
তানিয়া কামরুন নাহার: সময় পাল্টে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক আকার নিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বাড়ছে ভাঙা পরিবারের সংখ্যা, এসব পরিবারের মানসিক বৈকল্য কেবলমাত্র ওই পরিবারটিকেই না, এর পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোকেও আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সন্তানরা হয়ে পড়ছে প্রচণ্ড একরোখা, অন্তর্মুখী অথবা এর উল্টোটা। প্রচণ্ড রকমের এক অনিশ্চয়তাময় জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমাদের বর্তমান সমাজ। এর কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো:
কেস স্টাডি ১: দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রেম, তারপর বিয়ে। অবিনাশ ও হৃদিতার (ছদ্মনাম) সাজানো গোছানো ছোট্ট সংসার বেশ ভালই চলছিল। এর মধ্যেই এক সময় অবিনাশ আবিষ্কার করল হৃদিতা গোপনে আরেকটি সম্পর্ক রাখছে, আমরা যেটাকে পরকীয়া বলে থাকি। অবিনাশের মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়ল।দুজনের ভালবাসায় কোথায় কী এমন শূন্যতা ছিল যে, হৃদিতাকে এভাবে অন্য সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে পড়তে হল?অবিনাশ অনেক ভেবেও এ প্রশ্নের উত্তর পায় নি। হৃদিতা সব কিছু অবিনাশের কাছে অকপটে স্বীকার করে নেয়।তখন অবিনাশ সিদ্ধান্ত নেয় বিবাহ বিচ্ছেদের। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয় ও বাস্তবায়ন করতে অবিনাশকে দীর্ঘ ৫ বছর নিজের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। পরিবার, আত্নীয়-স্বজনদের কথা ভেবে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক মানসিক টানাপোড়েনের পর একদিন বিচ্ছেদের মাধ্যমে দুজন আলাদা হয়ে গেল। হৃদিতা আবার বিয়ে করে সুখী হল। কিছুদিন পর অবিনাশও আবার বিয়ে করে সুখের সংসার পাততো।অবিনাশ মনে করে, তাদের বিয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়েছে। তাতে তারা দুজনেই নিজস্ব ঠিকানা খুঁজে নিয়ে এখন সুখে আছেন।
কেস স্টাডি ২: স্বর্ণাকে (ছদ্মনাম) একসময় বিয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তটা নিতেই হল। যার প্রতি এত ভালবাসা ও বিশ্বাস রেখেছিল একদিন, সে যদি এভাবে তার অমর্যাদা করে তবে তা মেনে নেওয়া স্বর্ণার পক্ষে কঠিন।পাভেলের সাথে বিয়ের আগে প্রেম ছিল ৫ বছরের। দুজনে বিয়েও করেছিল। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছর পর হঠাৎ স্বর্ণা যখন প্রমাণসহ পাভেলের পরকীয়া সম্পর্ক রাখার খবরটি জানতে পারলো, তখনই সে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। পাভেল অবশ্য বারবার ওর পা ধরে মিনতি করেছে, মাফ চেয়ে বলেছে, ঐ সম্পর্ক থেকে সে বের হয়ে আসবে, তবু স্বর্ণাকে তার সিদ্ধান্তে কঠিন হতে হয়েছে। স্বর্ণা বা পাভেলের মধ্যে সম্পর্কের মাঝে খালি জায়গাটা কোথায় তা স্বর্ণা জানে না। তবে এটুকু বুঝেছে, পাভেল নিজেই জানে না, সে আসলে কী চায়! স্বর্ণাকে নাকি ঐ বিবাহিত অচেনা মেয়েটিকে ভালবাসে পাভেল!পাভেলকে আর দোটানায় রাখতে চায় নি স্বর্ণা। নিজেকেও অবিশ্বাস ও সন্দেহের জীবন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছহে স্বর্ণা। তাই পাভেলকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গিয়েছে দূরে। এখন স্বর্ণা একা থাকলেও অনেক স্বস্তি ও নির্ভার হয়ে জীবন উপভোগ করতে পারছে।
কেস স্টাডি ৩: রেবেকা আক্তার (ছদ্মনাম)অনেক ঘটা করে মেয়ে অন্তির বিয়ে দিয়েছিলেন। অন্তির নিজের পছন্দের ছেলেকে রেবেকা আক্তার ও তার স্বামী, দুজনেরই অনেক পছন্দ হয়ে যাওয়ায় এ বিয়েতে অমত করার কোন প্রশ্নই আসে নি। ছেলে পক্ষ থেকেও সবাই রাজি ছিল। তাই বিয়েতে কোন সমস্যাই হলো না। কিন্তু আসল সমস্যা দেখা গেলো বিয়ের বেশ কিছুদিন পর।অন্তি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো তার স্বামী অক্ষম (impotent)। এরপর অন্তি বিষন্নতায় ভুগতে লাগলো। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এসব কথা অন্তির বাবা-মায়ের কাছে গোপন রেখে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতো। মূ্ল ঘটনা জানার পর রেবেকা আক্তার অন্তিকে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। এ সময় অন্তি ডিভোর্সের কথা ভাবছিল। কারণ, অন্তির স্বামীর সমস্যাটি চিকিৎসাতেও কোনদিন ভাল হবে না। মেয়ের সারা জীবনের কথা ভেবেই মেয়ের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করলেন রেবেকা আক্তার।যদিও ডিভোর্স দেবার আগে অভিভাবক হিসেবে অনেক দিক তাকে ভেবে দেখতে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে অন্তির নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে বলা হয়েছিল, ওর মাথা খারাপ।মেয়েকে আবার বিয়ে করাতে গেলে কেমন সমস্যা হতে পারে, এটাই তার বারবার মনে হতে লাগলো।সাধারণত কোন মেয়ের বিয়ে বিচ্ছেদ হলে তার চরিত্র নিয়ে সবাই অহেতুক কানাঘুষা করে। এসব পরবর্তীতে মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে আবার না বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এসব নিয়ে চিন্তা হলেও মেয়ের সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছেন রেবেকা আক্তার।
বাড়ছে ডিভোর্সের হার
গত তিন বছরে বাংলাদেশে ডিভোর্সের হার বেড়েছে পাঁচগুণ। এর মধ্যে ডিভোর্স নোটিশ দেবার ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়েও এগিয়ে আছেন নারীরা। ডিভোর্সের জন্য প্রতি দশজনে পুরুষ ও নারী আবেদন কারীর অনুপাত ৩ঃ৭। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের জপর্যন্ত ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছে ঘটেছে ৮৩৩টি। এর মধ্যে পুরুষেরা ডিভোর্স দিয়েছেন ১৬৯টি ও নারীরা ৬৬৪টি। এছাড়াও অনেক দম্পত্তি আলাদাভাবে বসবাস করছেন পরস্পরকে ডিভোর্স না দিয়েই। তাদের পরিসংখ্যান অবশ্য পাওয়া যায় না। এত ভারি ভারি সাংখ্যিক পরিসংখ্যান দিয়ে পাঠকের বিরক্তি আর বাড়াতে চাই না। ডিভোর্সের কারণগুল নিয়ে আলোচনা করার আগে বরং ডিভোর্স নিয়ে একটি কৌতুক বলে নেওয়া যাক।
মেয়েটি বিয়ে করেছিল কারণ, ছেলেটি ছিল খুব শক্তিশালী।এরপর মেয়েটি ডিভোর্স দিয়েছিল কারণ, বিয়ের পর ছেলেটিকে তার কাছে খুব কর্তৃত্বপরায়ন মনে হচ্ছিল।ছেলেটি বিয়ে করেছিল, কারণ মেয়েটি ছিল খুব নাজুক আর স্লিম ফিগারের। এরপর ডিভোর্স দিয়েছিল, কারণ, বিয়ের পর মেয়েটিকে দূর্বল ও অসহ্য রকমের পরনির্ভরশীল লাগছিল। মেয়েটি বিয়ে করেছিল, কারণ, ছেলেটাকে বিয়ে করলে জীবনটা নিশ্চিন্তে কেটে যাবে। এরপর ডিভোর্স দিয়েছিল, কারণ, ছেলেটি নিজের ব্যবসা আর কাজ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ছেলেটি বিয়ে করেছিল, কারণ, মেয়েটি তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এরপর ছেলেটি ডিভোর্স দিয়েছিল, কারণ, মেয়েটি দিন দিন তার মায়ের মত হয়ে উঠছিল! এতো গেল কৌতুকের কথা। কিন্তু বাস্তবে কেন বাড়ছে ডিভোর্সের সংখ্যা?
ডিভোর্স কেন বাড়ছে?
সামাজিক পরিবর্তন ডিভোর্স বৃদ্ধি পাবার অন্যতম একটি কারণ।যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ও স্যা্টেলাইট চ্যানেলের বদৌলতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও সহজেই বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির কথা জানতে পারছে এবং সেভাবেই তাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে। এতে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও নৈতিকতার জায়গাগুলোও পরিবর্তিত হচ্ছে। যৌতুক, স্বামীর নির্যাতন, পরকিয়া, মাদকাসক্তি, পর্নোগ্রাফে আসক্তি এধরনের কারণেও যেমন ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে তেমনি ভা্রতীয় সিরিয়ালের প্রভাবে পাখি ড্রেসের মত তুচ্ছ কারণেও ডিভোর্সের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ইদানিং অনেকের কাছেই বিয়ের পরেও এক বা একাধিক গোপন সম্পর্ক রাখাটি এক ধরনের হবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাছেমোবাইল, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সহজেই এ ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক তৈরির দিকে আকর্ষণ ও মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়। ডিভোর্স বেড়ে যাবার এটিও একটি অন্যতম কারণ। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ দানা বাধতে শুরু করলে একটি সম্পর্ক হয়ে উঠে বিরক্তিকর বোঝার মত। নারীর অধিকার সচেতনতা অত্যাচারের বিরুদ্ধে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে।এক সময় নারীরা শত অত্যাচার সহ্য করলেও ডিভোর্সের কথা ভাবতে পারতো না। এখন তারা আগের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হবার কারণে সহজে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ডিভোর্সের প্রভাব
ব্যক্তির উপর প্রভাব: আমাদের দেশে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেহেতু ডিভোর্সের ঘটনাগুলো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখা হয় না, তাই একজন ডিভোর্সি ব্যক্তিকে কিছু অহেতুক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।একটি সম্পর্ক থেকে বের আসার পর তার মধ্যে নিঃসংগতা চেপে বসতে পারে। দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিক যৌনতার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হয় বলে আরেক ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় যৌন চাহিদা পূরণের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই, নেই নাইট ক্লাব। কেউ কেউ নিজেদের অবদমিত রেখে দেন। আবার কেউ কেউ গোপন কোন সম্পর্কের মাধ্যমে চাহিদাটি পূরণ করেন। এতে সমস্যা অবশ্য কমে না, বরং আরো সমস্যা বেড়েই চলে। ফলে ডিভোর্সী ব্যক্তি বিশেষ করে নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভংগি অত্যন্ত নেতিবাচক হয়ে থাকে। ডিভোর্সী নারী মানেই তার কোন সমস্যা আছে বা সে চরিত্রহীন, এমন চোখেই সাধারনত তাকে দেখা হয়ে থাকে। আবার একজন ব্যক্তির পক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে করাটাও খুব সহজ নয় এ সমাজে। এছাড়াও নারীদের আরো কিছু ভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় বৈকি। বিচ্ছেদের পর যাবতীয় আর্থিক লেনদেন ও সন্তানের ভরনপোষনের জন্য প্রাপ্য অংশটুকু আদায় করে নেবার জন্য আইনি জটিলতায় তাকে রীতিমত নাকাল হতে হয়।
সন্তানের উপর প্রভাব: বাবা/মায়ের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়ে সন্তানের উপর।তারা একটি মানসিক টানা-পোড়েনের মধ্যে পড়ে যায়, সে কার কাছে যাবে, বাবা না মায়ের কাছে?বাবা/মা-ও তাকে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে থাকে অনেক সময়। স্কুলে অন্য অভিভাবক বা শিক্ষকেরা তাকে আলাদা নজরে দেখলে এবং তাকে/তার বাবা-মাকে নিয়ে আলোচনা করলে তার মানসিক বিকাশ ও সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হয়।স্কুলে অন্য শিক্ষার্থীদের বাবাদের দেখে তার মনে শূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। এদের মধ্যে মাদকাসক্ত হয়ে যাবার আশংকা তুলনামূলকভাবে বেশি। পরবর্তীতে নিজেরাও কোন সম্পর্ক তৈরিতে তাদের দক্ষতা থাকে না, তাদের মাঝেও ডিভোর্সের সম্ভাবনা থেকে যায়।
সামাজিক সমস্যা: ডিভোর্সের হার বেড়ে যাওয়ায় সমাজের উপর তার কিছু প্রভাব যেমন পড়ে, তেমনি সমাজের পরিবর্তনের ফলেও ডিভোর্স বেড়ে যায়। পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নৈতিকতার পরিবর্তনের ফলে বাড়ছে ডিভোর্সের সংখ্যা। আবার ডিভোর্সের ফলে নতুন মূল্যবোধ ও বিশ্বাসও তৈরি হচ্ছে সমাজে। ব্যাপারটা যেন অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মত। এত বেশি ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাবার ফলে বিয়ে প্রথার ত্রুটিগুলো এখন চোখের সামনে চলে আসছে, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিয়ে প্রথাটিই। এর ফলে তরুণদের মধ্যে বিয়ের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে।পরিবার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বাড়তে পারে লিভ টুগেদার সংস্কৃতি। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অপ্রস্তুত সাধারণ মানুষ লিভ টুগেদার’এর মত সম্পর্ক মসৃণভাবে চালিয়ে যাবার মত এখনো এতটা পরিপক্ক নয়। তাই এ সংস্কৃতি সমাজের মধ্যে অস্থিরতা বাড়িয়েই তুলবে বলে আশংকা করা যায়।
ডিভোর্স যখন আশীর্বাদ: সংসারে স্বামী/স্ত্রীর প্রতিদিনের ঝগড়া-ঝাঁটি, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, পরস্পরের প্রতি আক্রমণ, অশান্তিময় পরিবেশে সন্তানের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ডিভোর্সের ফলে বরং সন্তানের খারাপের চেয়ে মংগলই বেশি হয়ে থাকেন। কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের উদাহরণটির কথা মনে করা যেতে পারে। সঠিক সময়ে তিনি যদি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারতেন তবে হয়ত তাকে এভাবে দুটি চোখ হারাতে হতো না। আমরা প্রায়ই পত্রিকার পাতায় খবর দেখি, পরকিয়ার কারণে মা তার সন্তানসহ আত্নহত্যা করেছে, কখনো স্বামী স্ত্রীকে খুন করছে, স্ত্রী স্বামীকে। এসব ক্ষেত্রে আত্নহত্যা, খুনের চেয়ে ডিভোর্স মঙ্গলজনক। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অত্যাচার সহ্য করে অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে বরং নারীদের নিজের শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ভালবাসাহীন একটি সম্পর্কের বোঝা বয়ে বেড়ানোর চেয়ে নির্ভার হওয়া ভাল।
ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেবার আগে যা করতে হবে: প্রত্যেকেরই নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার রয়েছে, যেহেতু জীবনটা তার। জীবনের প্রয়োজনে যদি কখনো ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, তবে তার আগে ঠাণ্ডা মাথায় কিছু দিক ভেবে দেখতে হবে। দাম্পত্য সংকট ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারলে হয়ত আর ডিভোর্সের সিদ্ধান্তই নেবার প্রয়োজন পড়ে না। তাই নিজেদের মধ্যকার সংকট নিয়ে দুজনে মিলে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথেও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যায়। তাতেও সমাধানের পথ না পেলে দুজনে মিলে কাউন্সেলিং নিতে পারেন।প্রয়োজনে আইনী পরামর্শ নিতে পারেন।
আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি সংস্থা মনোসামাজিক কাউন্সেলিং ও আইনী সহায়তা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য…
- ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার
- মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ভবন (৪র্থ তলা ) ; ৩৭ /৩ , ইস্কাটন গার্ডেন রোড; ঢাকা -১০০০। ফোন: ৮৩২১৮২৫;মোবাইল : ০১৭১৩১৭৭১৭৫
- আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ৭ /১৭ , ব্লক -বি , লালমাটিয়া, ঢাকা -১২০৭ ফোন – ৮১২৬১৩৭ ,৮১২৬১৩৪, ৮১২৬৪০৭ সার্বক্ষনিক আইন সহায়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন নং :০১৭২৪৪১৫৬৭৭, ০১৭৫৭১১২২৬১ ই-মেইল: [email protected]
- বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজ়ীবি সমিতি, ৪৮/৩, মনিকো মিনা টাওয়ার, পশ্চিম আঁগারগাঁও, ঢাকা, ফোন-৯১৪৩২৯৩
- বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), YMCA ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, ১/১ পাইওনিয়ার রোড, কাকরাইল, ঢাকা- ১০০০, ফোন- ৯৩৪৯১২৫, ৮৩১৩৬৮৯, ফ্যাক্স- ৯৩৪৭১০৭, ই-মেইল- [email protected] ওয়েব সাইট- www.blast.org.bd
- ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার
- বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুফিয়া কামাল ভবন, ১০/বি/১ সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০, ফোন -৭১৬৯৭০১, ফ্যাক্স ৮৮-০২-৯৫৬৩৫২৯, ই-মেইল[email protected], ওয়েব-http://www.mahilaparishad.org
- সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ইত্যাদি।
দাম্পত্য সংকট চলাকালে অনেকেই মনে করেন, বাচ্চা হলেই বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু এতে অনেক সময় সমস্যা আরো বেড়ে যায়। সন্তানের কারণে অনেক সময় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়া ব্যক্তির জন্য যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর সংকটের মধ্যে সন্তানটি নিজেও অনেক সমস্যায় পড়ে যায়। তাই সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সন্তান না নেওয়াই ভাল।
প্রিভেনশন ইস বেটার দ্যান কিউরঃ দাম্পত্য সংকট মোকাবেলার সবচেয়ে ভাল উপায় হলো, সংকট তৈরি হবারই কোন সুযোগ না রাখা। ‘’বিয়ে হয়ে গেলেই আর কোন সমস্যা হবে না’’ এমন মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।সেজন্য বিয়ের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রি-ম্যারিট্যাল কাউন্সেলিং-এর ধারণাটি আমাদের দেশে প্রায় নেই বললেই চলে।অথচ দুজন আলাদা পরিবেশে বেড়ে উঠা, আলাদা মানসিকতার দুজনের বিয়ের আগে প্রি ম্যারিট্যাল কাউন্সেলিং-এর অত্যন্ত দরকার।দুজনের দুজনে চিনতে, বুঝতে, দুজনার পছন্দ-অপছন্দগুলো জেনে নেওয়া ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব তৈরিতে এ কাউন্সেলিং সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও বিয়ের আগে ভাল মত একে অপরের তথ্যগুলো যাচাই করে নিতে হবে। মাদকাসক্তি বা পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি আছে কিনা জানার চেষ্টা করতে হবে।
বিয়ের পরে শত ব্যস্ততার মধ্যেও দুজন দুজনের জন্য কোয়ালিটি টাইম বের করে নিতে হবে। মাঝে মাঝে কোথাও ঘুরে আসা, একসাথে সিনেমা দেখা, উপহার দেওয়া, এ ধরনের ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো দিয়ে জীবনকে সাজিয়ে রাখতে হবে। একটি সম্পর্ক তৈরি করাটাই বড় কথা নয়, বরং তা সুন্দর করে রক্ষা করার কাজটিই কঠিন।একটি সম্পর্কের প্রথম শর্তই হচ্ছে দুজন দুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান, ভালবাসার চর্চা বজায় রাখলে সম্পর্কে ফাটল ধরার সুযোগ থাকে না। জীবনে চলার পথে দুজনের দাম্পত্যের বাইরেও তৃতীয় কোন ব্যক্তির অনুপ্রবেশ করার কোন স্থান রাখা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। যদি কখনো এমন কারো অনুপ্রবেশ ঘটেও যায়, তবে সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার মানসিকতা রাখতে হবে। আর এতে স্বামী/স্ত্রীর সমর্থন ও শক্তি অনেক বেশি প্রয়োজন।প্রয়োজনে দুজন দুজনকে ছাড় দিতে হবে। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভাল থাকলে সমঝোতায় কোন সমস্যা হয় না। সন্তান জন্মের পরেও পারিবারিকভাবে সবাই মিলে কোয়ালিটি টাইম মেইনটেইন করতে হবে।

সমাজ বিজ্ঞানী যা বলেন…
বিবাহ বিচ্ছেদ সামাজিক বিকাশের একটি বাস্তবতা
শিক্ষার হার, তথ্য প্রযুক্তি্র ব্যবহার, নারীর অধিকার সচেতনতা, নারীর ক্ষমতায়ন,নারীর শালীনতাবোধ, দেশ বিদেশে কর্মসংস্থান, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান্তরাল অংশগ্রহণ যতই বাড়বে সমাজের মধ্যেও পরিবর্তন আসবে।সেই সাথে সমাজের মধ্যে মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নৈতিকতারও পরিবর্বতন আসবে। তখন বিবাহ বিচ্ছেদের হারও সেভাবেই বাড়বে।বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাওয়া সমাজ পরিবর্তনের কথাই যেন ঘোষণা দেয়। সেদিক দিয়ে বলা যায়, বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়া সামাজিক বিকাশেরই একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা।
সমাজ বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়।আদিম সমাজে অবাধ যৌনাচার, অজাচার ইত্যাদির প্রচলন ছিল। নৃতাত্বিক গবেষণায় দেখা যায় ম্যামাল অর্থাৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এধরনের যৌন আচরণ তাদের স্বাভাবিক প্রবনতা।প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এধরনের অবাধ যৌনাচারের ফলে একসময় নানা রকম দ্বন্দ্ব, সংকট, সমস্যা তৈরি হতে থাকে। সেসব সমস্যা কমিয়ে আনতে, মানুষকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সমাজের প্রতিনিধিরা নতুন কিছু মূল্যবোধ, নৈতিকতা প্রবর্তন করে।তারই ধারাবাহিকতায় পরিবার ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।সেই সময়ে সমাজের বিকাশ এভাবে ঘটেছিল।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিবারে একসময় নারীর পছন্দ–অপছন্দ, ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা প্রকাশ করতে পারতো না।তাই কখনো শারীরিক বা মানসিক এমন কি যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও সে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারতো না।এখন নারীরা সাবলম্বী হচ্ছে। সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজ প্রতিনয়ত পরিবর্তিত হয়। সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নৈতিকতা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, দেশ কাল ভেদে এর বিভিন্নতা দেখা যায়।সেই সমাজ পরিবর্তনের এই বাস্তবতা বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া। নারী ও পুরুষ বৈষয়িক, মনস্তাত্বিক ও জৈবিক কারণে আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তও সমঝোতার মাধ্যমে নেওয়া হয়ে থাকে। দুজনেরই পারস্পরিক মতামত ও বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এমন সিদ্ধান্ত নেবার সামাজিক ও আইনগত অধিকার রয়েছে এবং তা থাকাই উচিত।
আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে নারীর উপর একটি অমানবিক দুঃসহ জীবন আমরা চাপিয়ে দেই।স্বাভাবিক, সামাজিক জীবন যাপনের উপায় আমরা তাদের জন্য রাখছি না। এটি আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।

মনোবিজ্ঞানী যা বলেন…
বিবাহ বিচ্ছেদের হলেও বাবা-মায়ের সুন্দর ছবিটা যেন সন্তানের কাছে নষ্ট না হয়ে যায়
পরিবার, সমাজ, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে সুস্থ মননশীলতার চর্চার খুব প্রয়োজন। এটি না থাকলে সবখানেই আমরা ভাংগনের চিত্রই দেখতে পাবো।পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে চাওয়া পাওয়ার ভিন্নতা থাকতে পারে। এই ভিন্নতা যদি একেবারেই সহনশীলতার বাইরে চলে যায়, তবে এমন সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।আর যদি কোন কারণে বিচ্ছেদের মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন করা না যায়, তবে ঐ সম্পর্কের মধ্যে কিভাবে বসবাস করতে হবে, সে উপায় গুলো তাকে জানতে হবে। যদি তারা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাদা হয়ে যান তবে যেন সন্তানদের মধ্যে বাবা-মায়ের সুন্দর ছবিটা নষ্ট হয়ে না যায়। বাবা-মায়ের নিজেদের মধ্যকার অশান্তি, বিদ্বেষ ও বিরোধ যেন সন্তানদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। বরং সন্তানকে এভাবে বোঝাতে হবে, ‘’তোমার বাবা/মায়ের সাথে আমার বিচ্ছেদ হলেও সে তোমার বাবা/মা।তুমি তার সাথে সব সময় যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখবে।‘’ উন্নত দেশগুলো এখন কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের পরবর্তী সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে।
লেখক: শিক্ষক