শুচি সঞ্জীবিতা: এই আয়শা আমার মা, নানী-দাদী, বোন কিংবা বন্ধুর নামও হতে পারতো। কিন্তু যাকে ঘিরে এই কাহিনী আবর্তিত হবে আগামী কয়েকটি লেখায়, সেই আয়শা নিতান্তই সাধারণ, খেটে খাওয়া নারী। ক্ষণেতে হাসে, ক্ষণেতে দুচোখ বেয়ে তার অঝোরধারায় বৃষ্টি নামে। গানে গানে সে তার জীবনের গল্প বলে যায় মাঝে মাঝেই। সে আমার বাসার সহযোগী।
মনের আয়নায় দেখে নিন, তার মুখমণ্ডল কিছুটা লম্বাটে, হালকা-পাতলা গড়ন। বয়স জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারে না, তবে যুদ্ধের সময় সে ছোট ছিল, তার মায়ের মুখে শোনা। ভোলার বাড়িতে তার চাচাকে (চাচা ছিল মুক্তিযুদ্ধের লোক) কিছু লোক কিভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিল যুদ্ধের সময়, এই গল্প আমি তার মুখে অনেকবার শুনেছি।
একাত্তরের যুদ্ধটা তার দেখা না হলেও জীবনভর যে যুদ্ধ তিনি করে যাচ্ছেন, তা হাড়েমজ্জায় চেনেন। কোন অংশেই তা কম নয়। তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি, এতোটা যুদ্ধ করার তাগদ কোথায় পান আমাদের আয়শা? ছেলে নেশাগ্রস্ত, উপযুক্ত মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না টাকার অভাবে, ছোট তিন ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারছেন না টাকার অভাবে, টাকাই টাকা। সব সমস্যার মূলে ওই টাকা।
মাঝে মাঝে দু:খ করে বলেন, ‘খালা, আপনি নেকাপড়া করছিলেন বইলাই চলতে-ফিরতে পারেন, আমরা মরছি ওই জ্বালাতেই’।
মানুষের বাসাবাড়িতে ঠিকা কাজ করে সে। ছয়-ছয়টা সন্তানের মা হওয়ায় শরীরটা ঠিকমতো চলে না, ফলে দুইটা বাসার বেশি কোথাও সে কাজ করতে পারে না, সময় গড়িয়ে যায়। আযান পড়লেই চোখ-কান সচকিত হয়ে উঠে, বিড় বিড় করে অভিশাপ দেয় নিজের জীবনকে। বলে, ‘এক বাসাতেই সময় পার, আয়শারে আয়শা, তুই খাবি কি’?
আয়শা আমার বাসায় কাজ করে গত প্রায় চারটি বছর। মাঝে তাকে বাদ দেয়া হয়েছিল তারই চরম অবহেলার কারণে। সময়মতো আসতো না, একদিন এলে আরেকদিন নিশ্চিত সে ব্যাঘাত দিতো কাজে। আজ এই সমস্যা, কাল ওই সমস্যা। কিছু বললেই আবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতো, রাখলে রাখবেন, না রাখলে নাই। তো, একবার তাকে বাদই দিলাম। সে তখন নিচের দোকানদার, দারোয়ান সবার কাছে নালিশ করে গেছে নতুন বুয়ার বিরুদ্ধে যে, সে তার পেটে লাত্থি মেরেছে বলে। একথা শুনে সবাই হাসে।
কিন্তু ঘুরে-ফিরেই সে আসে বাসায়, খোঁজ নিয়ে যায়, নতুন কাপড়ের বায়না করে যায়। আর এ ঘর, ও ঘর ঘুরে নতুন বুয়ার কাজের খুঁত বের করে বেশ করে গালিগালাজ করে। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও তার এসব কাহিনী আমার মন্দ লাগে না। আমি এনজয় করি। এলেই কিছু টাকা দেই, পুরনো কাপড় দেই। খুশি মনে তাই নিয়ে বাড়ি ফেরে সে।
এবার সে আবার কাজে নিয়োগ পেয়েছে। দশ বাড়ি ঘুরে এসে কিছুটা আক্কেল মনে হয় হয়েছে তার। কাজে ফাঁকি দেয়ার হার কমেছে। বেড়েছে গল্পের রসদ। ছয়টা ছেলেমেয়ের গল্প, ‘ভাদাইম্যা’ স্বামীর গল্প। পাড়া-পড়শির গল্প। এমনকি রাজনীতিও বাদ যায় না। বলা হয়নি একটা অত্যন্ত দরকারি কথা। সেও দেশের একজন, যে কিনা চাঁদে সাঈদীকে দেখতে পেয়েছিল। এবং তা নাকি ছিল অনেক স্পষ্ট। মাইকিং করে তাদের বস্তিতে চাঁদ দেখার কর্মসূচিতে তার এই অবলোকন প্রক্রিয়া তখন হালে পানি পেয়েছিল। অনেকেই তার চোখে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করেছিল চাঁদের ভিতরটা। কি দেখেছিল তারাই জানে, কেবল মাথা নেড়েছিল ‘দেখিয়ে কর্তা’দের কথার সাথে।
তো, আয়শা হলো আমার অনেক ঘটনার নায়িকা। আমাকে ডাকে খালা, ছেলেমেয়েদের শিখিয়েছে আমাকে নানী ডাকতে। এতে আমার বেজায় আপত্তি। নানী আবার কী! আমি কী বুড়া মানুষ! তারপরও ডাকে। প্রতিদিন এসে গল্প ফাদেঁ, আজ আপনার অমুক নাতি এই বলেছে, এই করেছে। গল্পের শেষ নেই। প্রতিবছরই জানুয়ারিতে তার ঘর পাল্টাতে হয় ভাড়া বেড়ে যাওয়ায়। এবছর এরই মধ্যে দুবার পাল্টেছে মেয়ের নিরাপত্তার জন্য। মেজো মেয়েটা গার্মেন্টসে কাজ করে, চোখের সামনে বড় হতে হতে এখন সে রীতিমতো মহিলা বনে গেছে। বিয়ে হতে হতেও একটা বিয়ে তার ভেঙে গেছে শুধুমাত্র যৌতুক না দিতে পারায়। আমার তখন এক হাজার টাকা লস হয়েছে তাদের আপ্যায়নের পিছনে। কিন্তু মেয়েটার মন ভেঙে গেছে সেই ঘটনায়। সুলতানা তার নাম। নিজের রোজগেরে টাকায় মা-ভাইবোনদের চালাতে গিয়ে বার বার স্বপ্ন ভেঙে যায়। সংসার হয় না। প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে বস্তির ঘরে বাস করে আমাদের সুলতানারা।
আয়শার বড় মেয়ে মরিয়ম আগের পক্ষের স্বামীর। আটাশির বন্যায় স্বামী তাকে ও মেয়েকে ফেলে চলে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। লোকটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে, তাও জানে না আয়শা। মরিয়মের ভাল বিয়ে দিয়েছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। পরের ঘরে তাঁর পাঁচ-পাঁচটি সন্তান। সবচেয়ে কষ্ট একেবারে ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে। এতো দুরন্ত বাচ্চাকে সামলে কোন মায়ের পক্ষে বাসা থেকে বেরুনোই মুশকিল।
স্বামী থেকেও নাই। কোনো কাজেই লাগে না সে। আয়শা কতবার তাকে ব্যবসা শুরু করানোর চেষ্টায় টাকা নিয়েছে বিভিন্ন ‘খালাদের’ কাছ থেকে, সব উড়িয়ে দিয়েছে নেশা করে। পাগলের মতোন বেশ। মাঝে মাঝেই বাড়ি ফেরে, মারধর করে টাকা-পয়সা নিয়ে যায় বউ-ছেলেমেয়ের কাছ থেকে। ওরা তখন অসহায়ের মতোন ঘরের দাওয়ায় বসে থেকে অভিশম্পাত করে লোকটিকে, কিন্তু ফেলে দেয় না। মেয়ের বিয়ে বাকি, ছেলেরা আছে, একজন ‘অভিভাবক’ ছাড়া কী হয়?
কতবার বুঝিয়েছি আয়শাকে, বাদ দেন ওই লোককে। দেয় না, পারে না দিতে।
বলে, থাকুক খালা, সবসময় তো আর ঝামেলা করছে না। মেয়ে দুইটা আছে, ওদের বিয়েশাদী আছে।
আমি বুঝি আয়শাকে। প্রতিদিনই যেসব গল্প সে করে, তার অর্ধেক শুনি, কিছু শুনি না। শুনি না একারণেই যে, এসব গল্পের সমাধান আমার কাছে নেই। অন্তহীন এই গল্প ঘরে ঘরে, চলতেই থাকে। (চলবে)