মেয়েরা যদি মায়ের জাত, ছেলেরা কি বাবার জাত? 

Feminism 2নাজিয়া হক অনি: একটা মেয়েকে বলা হয়, মেয়ে হয়ে জন্মেছ যখন বিয়ে করতেই হবে, একটা ছেলেকে কেন বলা হয় না তোমাকে বিয়ে করতেই হবে? একটা মেয়েকে বলা হয়, মেয়ে হয়ে জন্মেছ মা হতে না পারলে তোমার জীবন বৃথা। একটা ছেলেকে কেন বলা হয় না বাবা হতে না পারলে তোমার জীবন বৃথা? বিয়ে তো মেয়েদের একার হয় না, একটা ছেলেরও হয়। তাহলে কেন একটা মেয়েকেই শুধু বিয়ের জন্য পরিবার থেকে সমাজ থেকে চাপ দিয়ে তার শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলার অবস্থা হয়? কেন একই বয়সের একটা ছেলেকে বিয়ে না করে আরও পড়াশোনা করার জন্য, আরও বড় হবার জন্য তাগিদ দেয়া হয় আর মেয়ের জন্য ঠিক উল্টো ব্যবহার করা হয়?

একটি মেয়ের শিক্ষা, প্রতিভা, পেশা, উপার্জন যত গুন আছে সবকিছুর সর্বশেষ লক্ষ্য একটি ভাল বিয়ে হওয়া!! বিয়ে “হওয়া”, বিয়ে “করা” না কিন্তু। কেন? বিয়ের মাধ্যমে একটা মেয়েকে উদ্ধার করা হয় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার কাছ থেকে। শত সহস্র গুন থাকার পরও একটি মেয়ে তার পিতামাতার জন্য একটি “দায়”। এই দায় থেকে তাদের মুক্ত হতে হয়। পুত্রদায়গ্রস্ত কোন পিতা মাতা নেই কিনা তাই তারা উদ্ধারও হয়না, তারা বরং উদ্ধার করে, ছেলের বিয়ে করায় বা করে, আর মেয়েদের উদ্ধার হয়, বিয়ে হয়। একটা মেয়ের কোটি কোটি টাকা থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে কোন ছেলের সাথে জোড়া না লাগানো যায়, সমাজের শান্তি হয়না, খচখচ করতে থাকে কাটার মত সেই মেয়েটি সবার গলায়।
কেন একটা মেয়ের সবার সামনে নিজেকে সুন্দর প্রমাণ করতে রং মেখে দাঁড়াতে হয়? কেউ কেউ বলতে পারে নিজের কাছে ভাল লাগার জন্য? সত্যি? কেন? আয়নার দাড়িয়ে নিজেকে কোন রং ছাড়া দেখতে ভাল লাগে না? কেন লাগে না? ঠিক কোন বয়স থেকে একটা মেয়ে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকতে পেরে রং মাখানো শুরু করে? কেন করে? কী ভেবে করে? সে যখন বুঝতে পারে এই সমাজে তার রুপের মূল্যই সবচেয়ে বেশি, তার গুনের নয়, তার মস্তিষ্কের নয় তখনই সে মস্তিষ্কের চর্চা বাদ দিয়ে বা একপাশে সরিয়ে নিজের রুপের চর্চায় মনোনিবেশ করে, কারন মস্তিষ্ক চর্চার চাইতে রুপ চর্চা অনেক সহজ কিনা। সহজে যা চায় তা পাওয়া যায় রুপের বিনিময়ে। এটাই বোঝানো হয় তাকে। তখনই কি করে?একই কাজ তো একটা ছেলেও করতে পারত, কেন করে না? একটা ছেলেও আয়নার সামনে দাঁড়ায়, নিজেকে দেখতে। অনেক ছেলে তো আয়নার সামনে দাঁড়ায়ও না। আর যে দাঁড়ায়ও বা তার তো নিজেকে আলাদা রং মেখে সুন্দর করতে হয় না। কেন হয়না? তার যা আছে যেমন আছে সেটাই পরিপাটি করে নিতে পারলেই যথেষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কেন একটা মেয়ের নিজের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না? সে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না নাকি তাকে সন্তুষ্ট থাকতে দেয়া হয় না? কেন দেয়া হয়না? কেন কেউ বা কারা সুযোগ পায় তার অস্তিত্বকে এতটা অপমান করতে যে রং না মেখে একটা মেয়ে নিজেকে নিজের কাছেই সুন্দর ভাবতে পারে না? নিজের ভিতরটা ফাঁকা বলে? অন্ত:সারশূন্য বলে? ভিতরে যতটা শূন্য সেটা বাইরে তত চকচকে করে যেন দেখানো যায় সে কারণে? এই একই ইচ্ছা একটা ছেলের মধ্যে কেন জন্ম নেয় না? কারন তাকে আলতো প্রলেপ মেখে সুন্দর সেজে দাঁড়াবার দরকার নেই?

মেয়েরা নাকি মায়ের জাত!! ছেলেদের বাবার জাত তো বলা হয় না। কেন বলা হয় না? বাবার দরকার পরে না একটা বাচ্চা জন্ম নিতে? একটা বাচ্চা বড় করতে? তাহলে কেন এই সমাজে একটা মেয়েকে যেভাবে মা হও মা হও মা না হতে পারলে তোমার জন্ম বৃথা এই গান গেয়ে শোনানো হয় সেরকম একটা ছেলেকে কেন শোনানো হয় না বাবা হও বাবা হও বাবা না হতে পারলে তোমার জন্ম বৃথা? একটা মেয়ে হয় নিজের বাচ্চার মা হবে নাহলে জাতির মা হবে যেমন মাদার টেরেসা হয়েছিল। কিন্তু কারো মা না হয়ে শুধু মানুষ হয়ে বাঁচার কোন অধিকার তার নেই?

আর যদি কোন মেয়ে বলে সে মা হতে চায় না? তার বাচ্চা দেখলেই আদর করার জন্য কোন আহ্লাদী মনে আসে না, তার বাচ্চা লালন পালন করার মত দায়িত্ব নিতে সে ইচ্ছুক না, আগ্রহী না তবে তাকে ধরে নেয়া হয় সে অস্বাভাবিক। কিন্তু এই একই আচরণ একটা ছেলের কাছ থেকে আশা করা হয় না। আশা করা হয় না কোন ছেলে বাচ্চা দেখলেই আই কুতুকুতু বলে লাফিয়ে উঠবে বরং এমন আচরণ কে তার পৌরুষের অপমান বলে ধরা হয় অনেক ক্ষেত্রে। তার কারন কি?? মেয়েরা যদি জন্ম দেয় বলে মা হয় বলে স্বভাবতই শিশুদের প্রতি দুর্বলতা থাকতে পারে তবে ছেলেদেরও তো থাকার কথা তাই না?
মাতৃত্বই যদি একটা মেয়ের পরিপূর্ণতা হয় তবে পিতৃত্ব কি একটা ছেলের পরিপূর্ণতা হওয়ার কথা বা? কিন্তু হয় না কেন?

অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম। এবার উত্তর দেই।

এই সমাজে এখনও মেয়েরা শুধুই মেয়ে র‍্য়ে গিয়েছে, মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। নিজের মন, নিজের দেহ, নিজের আত্মা তাদের নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, নিজের অধিকারে নেই এবং সেই অধিকার অর্জন করতে যা করা দরকার তা অর্জন করার প্রচেষ্টাও নেই। যতই পড়াশোনা করুক, যতই উপার্জন করুক, যতই দেশের মানুষের কল্যাণ করুক, যতক্ষণ পর্যন্ত একটা মেয়ে নিজেকে সক্ষম স্বাধীন মানুষ হিসাবে ভাবতে, কল্পনা করতে, বিশ্বাস করতে না পারবে এবং না জানবে এটাই তার প্রথম ও সবচেয়ে বড় পরিচয়, ততক্ষণ পর্যন্ত রং মাখা আর স্ং সাজা অন্তঃসারশুন্য পুতুলের মত তাদেরও মূল্য নির্ধারণ করে কেনাবেচা করা হবে, তাই হচ্ছে, তাই হবে।

তুমি যে অমূল্য, তোমার মূল্য তোমাকেই আগে বুঝতে হবে। নাহলে অন্য কারো দায় পড়েনি তুমি নিজেকে সস্তা থেকে আরও সস্তা বানাবে আর অন্যরা তোমাকে উচ্চমূল্যে সম্মান করবে।

-ডাঃ নাজিয়া হক অনি
শেয়ার করুন: