কাকলী তালুকদার: গরুর লেজের দিকে চেয়ে থেকে আমিও হাঁটছি পিসির সাথে, পিসি গরু হাগু করে না কেন? কাঁচা ঘাস খাইলে আবার হাগবে। পিসি, তোমার মা-বাবা কই? পিসি একটু হেসে বলে, তুই তো আমার মা-বাবা!
পিসি ওই দেখো একটা গরু হাগছে, আমি দৌড়ে গোবরের কাছে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে দিয়ে বলি, এইটা আমার, কেউ ধরবি না তোরা, সাথে আমার বয়সি আরও পাঁচ-ছয় জন হবে। ওরা বিরক্ত হয় আমার আচরণে, একজন বলে উঠে তোরা অত ধনী, তুই গোবর টুকাশ কেন? আমার ইচ্ছা, তোর কি?
পিসি গোবরটা উঠাও তোমার উড়ার মধ্যে। পিসি গোবর উঠায়, আমি পাহারা দেই। গরুর পালের পিছনে হাঁটতে থাকি পিসির সাথে সারা দুপুর। আমার সমবয়সীরা বিরক্ত হয়ে কেউ কেউ অন্য গরুর পালের পিছনে চলে যায়। পিসির উড়া গোবর দিয়ে ভরে আমরা এক সাথে বাড়ি ফিরি।
মাঝে মাঝে আমিও হাওরে গিয়ে পিসির জন্য লাকড়ি জোগাড় করি, আমার বয়সী ছেলে- মেয়েদের সাথে।ওরা বিরক্ত হয় আমার উপর, ওদের ভাগে কম পরে আমার জন্য। মা-বাবা জানে না আমি এই সকল কাজ প্রায়শই করি। পিসির ছেলে রমেন আমাদের ঘরে কাজ করে, আমরা দাদামনি ডাকি। ক্ষেতমজুর পার্টি করে, তখন আমার বয়স কত, ছয়-সাত হবে।
পার্টি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই আমার, তবে এতটুকু বুঝি গরিবের পক্ষে কথা বলে এই পার্টি। আমি আমার মেঝো বোন দুজনেই আমাদের দাদামনির পক্ষে। তখন আমাদের ঘরে আট দশ জন লোক কাজ করে। তাদের কেউ কেউ ক্ষেতমজুর পার্টি করে। মাঝে মাঝে তারা বিভিন্ন মিটিং এ যায়।
কাজের চাপ হলেই পিসিকে ডেকে নিয়ে আসি, পিসি আমাদের ঘরে কাজ করে দিয়ে যায়। পিসির দুই মেয়ে, বড় জন অসুখে পড়েছে, শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরৎ দিয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে থাকে সারাক্ষণ। ছোট জন বিন্দুদি পিসির সাথে সব কাজে সহযোগিতা করে। পিসির একটা চোখ অপারেশন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কী জানি হয়েছিল।
পিসির সাথে যখন ঘুরতাম, আমিও মাঝে মাঝে আমার একটা চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে রাখতাম, কেমন লাগে এক চোখ দিয়ে দেখতে? পিসির অভাবের সংসার, প্রতিদিন টানাপোড়েন এর মধ্য দিয়েই জীবন চলে। আমরা তিন বোন বাবাকে পাহারায় রেখে কতদিন চাল, নুন, মরিচ ঘর থেকে চুরি করে পিসির ঘরে গিয়ে দিয়ে এসেছি।
পিসি বলতো, এমন করা ভালো না, তারপর এইগুলো দিয়েই আবার রান্না বসিয়েছে। মাঝে মাঝেই চুলা জ্বলতো না, চালের অভাবে। আমরা যখনই টের পেয়েছি, নিজের ঘর থেকে চুরি করেছি যেন মা জানতে না পারে। তখন অনেকেই রেশন কার্ড দিয়ে গম আনতে যায়, পিসিরাও সেই গম থেকে আটা করে নিয়ে আসতো। অনেকদিন সেই আটার রুটি আমরাও খেয়েছি। চালের ক্ষুদ তখন খুব কম দাম, তারা সেই ক্ষুদ কিনে নিয়ে এসে রান্না করে খায়। ভাত রান্না করে ভাতের ফেন ফেলে দেয় না, সেটা দিয়ে দিনের অনেকটা সময় পেট ভরা থাকে। খাবারের অভাব না থাকলেও ভুষিসহ লাল আটার রুটি, ক্ষুদের জাউ আর ভাতের ফেন তাদের সাথে খেতে আমারও সুস্বাদু লাগতো।
পিসির বড় মেয়ে অসুখে ভুগতে ভুগতে একদিন মরে গেল। পিসি এক চোখের কান্না আঁচল দিয়ে মুছতো, সাথে নাকের জল। বিন্দুদির বিয়ের আলাপ এলো, ছেলের আগের সংসার আছে। বিয়েটা হয়নি শেষ পর্যন্ত। একদিন দাদামনি চিটাগাং চলে গেলো। বছরে এক-দুইবার আসে মা আর বোনকে দেখতে, মাঝে মাঝে টাকা পাঠায়। দাদামনির অসুখ শুনে পিসিও একদিন চিটাগাং চলে যায়। বিন্দুদি একা থাকে ছোট্ট ঘরে, বয়স তার পঁচিশ কি ছাব্বিশ। পেট চালাতে কাজ করে আমাদের ঘরে বা কাকুদের ঘরে।
বিন্দুদির গায়ের রং ফর্সা, দেখতে সুশ্রী। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কত পুরুষের চোখ তখন ওই ঘরটিতে পড়েছে আমরা খবর নিতে পারিনি। আমরা তখন শহরবাসী। মাঝে মাঝে বাড়িতে গিয়ে পেয়েছি তাকে আমাদের ঘরে বা কাকুদের ঘরে। তার শরীর ভালো থাকে না প্রায়শই, মাথা ব্যথা প্রতিদিন। শরীরে তিন ধরনের ক্ষুধা সবার থাকে, সমাজ না চাইলেও শরীর সেই ক্ষুধা অনুভব করে। পেট, মন এবং শরীর এই তিনটি চাহিদা পূরণ না হলে বিভিন্ন উপসর্গ মানুষের দেখা দেয়। শেষের চাহিদাটি একটি নির্দিষ্ট বয়স থেকে শুরু হয়।
পিসিকে আর কোনদিন দেখিনি, শুনেছি চিটাগাংয়ে মারা গেছে, দাদামনিরও আর কোনো খবর নেই। শুধু বিয়ে করেছে ওখানে এতোটুকু জানি।
বিন্দুদির ঘরে পাশের বাড়ির গোপালদা দোকান দিয়েছে। তার ছোট্ট ঘরে মুদির দোকান দেয়ার জায়গা নেই। বউ, তিন ছেলে নিয়ে গোপালের ছোট্ট ঘর।
একদিন গোপালের দিন ফিরেছে একটা বড় ঘর বেঁধেছে। বিন্দুদির ঘরের সেই দোকান ভেঙে তার নিজের ঘরে নিয়ে গেছে, সাথে বিন্দুদিকেও। সেই নিয়ে গোপালের বউ এর কম অশান্তি হলো না! তাকে কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে স্বামীর হাতের মাইর পর্যন্ত খেতে হলো। বিন্দুদিও ছাড়লো না আর গোপালের ঘর।
বড় হয়ে জেনেছি, পিসির মা আমাদের দাদু-ঠাকুমাদের সেবা করতো। দাদুর সেবা করতে গিয়েই দুই সন্তানের জন্ম হয়। একজন হলো পিসি, আরেকজন তার ভাই। তারা কোনদিন সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা পায়নি, তবে তারা যেন খেয়ে পরে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে কেউ কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেনি, তোমাদের বাবা কে?
সবাই জানতো, কিন্তু মুখে কেউ বলতো না! সেই পিসি আর তার ভাই আমাদেরকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতো! বাবা-কাকুরাও তাদেরকে নিজের ভাইবোনের মতোই ভালোবাসতো, কিন্তু বড় একটা ফারাক থেকেই যেত। অমীমাংসিত সম্পর্ক, তাই সম্পদ এবং জীবনযাপনেও ছিল রাত দিন তফাৎ। আমাদের অনেক সম্পদ, অন্যদিকে তারা এখনো শ্রমিকের জীবন কাটায়।
বিন্দুদির জীবনটাও অমীমাংসিত রয়ে গেল।
সমাজ এখন অনেক সভ্য হয়েছে, লিভ টুগেদার মেনে নিলেও অস্বীকৃত সন্তানকে কেউ মেনে নিবে না। তাই হয়ত বিন্দুদিও তার বসন্তবেলা ও মাতৃত্ব দুটোকেই গোপন করেছে। না, বিন্দুদির হাতে শাঁখা নেই, কপালে সিঁদুর নেই, তার দিদিমারও ছিল না। তবে তার দিদিমার দুটি সন্তান ছিল মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে দিদিমা। বিন্দুদি শুধু তার পেট আর শরীরকে ক্ষান্ত করতে পেরেছে, মন আর অধিকার বোধকে ক্ষান্ত করতে পারেনি!!