প্রকট আকার নিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর সারা দেশেই কোন ধানের জমি চাষ হয়নি। আমাদের বর্গাদার দেবেন দত্ত খুলনার বটিয়াঘাটা, গল্লামারীতে পাকিস্তানী মিলিটারির গণহত্যার ভয়ে দেশ ছেড়ে পায়ে হেঁটে জীবন মরণ যুদ্ধ করে পৌঁছেছিলেন ভারতের শরণার্থী শিবিরে। দেবেন মামারা ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে ফিরেছেন বটে, কিন্তু জমির চাষবাস শুরু করতে পারেননি তখনো।

ফলে আমার মায়ের সোনার পায়ের ছাপ নেই এবছরেও উঠোনভরা সোনার ধানে। চাটাই ভরা সোনার ধান দেখে চোখ মুখ জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছে না মায়ের, তবু সে মুখ বুঁজে আছে স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দে।

আমাদের বাড়ির কেউই সেসময় রুটি খেতে অভ্যস্ত ছিল না। কথিত আছে, খুলনার মানুষ রোজকার ভিত্তিতে রুটি খায় না। শখের বসে শীতের দিনে তেলওয়ালা হাঁসের মাংসের সাথে চালের রুটি, বা ছিতরুটি খায় বছরে দু’একবার। সেই তাদের রুটি খাওয়া। তো সেসময় মা একটা অভিনব খাবার বের করলেন। যবেদ আলীকে দিয়ে রেশনের দোকান থেকে গম এনে তা ধুয়ে মুছে শুকিয়ে পাঠাতেন আমাদের পাড়ার নান্নুমিয়ার আটা ভাঙ্গানো কলে। সেই গমের আটায় একটু একটু ঝিরি ঝিরি পানি ছিটিয়ে দিয়ে সেটা ঝাঁঝরিতে দিয়ে সেদ্ধ করে এক রকম ঝুর ঝুরে আটার ভাত বানাতে শিখলেন।

আমার মায়ের এসব কাজের উৎসাহদাতা ছিলেন আমাদের ঝড়ুর মা খালা। সেই ঝুর ঝুরে আটার ভাত তরকারি দিয়ে খেতে বা দুধ দিয়ে দুধভাতের মত খেতে কিন্তু মন্দ লাগতো না। আমরা খুলনার মানুষ, ভাত হলো আমাদের প্রধান খাবারের চেয়েও বেশী। আমাদের অঞ্চলে সকালের নাস্তাও গরম ভাত। সকালে ছেলে মেয়েরা গরম ভাত, আলুভর্তা ,গরম ডাল, ডিমভাজা এসব খেয়ে স্কুলে যায়। বাড়ীর পুরুষেরা যায় কাজে। বেলা তিনটা-চারটায় ঘরে ফিরে মাছ-ভাত খায়, আবার রাতেও খায় ভাত।

সেইসময় এই আটার ভাত আমাদের বাড়ীতে একটা থমথমে পরিবেশ তৈরি করেছিল। চালের অভাব তো ছিলই, তবু অল্প একটু ভাত সবার পাতে সমান ভাগ করে দিতেন সেই অভিনব আটার ভাতের সাথে আমার অভিযোগহীন মা। বাবা তখন বদলির চাকরি উপলক্ষ্যে রামপাল, বাগেরহাট, ফকিরহাট ছুটে বেড়াচ্ছেন। আমাদের এতোগুলো ভাইবোনের লেখাপড়া, ভরনপোষণের দায়ভার তাঁর একার কাঁধে তুলে নিয়ে ক্লান্তিতে নত হয়ে থাকতেন তিনি।

বাবার মৃত্যুর পরে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে সেই টানাপোড়েন আবার শুরু হলো। মা একাই কেমন করে সবদিক দেখেশুনে চালিয়ে নিয়েছেন ভাবতেও অবাক হই। তখন মাঝে মাঝে মা যেতেন আমাদের গ্রামের বাড়ীতে। যেখানে আমাদের পৈত্রিক ভিটা, বাড়ি, গাছ-গাছালি ছাওয়া, পাখি ডাকা সেই অবাক বিস্ময় ভরা গ্রাম।

আমার নানা বাড়ীর গ্রাম আর দাদা বাড়ীর গ্রামকে আলাদা করেছে এক নদ। দূরন্ত সে ভৈরব। কালে কালে সেই নদ প্রশান্ত হয়েছে, ক্ষীণকায় হয়ে বয়ে চলেছে খুলনা বাগেরহাট আলাইপুর হয়ে বহুদূর। এই ভৈরব নদ পার হলেই তাঁর বাবার বাড়ি। ফেরার পথে সেখানে থেমে, বিরাম নিয়ে আসতেন মা।

সেবার মৌভোগ থেকে মা ফিরছেন। সঙ্গে আমার ছোট মামী। বহুদূর গ্রামের রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এসেছেন সন্ধ্যা নাগাদ আমার নানাবাড়ীর কাছাকাছি এক ঘাটে। নৌকো, মাঝি কিছুই নেই কোথাও। ছোট্ট নদ, এক সাঁতারে পেরিয়ে যাবেন ভেবে কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে ওরা দু’জনে নদীতে নেমেছেন একসাথে। মায়ের হাতে জোড় বাঁধা বাঁধা নারকেল। হঠাৎ স্রোতের টানে মা তলিয়ে যাচ্ছেন, মা ভেসে যাচ্ছেন। আমার আদুলগায়ে চলা মা ডুবসাঁতারে পেরে উঠছেন না ঐ দূরন্ত ভৈরবের সাথে। মা জ্ঞানশুণ্যপ্রায় বহুদূর ভেসে যাচ্ছেন আর যেতে যেতে দেখছেন ওপারে দাস পাড়ার বৌ-ঝিরা নদীকে সন্ধ্যেপ্রণাম জানিয়ে যে রক্তজবা ভাসিয়ে দিয়ে গেছে তারই দু’একটি ছেড়া পাপড়ি এসে তাঁকে সাজিয়ে দিচ্ছে চির অজানার সাজে।

Lata
লুতফুননাহার লতা

কেমন করে যেন ছোট মামী তাঁকে টেনে-টুনে বাঁচালো সেকথা কেউ জানে না। বাড়ি ফিরে মা কোনদিনও আমাদের কাছে বলেননি সেকথা। বাবাকে হারিয়েও মা কিন্তু সেই সব আকালের দিন পাড়ি দিয়ে বিজয়ীর বেশে আবার সব উদ্ধার করেছেন একা হাতে। তাঁর সন্তানদের শিখিয়েছেন সকল কুসংস্কার পায়ে দলে মুক্তমনে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। শিখিয়েছেন সততা, সত্যনিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস, আর কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। আমাদের প্রতিটি ভাইবোনকে শিক্ষিত করে তুলেছেন। দিয়ে গেছেন মানুষের পরিচয়ে বাঁচবার প্রেরণা।

মা নেই। বাড়ীর মধ্য উঠোনে নেই সেই রক্তলাল শিমুলের গাছটা। যে গাছের ছায়া মেপে মা বলে দিতেন স্কুলের বেলা হলো। পশ্চিমের নিম গাছ আজ আর নেই, তবু তারই অগনিত সবুজাভ সাদা ফুলের ম ম গন্ধে বাতাস কেঁদে ফেরে একা।

 

শেয়ার করুন: