জয় আজাদ: আমাদের দিনাজপুরে বেকার ছেলে-মেয়েদের আয়ের একটা সুন্দর উৎস ছিল ফ্রিল্যান্সিং। যা নিয়ে সরকারের আইসিটি বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসুচি চালু রয়েছে, এবং হাতে রয়েছে হাজারও প্ররিকল্পনা। কারও কোন সাহায্য ছাড়া; মানে কাউকে কোন প্রকার তেল না দিয়ে নিজের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ সংসারের জন্য সৎ পথে রোজগার করার ফ্রিল্যান্সিং একটা বিশাল মাধ্যম হিসেবে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে। জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের অনেকে এখন আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে শুরু করেছেন।
গত বুধবার (১৮ নভেম্বর) থেকে এই ছেলে-মেয়ে ফ্রিল্যান্সার গুলোর ভবিষৎ মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারন একটাই যোগাযোগ বন্ধ। আমাদের পিছিয়ে থাকা দিনাজপুরে প্রায় ১২০০০ বেকার ছেলে-মেয়ে এই ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা পেষার সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িত, যেখানে আজও ভাল ইন্টারনেট সংযোগের জন্য রিতিমত যুদ্ধ করতে হয়। একটি বেসরকারি অনলাইন সংস্থার হিসেবে সারা বাংলাদেশে উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৭,৫২,০০০ এদের মধ্যে শুধু রাজধানি ঢাকা থেকে কাজ করছে প্রায় ৬ লক্ষ ছেলে-মেয়ে। বিবিসি সুত্রে জানা যায়, দেশের এক প্রান্ত ঠাকুরগাঁর উদ্যোক্তা শুচিস্মিতা বোস। নিজের একটি ছোট বুটিক চালান। সেই সাথে গত বছরখানেক ধরে তিনি কল্কা ডট কম নামে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে টেইলারিং এর কাজ করছেন। এই অনলাইন অর্ডারের একটি অংশ আসে ফেসবুক থেকে, সরকারী নির্দেশের কারণে গত কয়েকদিন ধরেই যেটি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। শুচিস্মিতা বোস বলেন “ফেসবুকে যে অর্ডার আমি পাই, সেটি হয়ত অনেক টাকার অর্ডার না। কিন্তু যেটাই আসত তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে গত কদিন ধরে।
বাংলাদেশের অনলাইন নির্ভরশীল উদ্যোক্তা এবং ফ্রিল্যান্সাররা যে পরিমাণ উপার্জন করে তাতে করে তাদের কোন সরকারি-বেসরকারি চাকরির দ্বারস্থ হতে হয় না। সরকারি চাকরির একটি পদের জন্য যেদেশে ৬০০ প্রার্থী আবেদন করে, সে দেশে চাকরিমুখি না হয়ে নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান গড়া মানুষগুলোর ভবিষৎ আজ অনিশ্চিত।
ফেসবুক, স্কাইপ, ভাইবার, হোয়াটসআপ বন্ধ থাকায় উদ্যোক্তা এবং ফ্রিল্যান্সারেরা অনেকে এখন আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে শুরু করেছেন। কারণ তাদের আয়ের মূল উৎস হচ্ছে উন্নত বিশ্ব, যেখানে ক্লায়েন্টদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হতো, যোগাযোগ বন্ধ তাই উপার্জন বন্ধ। বিবিসি আরও জানায় ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা করেন এমন অনেকে অভিযোগ করছেন যে তাদের ব্যবসা মোটামুটি বসে গেছে। আবার অনলাইনে সংবাদ পরিবেশনকারীরা বলছেন, ফেসবুক না থাকার কারণে তাদের পেজে ভিজিটরের সংখ্যা দারুণভাবে কমে গেছে।
ঠিক কতটুকু নিরাপদ মনে হলে সোশ্যাল মিডিয়া আবার চালু হবে তা আমাদের জানা নেই। আদৌ সে রকম নিরাপদ কি বাংলাদেশ কখনও ছিল? নিরাপত্তা নিয়ে এত চিন্তিত কখনই সরকারকে দেখা যায়নি যেটা এবার হঠাৎ করে শুরু করেছেন। দেশের নিরাপত্তা নিয়ে সত্যি সত্যি চিন্তিত থাকলে তখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতো যখন পেট্রোল বোমায় শত শত মানুষ জ্বলছিল। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকলে সেদিন এই ইচ্ছা কথায় ছিল যখন নির্বাচনি সহিংসতায় হাজারও সংখ্যালঘুদের কপাল পুড়েছিল। কই তখন তো সরকারের মনে হয়নি দেশের মানুষ নিরাপদ না। নিরাপত্তার অজুহাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে বন্ধ রেখে উদ্যোক্তা এবং ফ্রিল্যান্সিং পেশাকে পঙ্গু করা ছাড়া এর আর কোন উপকার আছে বলে আমি দেখি না।
প্রতি বছর দেশে যারা কোটি কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তাদের সাথে দেশে থাকা স্বজনদের যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখন সব বন্ধ, বিদেশে কর্মরত আমাদের প্রবাসী ভাই বোনেরা কি পরিমান চাপের মুখে থাকছেন আমাদের কথা চিন্তা করে, সে দিকটা সরকারের একবার লক্ষ করা উচিৎ। আমাদের দেশের অবস্থা এখনও এত খারাপ হয়নি যা দেশের পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। বাংলাদেশ পুলিশ দেশের শান্তি শৃঙ্খলার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিয়োজিত। যারা আপনাদের এক হুকুমে আগুনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে সদা প্রস্তুত।
একজন কনস্টেবল যখন পিকেটারের ইটপাটকেল, পেট্রোল বোমা উপেক্ষা করে জন নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করে, হাতে একটা কাঠের বন্দুক নিয়ে যখন কোন জঙ্গী, সন্ত্রাসি, জলদস্যু কিংবা ডাকাতের পিছনে ধাওয়া করে তখন সে তার পরিবার নিয়ে চিন্তা করে না। অথচ এদের জীবন যাত্রার মান খুবই নিম্নমানের, এরাও মানুষ এরাও একটু ভাল থাকতে চায়। বাংলাদেশ পুলিশ প্রশাসনকে উন্নত করে ছোট বড় সকল শ্রেনীর পুলিশের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন নিশ্চিৎ করুন। এরাই বরাবরের মত নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশের এবং দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনে শান্তি শৃঙ্খলা নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করবে। তখন আর সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ রাখার প্রয়োজন হবে না।
যারা দেশের বা দেশের জনগনের অনিষ্ঠ করার বাসনা রাখে তারা কখনই সোশ্যাল মিডিয়ার তোয়াক্কা করে না, টাকা থাকলে সব কিছু সম্ভব। তারা অর্থের বিনিময়ে সাধারন যোগাযোগের উৎস মোবাইল বা টেলিফোন ব্যবহার করে যোগাযোগ করে যাচ্ছে। দেশে ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপি, ভাইবার, হোয়াটসআপ বন্ধ থাকলেও তাদের কিছু এসে যায় বলে মনে হয় না।
দিনাজপুরে বিদেশী হত্যার চেষ্টা, শিয়া মসজিদে গুলি করে হত্যা করা হলো মুয়াজ্জিনকে – বিদেশীদের গুলি করার মতো ঠিক একই কায়দায় তিন যুবক- মোটর সাইকেলে। ঐদিকে আবার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, ফরিদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, সাহসী মানুষ অলক সেনকে নিজের বাসার সামনে নৃশংস ভাবে কুপিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রংপুর দিনাজপুরসহ ১০টি খ্রিষ্টান মিশনের প্রধানদের হত্যার হুমকি এসব কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে হয়নি। সাধারণ মোবাইল যোগাযোগের মাধ্যমে হচ্ছে। তাহলে আপনার হয়তো উচিৎ এখন দেশের মোবাইল সংযোগ গুলি নিয়ন্ত্রণ করা।
আবেগ দিয়ে রাষ্ট্র চলে না, ইন্টারনেটে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে প্রতিমন্ত্রী যে উপমাগুলি ব্যবহার করেছেন তার খণ্ডন আবার আমরা ইন্টারনেটে বসেই পেয়ে গেছি।
ভুল চুক হতেই পারে, তাই বলে ফেসবুকের মাধ্যমে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রাপ্তি আমরা কিছুতেই মুছে যেতে দিতে পারি না। ফেসবুকের কারণেই কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রবিরোধী রাজাকার আলবদর বাহিনীর নেতাদের শাস্তির দাবি তুমুলভাবে মানুষ সমর্থন করেছিল। ফেসবুকের কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এসে এই আন্দোলনে সমবেত হয়েছিল। ফেসবুকের কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি উন্নয়নগুলোর সংবাদ আমরা সে এলাকার সরকারি ফেসবুক পেজ থেকে পাই।
বাল্যবিবাহের তথ্য আমরা থানায় না জানিয়ে সরাসরি উপজেলার ইউএনও’র ফেসবুক পেজে জানিয়ে উপকৃত হয়েছি। রাষ্ট্র পরিচালনা কিভাবে করে তা আপনারা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল জানেন, এই বিষয়ে আপনাদের উপদেশ দেয়া আমাদের কর্ম না। কিন্তু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার মত সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে দেশের আরেকটি মৌলিক চাহিদার আকার ধারণ করেছে। যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এবং প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়জেদ জয়ের অমূল্য অবদান।
এক সময় দেশের কোন এক সরকারের আদিম নিতিমালার কারণে ইন্টারনেটে আমরা আজও পিছিয়ে আছি। সে সময় তারা দেশের নিরাপত্তার অজুহাতে আন্তঃসাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ গ্রহণ করেনি, যার কারনে আমদের দেশে আজও উচ্চমূল্যে অত্যন্ত নিম্নগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নিজ উদ্যোগে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নানান শর্ত সাপেক্ষে দেশের জন্য দেশের উন্নয়নের লক্ষে বিকল্প উপায়ে সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ নিতে হয়েছে।
বাংলাদেশে এডিএসএল, ওয়াইমেক্স, 3G ইন্টারনেট সংযোগ মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌছে দেওয়ার কৃতিত্ব শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশের ক্ষুদ্র আয়ের মানুষগুলোর কাছে উন্নত প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার মতো ক্ষমতা শুধু তাদেরই আছে। এই কৃতিত্ব কেন আমরা ম্লান হয়ে যেতে দিব?
আমরা যারা ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে দেশের উপকারে আসছি তাদের সংখ্যা এখন অসংখ্য, আর যারা এটা নোংরা উপায়ে ব্যবহার করছে তাদের সংখ্যা অতন্ত নগণ্য।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, দেশের ১৭,৫২,০০০ ফ্রিল্যান্সার এবং উদ্যোক্তাদের রুজি রুটির মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া চালু করুন। হঠাৎ করে দেশের ১৭,৫২,০০০ ফ্রিল্যান্সার এবং উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সহজ কাজ হবে বলে মনে হয় না। আজ এক প্রবাসী ভাই কাজী মামুনের চিঠি পড়েছি।
তার ভাষায় আবারও অনুরোধ করছি আমাদের অর্ধেকের বেশি ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ ক্যাপাসিটি অব্যবহৃত পড়ে থাকছে, দয়া করে ইন্টারনেট এর স্পীডটাকে সবার জন্য অন্তত দ্বিগুণ করে দিন এবং আইএসপিগুলো এই শর্ত দিয়ে দিন যে তাদের সরকার দ্বিগুণ ব্যান্ডউইডথ দিচ্ছি তারাও গ্রাহকের কাছে দ্বিগুণ ব্যান্ডউইডথ পৌঁছে দিবে- এরজন্য সরকার তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিবো না, তারাও গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতে পারবে না।
বাংলাদেশের ছেলেরা এখন গুগল-নাসা-মাইক্রোসফট এর নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছে, তাদের ২/১ জনকে সাময়িকভাবে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিন, আমরা নিশ্চিত দেশের ডাকে তারা আসবেই। তারা অবশ্যই পারবে আপনার চাহিদামাফিক দেশের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট গড়ে দিতে।
মাননীয় ডাক ও টেলি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী, অনুগ্রহ করে ক্ষমা চেয়ে আমাদেরকে লজ্জিত করবেন না। বরং এমন উপায় অবলম্বন করুন যাতে করে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে। আপনার জন্য আমাদের সকলের শুভ কামনা রইল।