নাহিদ সুলতানা:
‘শৃঙ্খল ভেঙেছি আমি,
খসিয়াছে পান থেকে সংস্কারের চুন’,
‘শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেল দলিত দংশিত নারী’- তসলিমা নাসরিন।
আমার তো মনে হয় যখন থেকে আমার বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকেই আমি তসলিমা নাসরিন পড়ি। অথবা এইভাবেও বলতে পারি, উনার লেখা পড়তে পড়তেই বুঝেছি যে, আচ্ছা, আমার মাথার ভিতর বুদ্ধিগুলি এরকম, বাহ! বাহ! বাহ! আমার বুদ্ধি-যুক্তিগুলি তো খুবই ভালো, শক্তিশালী … তাইলে ঘরের-পরের-সমাজের মানুষগুলি খারাপ কয় কেন? কী হয় দেখি তো, তাইলে উনারে আরও বেশি বেশি পড়ে দেখি কী হয়! সেই দেখতে দেখতে আজ ৩০ বছর কেটে গেলো!
তখন থেকে তসলিমা নাসরিনকে পড়ি। সবসময় উনার খবরাখবর রাখি। ২০ বছর পর বাংলাদেশের কোন টিভি চ্যানেলে উনার সাক্ষাৎকার দেখলাম। ভালো লাগলো। উনি আবার তাঁর কথায় আমাদের মুগ্ধ করলেন, ভাবালেন। সাদাকে সাদা বলা, আর কালোকে কালো, এটা যে এতো সহজ নয় উনাকে ২০ বছর দেশে আসতে না দেয়া থেকেই বোঝা যায়। একাত্তর টিভি ও ফারজানা রূপাকে অশেষ ধন্যবাদ, এই অসাধ্যকে সাধ্য করার জন্য।
সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে আসি, সাক্ষাৎকারের একটা বড় অংশ ছিল উনার দেশে ফিরতে পারা বিষয়ক। আমি একমত তাঁর এই চাওয়াতে। মনে প্রাণে চাই যে উনি নিজের দেশে ফিরুক। কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন আছে তসলিমা নাসরিন ও তার বন্ধুদের কাছে, তবে আমার বন্ধুরাও মতামত দিতে পারেন।
- এই পোড়া দেশে এসে আপনি কী করবেন? এই দেশ কখনও মেধাকে কদর করে নাই। মেধাহীনদের কদর এখানে। আপনি ফিরলে কি এর ভিন্ন কিছু ঘটবে? মনে হয় না!
- দেশে ফিরলে উনি উনার আন্তর্জাতিকতাটা নষ্ট করবেন। পাশাপাশি আমার মতে, উনি লড়াইয়ের কারণটাই হারিয়ে ফেলবেন।
- এক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা ছাড়া আর কেউ উনার লাখা ছাপে না। বহু কষ্টে পাওয়া এই জায়গা। উনি দেশে ফিরলে উনাকে নিয়া যে রাজনীতি তা শুরু হবে তাতে হয়তো তিনি এই জায়গাটাও হারাবেন। সেটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? উনাকে নিয়া যে বহুবিধ রাজনীতি হয়, সেটা আমরা সবাই কম-বেশি জানি।
- আমি যতটুকু জানি, দেশের নারী লেখকরা পুরুষশাসিত সমাজে যে কষ্ট করছেন (যা আপনি নিজেও করছেন নিশ্চয়। আপনি তো এতোটাই করেছেন যে আপনাকে দেশ থেকেই বের করে দিয়েছে। ব্যাটাগিরি বইলা কথা! কী কন!) আপনাকে আবার লড়াইটা শুরু থেকে শুরু করতে হবে। কেন নেবেন সেই পেইনটা? ২০ বছরের বদলে যাওয়া, পাল্টে যাওয়া, আগানো-পিছানো বাংলাদেশকে আপনি কীভাবে নিবেন? আর এই বাংলাদেশই বা আপনাকে কীভাবে নেবে?
- নাঈমুল ইসলাম খানদের সম্পাদক গিরি শেষ। এখন যারা আছেন, তারা কেউ নিজের চেয়ে বুদ্ধিমান আর বড় কাউকে মনে করেন না, বিশেষ করে কোন নারীকে তো নয়-ই। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের ভাব দেখলে তো আপনার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা হবে, তখন! অথবা কষে চর-থাপ্পর মারতে ইচ্ছা হবে, তখন! এখন তো ভিজুয়াল মিডিয়ার যুগ, কিন্তু তসলিমা জমানায় তো তা ছিল না। উনার দমবন্ধ হয়ে যাবে, আমি নিশ্চিত।
- She got now world but the moment she will be allowed to come here she will have only this country…Her worlds and friends will also think she is now out of danger and she will be then judged otherwise!
- আমি তসলিমা নাসরিনকে আবেগ দিয়ে বিশ্লেষণ করি না, যুক্তি দিয়ে করি। তাই হাওয়ার উপর তলোয়ার ঘুরিয়ে লাভ নাই। এখানে বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের ১০০ ভাগ মানুষ ধর্মকে প্রতিদিনকার জীবনের অংশ মনে করে। আমি যদি তসলিমা নাসরিনের মতামতকে গুরুত্ব দেই, তবে ঐ ১০০ ভাগ মানুষের মতামতকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আর কোন রাজনৈতিক দলই ১০০ ভাগ মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাইরে যাবে না, মরে গেলেও না।
- উনার উদারতা, উনার লড়াই দিয়ে যতটুকু পথ দেখানোর উনি দেখিয়েছেন। বাকি যুদ্ধটা এই দেশের সাধারণ নারীর ও সাধারণ মানুষের। উনি দূর থেকে যতটা পথ দেখাতে পারবেন, দেশে এলে তা পারবেন না।
- পথ কিন্তু সবাই দেখায় না, কেউ কেউ দেখায়। তসলিমা নাসরিন সেই কেউদের একজন। উনি আর বাংলাদেশের একার নন, উনি গোটা পৃথিবীর। দেশে থাকুক, আর বিদেশে থাকুক কী যায় আসে! দেশে আসতে পারছেন না বলে তো উনার লেখা থেমে নেই। লিখছেন তো সেই আগের মতোই, বিষ ছড়ানো, টানটান, ঝরঝরে … আগুনমুখা কলম (কম্পিউটার) তো আছেই। আর আমরাও সেই লেখা গোগ্রাসে গিলছি, আগেও গিলতাম। এতোটুকু হেরফের হয়নি। উনি তো আছেনই আমাদের মননে-চিন্তায়-চেতনায়।
- দেশে ফিরলেন তো জিতলেন, না ফিরলে হেরে গেলেন … ব্যাপারটা তো এমনও নয়। আমি চাই উনি নিজ দেশে ফেরার অধিকারটুকু পাক এবং ফিরুক। উনার দেশে ফেরার অধিকার নেই এটা আমি কেন, কেউই মেনে নিতে পারে না। নিজ দেশে ফিরতে না পারার যন্ত্রণা কেবল তারাই জানে যারা নিজ দেশে ফেরার অধিকার হারায়।