আধ-মানুষের জীবন/পর্ব-তিন

ahd-manusher-jibon2শারমিন শামস্: শীতের সকালে নিজের দেশের নিজের রাজধানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পাখি দেখতে গিয়েছি। সেখানে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের এক ক্যাডার অযথাই ক্ষমতা দেখাতে এসে হম্বিতম্বি শুরু করলো আমাদের ক্ষুদে দলটার ওপর। তার বক্তব্য, যে কেউ এসেই তার ক্যাম্পাসে পাখি দেখতে পারে না। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে শান্তভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করলাম। না সে কোন যুক্তিই মানবে না। সে এসেছে শাসাতে। আমাদের শান্ত ভাব তার ভালো লাগছে না।

ঝগড়াটে ভঙ্গিতে তেড়ে এসে সে আমাকে বললো, ‘এ কী পোশাক পরে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে? হ্যাহহ?? কী পরেছেন এইটা?’ আমি, আমরা তবু শান্ত। সোয়া পাঁচ মিনিটের মাথায় আমাদের নাম-পরিচয়-জ্ঞাতিগুষ্ঠি-পেশা-টেশার খবর জেনে সে যখন কেঁচোর মুখে লবন পড়ো পড়ো, আমি তাকে ঠিক তেমন শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, তখন আমার পোশাক নিয়ে কথা বললেন ক্যান? কারণটা কী বলেন তো?’ পাতি ক্যাডার ভাই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে যেতে বললেন, ‘মানে একটা কিসু নিয়া আপনারে তো আঘাত করে থামাতে হবে, তাই ঐ টা বলসি’।

আমি বললাম, ‘বেশ বেশ। তা ঐ যে আমাদের সাথের ছেলেটা, আঁটো হাফপ্যান্ট পরে এসেছেন, তার পোশাক ঠিক আছে ক্যাম্পাসে?’ ক্যাডার বললো, ‘আপা, ছেলেদের আর পোশাক কী? একটা কিসু পরলেই চলে। কে দেখে?’ আমি আবার বললাম, ‘বেশ বেশ’। পুনশ্চ: আমার পরনে ছিল একটা কুর্তা আর ঢোলা সালোয়ার। সেই পোশাকেই পাখি দেখে ঘরে ফিরলাম। ক্যাডার ভাই-ই দেখিয়ে দিলেন গাড়ি কোথায় পার্ক করতে হবে।

২. কালো মেয়ের দুঃখ শুরু হয় শৈশব থেকে। আর মোটা মেয়ের যন্ত্রণা শুরু হয় কৈশোর থেকে। কালো মেয়ের সামনেই তার স্বজনরা আহা উহু করে। মোটা মেয়েরে দেখায়ে আপনজনও কাদুনী গায়। বিরক্তি প্রকাশ করে। কালো মোটা অসুন্দর মেয়ের ভাত নাই। সে পড়ালেখায় ভালো কি ভালো না, তার কোন গুনটুন আছে কী নেই, সেইসব চাপা পড়ে যায় দাদীনানীর হায় আফসোসের কান্নার তলে। মায়ের দীর্ঘশ্বাসে।

‘মেয়ে আমার কালো হয়েছে গো! মেয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছে গো! কী করি কী করি!’ মেয়ে চোখের জলে ভাসলো কী ভাসলো না, মেয়ের মেরুদন্ড বেঁকে বেঁকে মাটিতে মিশলো কী মিশলো না, তাতে তাদের কী যায় আসে! সে সব খেয়ালই করে না কেউ। আপাতত এই কালো কুচকুচে মেয়ের, এই মোটা মেয়ের রূপহীনতার দায় তারই। দিনশেষে সে কিন্তু তাদেরই মেয়ে। তবু যেন সে তাদের মেয়ে নয়। দাদী কয়, ‘হায় হায়! ক্যামনে হলো এতো কালো! এই বংশে কেউ তো ছিলা না অ্যামন! হায় হায় হায়! এ কী সব্বোনাশ নিয়ে এলো কালো মেয়ে’।

মা কান্দে, বাপ শ্বাস ফেলে, ভাইবোন টিটকারি দেয়। কালো মেয়ের জীবনে নাস্তানাবুদের অধ্যায় শুরু। এই পনেরো সালেও! এ আমার নিজের চোখে দেখা। নিজের কানে শোনা। তো কালো মেয়ে নিজের মনে থাকে। নিজের জগতে থাকে। কিন্তু লোকজন ভিড়ভাট্টায় এলেই তার জড়োসর লাগে। তার কালো হাতে কালো আঙ্গুল। সে সেই হাত মেলে ধরে না লোকের সামনে। ফর্সা অতিথির সামনে সে প্রায় মরো মরো। হায়! আমার নিজের চোখে দেখা! জগতে কালো ছেলের দুঃখও কম না। কালো ছেলেও ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম মাখে। এশিয়ান স্কাইশপে ফোন দেয়- তিন দিনে ফর্সা হওয়ার ক্রিমের জন্য।

তবে দিনশেষে বাপ-মা তার ও তাদের সম্মিলিত মনোকষ্ট ঘুচাতে এক ধবধবে ফর্সা নারী ধরে এনে গছিয়ে দেয় ‘বউ’ বলে। এই ফর্সা বউ তার কালোত্বের কষ্ট ষোল আনার মধ্যে সাড়ে পনেরো আনাই ঘুচিয়ে দেয়। আর অন্যপক্ষে? কালো মেয়ের বরই জোটে না। মূলোর মত পণের লোভ ঝুলিয়ে দিলে জোটে, তবে সে বর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথকথিত সৌন্দর্য আর যোগ্যতার বিচারে নেহাতই পেছনের সারির।

আর যদি দৈবাত, দুর্ঘটনাক্রমে কালো কন্যার কপালে জোটে ফর্সা আর লোকের চোখে সুন্দর বর, ব্যস… ‘কী কপাল করে এসেছিস রে! এই চেহারায় এতো ভালো বর পেলি কোন পূন্যে?’ নিজের চোখে দেখা।

Shams
শারমিন শামস

৩. আমার এক প্রাক্তন অফিসের উচ্চপদস্থ সহকর্মী তার নারী সহকর্মীদের বুকের দিকে না তাকিয়ে কোন কথা বলতে পারেন না। তার অনুরোধ আদেশ নির্দেশ কুশল বিনিময় স্নেহ-শাসন সবই বুকের দিকে দৃষ্টি রেখেই চালিয়ে যান। কেউ কোনদিন প্রতিবাদ করে না। আমিও করি নাই। কিন্তু তিনি নারীর ব্যাপারে সোচ্চার কণ্ঠ। কাব্য প্রতিভাও আছে। নারীর জন্য নিবেদিত পংক্তিমালা। তো সব নারীরই স্তন আছে। তার মায়ের স্তন্যপান করে তিনি বড় হয়েছেন, আজ এত বড় স্বনামধন্য হয়েছেন। বিবাহিত, সন্তানের বাপ। তবু নারীদেহ নিয়ে ফ্যান্টাসি কাটিয়ে উঠতে পারেন নাই।

মায়া লাগে। করুণা জাগে। চোখ দিয়ে চেটেপুটে খান। এতো আমার পাড়ার রিকশাওয়ালাও করে। সে অবশ্য বাসায় গিয়ে নারী অধিকার নিয়ে কলাম লেখে না। রিকশা ঠেলে আর মেয়ে যাত্রীদের বুকের দিকে আড়ে আড়ে চায়। আমার বিখ্যাত সহকর্মী ক্ষমতাবান ও প্রগতিশীল, সোচ্চার কণ্ঠ, জাতির বিবেক, তিনি সোজাসুজি তাকান বক্ষের দিকে। তিনি নির্ভীক।

(চলবে)

(অন্যদেশ থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন: