ফেসবুক পোস্ট এবং আমাদের ধর্মান্ধতা

Muzzle me notসুমন্দভাষিণী: সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট শামীমা মিতুর একটি পোস্ট নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটছে। তার ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট হচ্ছে, আবার আসছে, আবার যাচ্ছে। প্রচণ্ড হুমকির মুখে আজ মিতু। তবে এবার তিনি জামাত-শিবিরের হুমকিতে নেই, এবার হিন্দু মৌলবাদীদের হুমকির মুখে। মৌলবাদীদের চেহারা দেশে-দেশে, যুগে-যুগে একই হয়, তাদের সবার রক্তেই একই ধারা প্রবহমান।

মিতুর লেখা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, সবাই একমত হবেন, এমনটিও কেউ আশা করে না। আমরা কেউই কোনকিছুতে সহজে একমত হই না। বিশেষ করে লেখাটা যদি হয় ধর্মের গোঁড়ামি নিয়ে, তাহলেই হয়েছে। যে ধর্মকে নিয়ে লেখা, সেই মতের লোকজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে, হুমকি-ধামকি দেয়, গালিগালাজ করে, মেয়ে হলে তো গালিগালাজের ভাষাও নির্দ্দিষ্টই থাকে। তখন অন্যধর্মের লোকজন আনন্দে বগল বাজায়। ভাবটা এমন যে, এই যে দেখো, বলেছিলাম না! তারা তখন সবাই প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী।

কিন্তু সেই প্রগতিশীলতাই চুপসে যায় বা হাওয়ায় মিশে যায়, যখন বজ্রপাতটা তাদের ঘরে হয়। একেকটা মানুষ মনে-প্রাণে-শিক্ষায়-আচরণে কতটা সাম্প্রদায়িক, অন্য ধর্মবিদ্বেষী হতে পারে, তখনই প্রমাণ হয়ে যায়।

আমার এক বোনের সাথে অনেক বছর পর দেখা। হাসিতে সে উস্তাদ ছিল বরাবরই। সেই বোনই সেদিন আক্ষেপ করে বলছিল, জীবনটা কঠিন হয়ে গেছে শুধুমাত্র এই ধর্মান্ধদের কারণে। মুসলমানদের মধ্যে যেমন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি চলছে, ওয়াহাবিজম চর্চা বেড়ে গেছে, তেমনি হিন্দুদের মধ্যেও ইসকন নামক একটা গোড়ামির পত্তন ঘটেছে।

এই উপমহাদেশে ধর্মচর্চা বরাবরই ছিল, বাড়াবাড়িও যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু এখনকার মতোন এমন ভয়াবহ আকার হয়তো ছিল না। এখন মতের অমিল হলেই চাপাতির কোপ পড়ে, নয়তো দেশান্তরি হতে হয়, একেবারেই তা না হলে গালিগালাজ খেয়েই বেঁচে থাকতে হয়।

শামীমা মিতুর সাম্প্রতিক পোস্টটি ছিল এক হিন্দু পরিবারকে নিয়ে, যারা নববধুকে বিয়ের রাতেই জগন্নাথ দেবের ভক্ত গুরুদেবের কাছে সমর্পণ করে যায়। পোস্টটির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে, সেখানে একজন সাংবাদিক হিসেবে শামীমা মিতুর দায়িত্ব তার সত্যাসত্যের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ হাজির করা। কিন্তু আমরা তাকে সেই সময়টুকুও দেইনি। শুরু হয়ে গেছে বাকযুদ্ধ। এমনকি রিপোর্ট করে তার ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাক্টিভেটও করিয়েছি, আবার শিবসেনা গ্রুপে যেখানে ফলোয়ারের সংখ্যা পাঁচ কোটির মতো, সেখানে পিন পোস্টও করে রাখা হয়েছে।

যেদেশে খুন করে বা হাজার কোটি টাকা লোপাট করেও দিব্যি ‘সম্মানিত’ হয়ে থাকা যায়, সংসদ সদস্য হওয়া যায় বা থাকা যায়, সেখানে একটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে এই বাড়াবাড়ি মানুষের ধর্মান্ধতারই প্রমাণ দেয়।

ইসলাম নিয়ে লিখে আমাদেরই কাছের বেশ কয়েকজন এখন দেশান্তরি, মুরতাদ হয়েছেন আরও অনেকেই, অনেক আগে থেকেই, তসলিমা নাসরিন তো ফিরতেই পারলেন না দেশে। হিন্দুরাও কম যায় না, কে বলেছে তারা সংখ্যালঘু? আমি তো দেখি, তারাও বেশ সংখ্যাগুরুর আসনেই। কেবল নিজেদের অধিকার লঙ্ঘিত হলেই তারা সংখ্যালঘু হয়ে যায়, কিছুই পারে না করতে।

শামীমা মিতুর পোস্ট নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখলাম হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে, তার ছিটেঁফোটাও যদি দেখতাম তাদের ভূলুণ্ঠিত অধিকার আদায়ে, বা হিন্দু নারীদের সমানাধিকার দেয়ার ব্যাপারে, তাহলেও না হয় মনটাকে বোঝাতে পারতাম, না তারা সহি পথেই আছেন। দেশে দেশে যে ঐক্য পরিষদ বলে সংগঠনগুলো আছে, তারা কিছুদিন পরপর বিদেশের মাটিতে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে সভা-সেমিনার করা ছাড়া আর কোনো কাজ করেছে বলে আমার জানা নেই।

একজন ব্লগার বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন সম্প্রতি, সেই ঐক্য পরিষদের একজন জানতে পারলেন সেই ব্লগারের বন্ধুটি অন্যধর্মের। সাথে সাথেই তার ওপর থেকে মমতার ছায়াটুকু সরিয়ে নিলেন। আরেকটি মেয়ে দেশে, মেয়েটি নির্যাতিতা। কিন্তু বন্ধু হয়েছে অন্যধর্মের। এখন তাকে কি করে এই ‘বন্ধু’ থেকে সরানো যায়, তারই তৎপরতা চলছে। দুটি উদাহরণ দিলাম। এরকম হাজার হাজার উদাহরণ আছে হাতের কাছে।

এরকম বিবৃতিদাতা সংগঠনের তো অভাব নেই বিশ্বজুড়ে, সবাই নিজের পকেট সামলাতেই ব্যস্ত। ধর্মের লেবাস গায়ে লাগিয়ে তারা ধর্মোদ্ধারের চেষ্টায় আছেন। এদিকে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা যখন শূন্যের কাছাকাছি চলে এসেছে, তখনও তারা ব্যস্ত সেমিনারে। এসব ক্ষেত্রে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। তাকিয়ে আছে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক সরকারের দিকে, যদি তারা তাদের উদ্ধার করে, সেই আশায়।

নিজের দেশ, নিজের মানুষ, নিজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ভুলে কেবলই ধর্মাশ্রয়ী এই মানুষদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কিছুই দেয়ার নেই। এরা যতো গোঁড়া হবেন, শামীমা মিতুদের সংখ্যা ততোই বাড়বে, এটা তারা ভুলে যান।

শেয়ার করুন: