ঢেউয়ের ওপর ভেসে বেড়ানো মেয়েরা

Skatingউইমেন চ্যাপ্টার: সার্ফিং বিষয়টাই এদেশে একেবারে নতুন। মাত্র কয়েক বছর আগে এর যাত্রা শুরু। কিন্তু এরই মধ্যে বেশ নামযশ কুড়িয়ে নিয়েছে সমুদ্রপাড়ের দামাল ছেলেমেয়েরা। বিশেষ করে পাথর কুড়ানি মেয়েরা। ওরা এখন নিয়মিত প্রশিক্ষণ পেয়ে ঢেউয়ের আগে আগে দৌড়ে বেড়ায় পানির ওপর, ডিগবাজি খায়, যেন বিশাল আকারের ঢেউগুলো ওদের হাতের মুঠোয়। ওরা প্রমাণ করে দিয়েছে ছেলে সার্ফারদের চেয়ে ওরা কোন অংশেই কম না।

কিভাবে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা?

২০০৯ সালে ভানেসা রুড এবং তার স্বামী রাশেদ আলম লাইফসেভিং এবং সার্ফিং ক্লাবের মাধ্যমে কক্সবাজারে মেয়েদের মধ্যে সার্ফ অনুশীলন এবং ইংরেজি শিক্ষা শুরু করেন। ভানেসা বলছিলেন, প্রথমদিকে কমিউনিটি তখন অতবেশি আগ্রহী ছিল না তাদের এ কাজে। কিছু বাধার মুখেও পড়তে হয়। যে দেশে শতকরা ৪০ ভাগ মেয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা পায় কেবল, এবং ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী ৪৯ লাখ শিশু জড়িয়ে পড়ে নানারকম শিশুশ্রমের সাথে, সেখানে শুধুমাত্র মেয়েদের সার্ফিং শেখানো এবং স্কুলে পড়ানো বেশ কঠিনই ছিল। কিন্তু মেয়েরা এসেছে। তারা নিজেদের ভিতরের সম্ভাবনাটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছে একইসাথে। এ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ সার্ফিং ফেডারেশন আয়োজিত একটি টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাচ্ছে তারা। যেখানে বড় অংকের অর্থ পুরস্কার অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। গতবছরও প্রতিযোগিতায় দুটি মেয়ে স্থান পেয়েছিল।

Surfing girlসার্ফিংয়ে মেয়েদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে ভানেসা বলেন, তার স্বামী রাশেদ হচ্ছে বাংলাদেশে নতুন লাইফগার্ড সার্ভিসের প্রধান এবং সার্ফ ক্লাবের একজন। এই মেয়েগুলো সাধারণত সমুদ্র সৈকতেই থাকতো, পানি, চিপস, ডিম বিক্রি করতো। রাশেদ একদিন এই মেয়েদের সাথে কথা বলে সার্ফ করার কথা জানায়। ওরা আস্তে আস্তে আসা শুরু করে। শুরুতে সপ্তাহে একদিন অনুশীলনের আয়োজন করাও কঠিন ছিল। কারণ তাদের বাবা-মা ওদের আয়ের ওপরই বেশি জোর দিতো। যে দুই ঘন্টা ওরা সার্ফ করবে, সেই দুই ঘন্টা ওদের আয় বন্ধ থাকছে। কাজেই প্রথমদিকটা অত্যন্ত ধীরেই চলেছে এই অনুশীলন পর্ব।

মেয়েদের সার্ফিং এবং স্কুলে আসার ক্ষেত্রে পরিবার এবং কমিউনিটির বাধাকে কিভাবে অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে, এর উত্তরে ভানেসা বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, বলা চলে পুরুষদের পৃথিবী এটা। মেয়ে হিসেবে নিজে থেকে কিছু করা, তার ওপর পানিতে একা একা কিছু করা, স্বাভাবিক ছিল না মোটেও। মেয়েগুলো সৈকতে কাজ করতো। ১২-১৩ বছর হলেই ওরা নানারকম অপরাধের সাথে, যৌনকাজের সাথে জড়িয়ে পড়তো। ওদের কমিউনিটি ভাবলো যে, ওরা একা নিশ্চয়ই অন্য কিছু করছে, তাই বাধা দিতো। পাশাপাশি ওরা সবসময় ছেলেদের ইভটিজিং, এমনকি নির্যাতনেরও শিকার হতো। যারা তাদের সার্ফিংয়ে সাহায্য করতো, সেই ছেলেরাও ওদের ওপর নির্যাতন করার চেষ্টা করতো।

রাশেদ তখন ভানেসাকে উৎসাহিত করেন এই মেয়েদের জন্য এরকম একটি স্কুল খোলার ব্যাপারে। ভানেসা বলছিলেন, ‘পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাতে কিছু কাগজপত্রসহ ওদের কাছে আসতাম, ওদেরকে ছবি দেখাতাম। এভাবেই আস্তে আস্তে হৃদ্যতা গড়ে উঠে, শুরু হয় ইংরেজি শেখার ক্লাস। আমি কথা বলতাম, রাশেদ তা অনুবাদ করে দিতো ওদের। এভাবে তারা ধীরে ধীরে নিয়মিত আসা শুরু করে এবং আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ে আমাদের সাথে’।

ওরা অনেক কিছুই শিখেছে। ৫০টির মতো ইংরেজি শব্দ জানে, পড়তে-লিখতেও জানে সেই শব্দগুলো। এর আগে ওদের কোনো লেখাপড়াই ছিল না। বাবা-মা তাদের শেখাতেও চায়নি। কিন্তু এখন কিছু মানুষ আছে, যারা ওদের সত্যিই পড়ালেখা শেখাতে চায়। ওদের শেখানো মানেই বিনিময়ে কিছু পাওয়া।

Girlsভানেসার ভাষায়, পানিতে নামার সাথে সাথে ওরা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। আরেকটা পরিবর্তন হচ্ছে, সার্ফ ক্লাবে তরুণ ছেলেদের যে কমিউনিটি, ওরা আর ওদের দিকে অন্যভাবে তাকায় না, উত্যক্ত করে না। উপরন্তু ছেলেরাও ওদের উৎসাহিত করছে। প্রথমবারের মতো এই মেয়েগুলো শ্রদ্ধা পেতে শিখেছে।

আরও একটা জিনিস, মেয়েগুলো দেখছে যে ওদের কথা এখন শোনা হয়। ক্লাবে সবাই ওদের ভালবাসে, প্রশংসা পায় এবং নিরাপত্তাও পাচ্ছে। এসব বিষয়ে তাদের আগে কোন জ্ঞানই ছিল না। বাড়িতে কোনদিন মেয়ে হিসেবে সম্মানটুকুও পায়নি। সবসময় বাড়ির ভাল খাবারটুকু পুরুষদের জন্যই যেখানে তোলা থাকে, আর সবার পরে খেতে হয়, সেখানে ক্লাবে ৫০টি ছেলের মধ্যে সবার আগে তাদের খাবার দেয়া হয়, এটাই পুরো বিষয়টা পাল্টে দিয়েছে।

ওরা শুধু সার্ফিংই করছে না, স্কেটিংও করছে, শিখছে, মানুষের জীবন রক্ষা করছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য একটাই, ওদের পরিবারগুলো যেন মেয়েদের ভিতরের এই পরিবর্তনগুলো দেখতে পায়, অনুভব করতে পারে। আর এটা হলেই ওরা একদিন আরও বড় কিছুর জন্যে বেরিয়ে আসতে পারবে পারিবারিক ওই আবহ ছেড়ে এবং ওরা তাদের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে পারবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.