রিমঝিম আহমেদ: লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য একজন শিশু সর্বপ্রথম শিখে পরিবার থেকে, তারপর সমাজ থেকে। জন্মের সময় প্রকৃতিগত কিছু পার্থক্য নিয়েই মূলত একজন শিশুর জন্ম হয়। সে পার্থক্য টা কেবলই প্রকৃতিগত। প্রকৃতি ছেলে এবং মেয়ে তৈরি করে, আর সমাজ তাকে বৈষম্য’র ভিত্তিতে নারী ও পুরুষে পরিণত করে। সমাজই তৈরি করেছে নারী ও পুরুষের মেয়েলি ও পুরুষালি বৈশিষ্ট্যগুলা।
প্রকৃতিগত পার্থক্য চেঞ্জ করার সাধ্য আমার আপনার নেই। কারণ প্রকৃতি শুধুমাত্র নারীর পুণরুৎপাদন কাজের জন্য ভিন্ন অঙ্গ সৃষ্টি করে, পার্থক্য এটুকুই। এই সত্যকে আমরা বিকৃত করে ফেলেছি আর নিজেদের সুবিধামত ব্যবহার করছি যুগযুগ ধরে। এবং নারীপুরুষ বৈষম্য, আলাদা চালচলন, উঁচুনিচু বিভেদ তৈরি করেছে সমাজ।
সারা পৃথিবীতেই সামাজিক লিঙ্গীয় পার্থক্য হচ্ছে মূলত পিতৃতান্ত্রিক, যার মূলে পুরুষের আধিপত্য। এগুলো কেবল পুরুষকেই সহায়তা করে, কারণ বিরাজমান লিঙীয় পার্থক্য মূলত নারীবিদ্বেষী। যার কারণে মেয়েদের প্রতিনিয়ত অনেক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয়।
ভেবে দেখুন- কোন শিশু ছেলে কি মেয়ে, সে পার্থক্যটা কি আপনার আমার তৈরি নয়? আমাদের আচার-আচরণ দ্বারাই সামাজিক লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। নারী ও পুরুষের এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংজ্ঞাকেই মূলত সামাজিক লিঙ্গ বলা হয়। অর্থাৎ একজন শিশুকে কেন্দ্র করে আমাদের আচরণের বহিঃপ্রকাশই মূলত সামাজিক লিঙ্গ। আর শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে সামাজিক লিঙ্গের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। এই প্রভাব নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর।
সমাজের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যেমন- সমাজ কিছু নিয়ম বানিয়েছে, মেয়েরা ঘরে থাকবে, মাঠে খেলতে পারবে না, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা যাবে না, পোশাকআশাক শালীন হতে হবে, বেশিদূর লেখাপড়া করার প্রয়োজন নেই, পরের ঘরে চলে যাবে। আবার, ছেলেরা ভালো স্কুলে যাবে, ভালো চাকরি পাবে, পরিবারের দায়দায়িত্ব নেবে। অথচ ছেলেদের মতো করে মেয়েদের দিকে অতটা মনোযোগ দেওয়া হয় না। এই সামাজিক বৈষম্যের কারণেই নারীপুরুষ আলাদা হয়, হয়ে ওঠে একেবারেই দুটি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা।
ধরা যাক, কোন পরিবারে মেয়ে সন্তান জন্ম নিল, আজান দেয়া বা অন্যান্য ধর্মীয় আচার থেকে শুরু করে, তার কেমন জামাকাপড় হবে সবই পরিবার ঠিক করে দেয়, সে সাথে ঠিক করে দেয় শিশুর আচরণ কেমন হওয়া উচিত তাও। মেয়ে শিশু হলে তার ফ্রক, স্কার্ট, আর ছেলে শিশুর বেলায় শার্টপ্যান্ট। এমনকি রঙের বেলায়ও ছেলেমেয়ে আলাদা। খাবারের বেলায়, চুল মেয়ে হলে বড়, ছেলে হলে ছোট, খেলাধুলার বেলায়; পড়াশোনার বেলায় ও তাই। কৃষিশিক্ষা বা গার্হস্থ্য অর্থনীতি দুটোই লৈঙ্গিক বৈষম্য বহন করা সাবজেক্ট।
সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে যদি বলি, নাচের বেলায় ছেলেদের অংশগ্রহণ কম দেখেছি, যদিও কিছুটা লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বর্তমানে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতেও ছেলেমেয়ের বৈষম্য আছে, সালিশ, বিয়ের আলোচনার ক্ষেত্রে, পরিবার ও সমাজের পুরুষেরাই মূলত নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সমস্তটাই পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় এসব বৈষম্য। আর পরিবারকে প্রেসার ক্রিয়েট করে সমাজ, সমাজকে রাষ্ট্র।

এভাবে চেইনওয়াইজ এটা জড়িয়ে গেছে আমাদের যাপনে। কিন্তু চাইলে আমরা তা পরিবর্তন করতে পারি। আমরা সে সমাজ তৈরি করতেই পারি, যেখানে মেয়ে মানে অসহায় দুর্বল নয়, অন্যসব মানুষের মতো সর্বদিক সক্ষম এবং বিশেষ কিছু দিকে অতিমাত্রায় সক্ষম। আর সেটা সন্তানধারণ। আর ছেলে মানেই আদেশকারী, নিয়ন্ত্রক ও নির্যাতনকারী নয়। কয়টি ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে আজ অব্দি, যেখানে নারী নয়, পুরুষই ভিক্টিম?
আমাদের হাতে সব সময়ের জন্য দুটি পথ খোলা থাকে। এবং সে পথ ধরেই আমাদের যেতে হয়। এক, প্রচলিত পথ, যেটা যুগযুগ ধরে চলে এসেছে। প্রথা, নিয়মকানুনকে কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিয়ে, অনুসরণ করে এসেছে, তা যেমন চলছে চলতে দেয়া। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা।
আবার দ্বিতীয় পথ, যা চলে এসেছে, যেসব নিয়ম সমাজ চাপিয়ে দিয়েছে, তার যথার্থতা নিয়ে ভাবা। আমরা ভাবছি কি না, এ নিয়ম চলতে পারে না, এটা একটা গ্রুপের উপর সামগ্রিক ভাবে অন্যার্য বা অনুচিত। ভাবছি না। যদি ভাবতাম, বোরকা, হিজাব, ওড়না এসব পোশাকি নাম ও ব্যবহার শালীনতার অনুষঙ্গ হতে পারত না। এমনও কিছু এলাকা আছে যেখানে, নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই ভাগ কিশোরী, নারী এসব পোশাক পরে।
প্রসঙ্গ এটা নয়, পোশাকের স্বাধীনতা ব্যক্তির ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। প্রসঙ্গ এটাই, আমাদের বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা এগোচ্ছি না পিছাচ্ছি! সমাজ বিনির্মানে আমরা কি তুলে দিচ্ছি আমাদের নিয়ন্ত্রণ অন্যকারো হাতে? পর্দা কার জন্য করছি, নিজের জন্য না কি সেখানেও অন্য কোন গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ? ভাবুন, ভাবুন এবং ভাবুন!
আমরা সবসময়ই মনে করি শিক্ষাই পারে সমস্ত কুসংস্কার থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে। মানুষ মুক্ত হলেই সমাজ মুক্ত হবে। আর তার জন্য চাই একটা প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু সে শিক্ষাব্যবস্থাই যদি স্বয়ং কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়? তা কি পারবে এই বৈষম্য দূর করতে? কীভাবেই বা ভূমিকা রাখতে পারে, সেখানে শেখাচ্ছে প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘ও’ তে ওড়না চাই। ‘ওড়না’ একটা লৈঙ্গিক পার্থক্য সূচক শব্দ। ধর্ম ও পুরুষতন্ত্র কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া শব্দ।
এটাও ভেবে দেখার বিষয়, আপনার আমার সন্তানকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছে কারা? তারাও যদি এমন মানসিকতার শিক্ষক হয়ে থাকে তবে শিশু কার কাছে শিখবে মানুষ হবার মন্ত্র? কারাইবা প্রণয়ন করছে এই বই, যেখানে ‘ওড়না’ প্রথম শ্রেণিতেই শিখতে হয়! তাদের দিয়ে নিশ্চিত হচ্ছে একটি অন্ধজাতি প্রতিষ্ঠার বলয়, মুক্তি নয়, কখনওই নয়। তারা নারীর মুক্তির বদলে পুরুষতান্ত্রিকতাকে সমাজের রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। মানব মুক্তির আশা দূরহ।
কাপড়ের বস্তা নিয়ে আপনি সাঁতরে ওপারে যেতে পারবেন না যদি আপনি জলে পড়ে যান, এটা আপনাকেই বুঝতে হবে। আর আপনি যখন বুঝবেন আপনিই বুঝিয়ে দিতে পারেন অন্যকেও, যারা আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।