‘আমি অভিজিৎকে চিনি না’

Abhijit
সম্ভবত এটাই ওদের জীবনের শেষ যুগল ছবি, এরপরেই ওরা হামলার শিকার হয়

শারমিন শামস্: এদেশে মানুষ খুনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্থানটি তবে বইমেলা! অবাক নই। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুলের ওপরে গড়াড়ড়ি খাওয়া দুই তরুণের ছবি দেখেছিলাম ফেসবুকে। ধাক্কা খেয়েছিলাম কি? চোখে সানগ্লাস, রুচিহীন পোশাকের সেই দুই তরুণ পেরেছে সবার চোখের সামনে এই কাজটি করতে। কেউ প্রতিবাদ করেনি।

যে বইমেলা প্রাঙ্গনে লাখো মানুষের ভিড় জমছে প্রতিদিন, সেখানে সবার নাকের ডগায় দু’দুটো জলজ্যান্ত মানুষকে মিনিটখানেক ধরে কুপিয়ে চলে গেল তারা। আমরা তখন কী করছিলাম? রক্তাক্ত অভিজিৎ পড়ে আছে উপুড় হয়ে। পাশে বন্যা রক্তাত্ত দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইছেন। দুই হাত দূরে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো ‘মানুষ’। তারা দেখছেন। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে বন্যার শরীর থেকে। অভিজিতের মাথার খুলি কেটে মগজ বেরিয়ে গেছে। তারা দেখছেন। এসব দৃশ্য বিনা টিকেটে দেখা সম্ভব হয়েছে। তাই যতটা পারেন দেখে নিচ্ছেন।
ফেসবুক জুড়ে হাহাকার।

এই হাহাকারের স্থায়ীত্ব মাসখানেক। এরপর নতুন কোন ইস্যুতে আমরা ভুলে যাবো অভিজিৎ আর বন্যাকে। যেমন ভুলে গেছি রাজীবকে। আমি জানি, আমি এই বলে নিশ্চিত করছি আপনাদের, এর কোন বিচার হবে না। অভিজিৎ রায় বোকা। তিনি ভুল দেশে জন্মেছেন জেনেও ফিরে এসেছেন এই বইমেলায়, মৃত্যুর আশঙ্কা মাথায় নিয়ে। বোকা অভিজিৎ!

২০০৪ সালে হুমায়ূন আজাদকে কোপানোর খবরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। ভয় করেছিল অনেক। আমার প্রিয় লেখককে ওরা কুপিয়েছে। রক্তে লাল বইমেলা। তবু তো এখনও বইমেলায় যাই। হাসি ঠাট্টা করি। উৎসবে যোগ দেই। কোন বিচার হয়নি।
মানববন্ধন আর মিছিলে কিছু যায় এসে যাবে কি কারো? ওরা তো হিসেবের খাতাতে রেখেছেই- পরদিন একটা মানববন্ধন, মিছিল, কালো ব্যাজ, এইসব। মাঝখান থেকে ফুরিয়ে গেল অভিজিৎ। একটি জলজ্যান্ত তুখোড় মেধাবী মানুষ নিমেষে নাই হয়ে গেল চাপাতির আঘাতে। নাহ্, আর কিচ্ছু বলার নেই।

সামনের বছর আবারো ফেব্রুয়ারি আসবে, বইমেলা হবে। মেলার মাঠে লাখ লাখ মানুষ। এদের অধিকাংশ বই কিনতে আসেনি। এসেছে ঘুরতে। ঢাকা শহর বিনোদনহীন। তাই রঙচঙে শাড়ি পড়ে তরুণী এসেছে রূপ প্রদর্শনে। তাকে দেখতে চকচকে শার্ট পাঞ্জাবী গায়ে তরুণ এসেছে দল বেধে। এরা মেলাজুড়ে ধাক্কাধাক্কি করবে। নিবিষ্ট মনে কোন তরুণীকে একা বই কিনতে দেখলে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে দেখবে। এইতো আমাদের বইমেলা। বাছবিচার ছাড়া বেরোছে শতশত বই। ভুল বানানে লাখো কবিতা গল্প ভ্রমণ কাহিনী। আমি এইসব দেখে নিজের মনেও আর কষ্ট পাই না। কাউকে বলিনা। বললে বলবে, ‘তুমি সিনিক হয়ে যাচ্ছো।’

শহীদ মিনারে যাবে বলে তরুণ তরুণীর ঘুম হারাম একমাস ধরে। বুটিকগুলোতে সাজসাজ রব। ‘সাদাকালোতে নিজেকে অপরূপা করে তুলতে চান? আসুন আসুন। কিনে নিন আমাদের পোশাক’। ব্যাস্, ভোরবেলা তা গায়ে চড়িয়ে রঙ মেখে বেরিয়ে পড়। এতো সাদাকালো থিমের আরেকটি ভ্যালেন্টাইস ডে। ২১শে ফেব্রুয়ারির শোক দিবসের সেই পবিত্রতা, ভাবগাম্ভীর্য….. এসব নিয়ে আর ভাবিনা। তাই শহীদ মিনারে ফুলের ওপর গড়াগড়ি যায় সানগ্লাস পড়া যুবক। ও তা করতে পারে। কারণ সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবার অধিকার দেয়া হয়েছে। আর আমরা কতিপয় ভাবুক ফেসবুকে গুষ্টি উদ্ধার করে চলেছি। তাই অভিজিৎ মারা গেল। রাজীবের পর অভিজিৎ।

সামনে বছর কে খুন হবেন তা জানতে ঢুকুন ফারাবীর প্রোফাইলে। বাংলাদেশের মেধাবী মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে ফারাবীরা। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর অনলাইন নিউজের নিচে পাঠক কমেন্টস পড়ুন। আতঙ্ক হচ্ছে? কেন? এই হলো ভিতরের চেহারা। আপনি কি জানেন না, বাংলাদেশের পুরোটাই ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে ওরা? আপনি যান মানবববন্ধন করুন, কালো ব্যাজ পড়ুন, কালো প্রোফাইল পিকচার দিন। ওরা চাপাতিতে ধার দিচ্ছে। এবং ওরা তা প্রতিদিন দিয়ে শানিয়ে রাখবে অস্ত্র। একবেলার কর্মসূচি শেষে ওরা ঘুমিয়ে পড়বে না।

পহেলা বৈশাখ পহেলা ফাল্গুন বইমেলা আর টানেনা। কে কত ভালো পোশাকে মেকাপে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তুললো এই প্রতিযোগিতায় আমি বেখাপ্পা বেমানান। অতীষ্ঠ করা ভিড় আমি নিতে পারি না। বাঙালির উৎসবের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে গেছে। আর এই একের পর এক হত্যাকাণ্ড! উৎসবের ভিড়ে মিশে মিশে প্রতিবার তাজা রক্ত বইয়ে দিয়ে ক্রুর হাসি হাসছে আড়ালে ওরা।
আবারো বসছে মেলা। অভিজিতের মৃত্যুর দুঘণ্টা পরই ঝকঝকে তরুণকে দেখেছি বাংলাদেশের ক্রিকেটের বোলিং নিয়ে চিন্তিত স্ট্যাটাস লিখতে। চকচকে তরুণীকে দেখেছি সেলফি পোস্ট করতে। এদের কিছু যায় আসে না অভিজিতের মৃত্যুতে। অভিজিতকে পরশুই ভুলে যাওয়া সম্ভব। এবং তাই হবে।

বইমেলা বসবে। লাখ লাখ লোকের সামনে খুন হয়ে যাবে অভিজিৎ। রক্ত ধুয়ে আবারো বসবে মেলা। রোদেলা স্টলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে আমরা প্রকাশকের দুরাবস্থা নিয়ে গল্প করবো। একটি ঘৃণিত জাতির ব্যর্থতার কাহিনী। তার চেয়ে ভালো এই চুপ করে থাকা। এই ভালো দূরে দূরে থাকা। অভিজিৎ বন্যাকে ভুলে থাকা। আমি এদের কাউকে চিনি না।

লেখক- সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন: