আমরা যারা একলা থাকি-বিশেষ পর্ব (১)

women hood 2সুপ্রীতি ধর:

শুরুটা ছিল এইরকম। বেশ কয়েকদিন ধরেই অসুস্থতা, ভেবেছিলাম মেনোপজের সময় এসে গেছে, এমন নানাকিছু হয়েই থাকে, একসময় ঠিক হয়ে যায়, এর মাঝে হট ফ্ল্যাশও হচ্ছিল। ফলে লক্ষণগুলো মিলে যাওয়ায় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেনি। চিন্তা হলো তখন, যখন সাড়ে পাঁচ মাস পর অঝোর ধারায় রক্তবর্ষণ শুরু হলো। এমনই ধারা যে, দুই-তিন প্যাকেট স্যানিটারি প্যাডেও কুল-মান রাখা যায় না। এভাবে মাস দেড়েক চলার পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।

পরিচয় সূত্র ধরে সিরিয়াল নম্বর পেয়েও চার ঘন্টা অপেক্ষার পর অবশেষে দেবির মুখদর্শন হলো। ভিতরে তখন আমি একা নই, প্রায় ১২ জন রোগী। কারও চিকিৎসা পত্র লেখা চলছে, কারও ওজন মাপা হচ্ছে, কারও রক্তচাপ দেখা হচ্ছে, দুজন দুই বেডে শুয়ে আছেন, আর সামনে আরও পাঁচজন রোগী লাইনে। সেই অবস্থায় কেউ যদি কোনো গোপন কথাও বলার ইচ্ছা রাখেন, তা বলবেন কি করে সেই ভেবেই আমি নিরাশ হচ্ছিলাম।

অত:পর আমার পালা। পাশে দুজন রোগী প্রায় উপুড় হয়ে আছে আমার ওপর। অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। আমি শুধু দেবিকে বললাম, আপনার এখানে প্রাইভেটলি দেখানোর কোনো উপায়ই নেই? ঊনি আমার মুখদর্শন করে কী বুঝলেন জানি না, উত্তর দিলেন না। আমি আরও নিরাশ। আমার ফাইল দেখলেন। নামের পাশে লিখলেন ‘মিসেস অমুক’। এই সেরেছে। আমার মুখ খুলে গেল।

দেবি (আপা) এটা ঠিক করেন, আমি মিসেস নই। ঊনি আরও আশ্চর্য! এমনিতেই রোগীর জন্য বরাদ্দ সময় অতি কম, সেখানে এমন ‘আলোচক’ তো আরও নিষ্প্রয়োজন।

তারপরও মুখে হাসি টেনে বললেন, ‘কী লিখবো’? ‘মিজ’। ‘আপনার তো দুটো বাচ্চা আছে দেখছি’।

‘তাতে কী’।

বাচ্চার বাবাও ছিল একসময়, না থাকলেও অসুবিধা ছিল না। আজ যেহেতু নেই, তাই পুরনো তকমা আমি বয়ে বেড়াতে নারাজ।

মূহূর্তে ঊনার মুখের কাঠামোর পরিবর্তন ঘটলো। কী যেন ভাবলেন! বললেন, ‘আপনি জব করেন’? বললাম।

পেশাগত জীবনের নানা জটিলতার কথা তিনি তখন আমায় বললেন, যা না বললেও অসুবিধা হতো না। ভিতর থেকে তার অনেক গল্প বেরিয়ে এলো। প্রতিদিন মিনিমাম ৫০ জন রোগী দেখা রোবট একজন অনর্গল গল্প বলে চলেছেন, চেম্বারের সবাই আমাকে আড়চোখে দেখছেন।

তবে একটা সুবিধা হলো আমার জন্য।

ঊনি আমাকে বিশেষ স্থান দিয়েছেন। এখন আর কোনো সিরিয়াল লাগে না আমার। নামে কাজ হয়ে যায়।

এরপর এলো দ্বিতীয় পর্ব। পর্দার ওপাশে গিয়ে ‘চেক’ করাতে হবে। আমি তো নারাজ। ঋতুচক্র ফল্গুধারায় বইছে, কোন আন্দাজে আমি চেক করি! বললাম সে কথা।

দেবি তখন একটা ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, ‘আজই খেয়ে নিন, আপনার এই ফল্গুধারা কমে যাবে, আর টেস্টগুলো করিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আসবেন। নেক্সট টাইম আর মিসেস লিখবো না’। এর মাঝে আরেকটি কাণ্ড ঘটেছে। তিনি আমার নামটা এতো সুন্দর করে উচ্চারণ করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ‘কী সমস্যা তোমার?’

আমি তাতেই বিগলিত হয়ে বলি, ‘তুমিটাই সুন্দর মানাচ্ছে আমার দেবির মুখে’।

ঊনি মনে হয় তাঁর এই পেশাগত জীবনে এমন বাকপটু মানুষের দেখা কমই পান, মনে হলো আমার। তারপরও যতো না তার ব্যস্ততা, তা নিমিষেই উবে যায় কথা শোনার পর, অমায়িক-আন্তরিক মানুষ তিনি। ভীষণ নির্ভরতার জায়গা করে নেন সহজেই। আমিও সঁপে দিলাম নিজেকে। কথা দিলাম ফল্গুধারা কমলেই টেস্টগুলো করিয়ে ফিরবো ঊনার কাছে।

তখন কী জানতাম, এরপর আমার জন্য টানা একমাসের ডিপ্রেসান অপেক্ষা করে আছে? আর তার ফেরে পরে আমি মুঠো মুঠো ওষুধ গিলবো আর বন্ধুদের নাচিয়ে বেড়াবো? জানতাম না। বন্ধুরা যখন আমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখন একজন রক্তীয়ের মন্তব্য ছিল:

‘বাদ দাও, মনোযোগ দিও না, ও এটেনশান পাবার জন্যই এরকম করছে’। কিন্তু বন্ধুরা আমার সেকথা শোনেনি। ওরা বাদ দেয়নি। ওরা আরও বেশি এটেনশান দিয়েছে, ওরা বলেছে, ওর এখন মনোযোগই বেশি প্রয়োজন। ডাক্তার-হাসপাতাল করে পথ্য সহকারে, ভালবেসে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে।

রক্তীয়দের কথা শেষ হবে না বলতে গেলে। তাই না বলাই মনে হয় ভালো। তবে মাঝেমধ্যেই কথা প্রসঙ্গে আসবে। এইটুকুই।

ডিপ্রেশানের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে টেস্টগুলো করাই আমার স্বাস্থ্য দেবির নির্দেশ মতোন। রিপোর্টগুলো দেখলেন, আমাকে দেখলেন, বললেন, ‘ফেলে দেই সব’। বুঝতে বাকি নেই আমার কী ফেলবেন ঊনি? সায় দেই সাথে সাথে। জঞ্জাল যত দ্রুত ফেলে দেয়া যায়, ততোই মঙ্গল। যদিও আমার সেই আবার রক্তীয়রা এ নিয়ে বক্রোক্তি করতে ছাড়েনি।

আসলে ওই যে বলে না, How to Define a Bad Girl (আমার এক ছোটবোন/বন্ধু এ নিয়ে সিনেমাও বানিয়ে ফেলেছে। আমি তো অনেকের চোখে, সমাজের রক্তীয়দের চোখে মন্দ বালিকাই। তারা ধরেই নেয় যে, মন্দ বালিকাদেরই এসব রোগ হয়।

যেমন ২২ বছর বয়সে সোভিয়েত রাশিয়াতে যখন আমার সিস্টের কারণে একটা ওভারি ফেলে দিতে হয়েছিল, অপারেশনের ১৫দিনের মাথায়ই আমি দেশে এসেছিলাম। কিছু কথা সরাসরি, কিছু কথা কানাঘুষায় শুনেছিলাম, ‘অপারেশনটা দেখেছো? এতো সিজার সিজার। নিশ্চয়ই ওইদেশে বাচ্চাকে রেখে দেশে এসেছে’।

এগুলো শোনার পর আমার আর রুচিতেও বাঁধেনি তর্কে জড়াতে। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী,জেদী, ঝগড়াটে হিসেবে আমার বেশ নাম-ডাক আছে। আজ এতোবছর পর এসে মনে হয়, আমিই ঠিক ছিলাম। আমার চোখের সামনেই ওই বাড়িতে অনেক অনাচার হয়েছে নানাসময়ে বেড়াতে আসা দূরসম্পর্কের মেয়ে আত্মীয়দের সাথে, ওরা কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেনি, কিন্তু অপরাধীরা আমার চোখ দেখেছে, জেনেছে, আমি তাদের দেখে ফেলেছি, তাইতো এতো অপ্রিয় আমি।

(চলবে)

শেয়ার করুন: