ফজলুল বারী, সিডনি থেকে: একাত্তর টিভির ফারজানা রূপার সঙ্গে তসলিমা নাসরিনের ইন্টারভ্যুতে লেখকের অকপট অনেক কথাতে চিন্তার অনেক খোরাক আছে। যেমন হিজাব নিয়ে তসলিমা বলছিলেন, তিনি স্কুলে থাকতে একটি মাত্র মেয়ে বোরকা পরে আসতো। স্কুলের গেটের ভিতর ঢুকে বোরকা খুলে রেখে দিতো ঝুড়িতে! কারন এ নিয়ে অন্যরা হাসাহাসি করতো। তসলিমা যখন মেডিক্যালে পড়েন, হিজাব-বোরকা পরা কোন ছাত্রী তাদের সঙ্গে ছিলেন না। কিন্তু এখন বাংলাদেশের কোন অনুষ্ঠানের ছবি দেখলে সেখানে তিনি নব্বুই শতাংশকে হিজাব পরা দেখেন!
এসব অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের শৈশবেরও। এখন চিত্র ভিন্ন! আশেপাশে প্রতিদিন বাড়ছে হিজাবসহ পোশাকে নানান ‘মুসলমানিত্ব’ প্রদর্শনের বহর! মজার ব্যাপার এই প্রয়োজনটিও যেন শুধু নারীর! আমাদের শৈশবে আমাদের চারপাশে মুসলমানের সংখ্যা কম ছিল নাকি! বা তারা কী আজকালের প্রদর্শনীর মুসলমানদের চেয়ে খারাপ মুসলমান ছিল? আসলে এভাবে হঠাৎ করে হিজাবের মাধ্যমে মুসলমানিত্ব প্রদর্শনের বাতিক, আমাদের দেশে আরব কালচার থেকে এসেছে। গত দুই দশকে জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশের বিস্তর লোকজন আরব দেশগুলোতে গেছেন এবং এখনও যাচ্ছেন। আরবের অর্থের সঙ্গে দেশে স্ত্রী-কন্যার জন্য নিয়ে এসেছেন-আনছেন হিজাব। এটাও এক ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন! পোশাকে ভারতীয় আগ্রাসনের পাশাপাশি আরব আগ্রাসনের প্রভাবে অস্তিত্বের সংকটে এখন বাঙ্গালির চিরায়ত সংস্কৃতি! ভারতীয় আগ্রাসনের চেয়ে এই পোশাকি আরব আগ্রাসন শক্তিশালী হবার কারন, এর সঙ্গে জড়ানো হয়েছে ধর্মকে! আর ধর্মটা যেন শুধু নারীর পোষাকি বিষয়! পুরুষ যা খুশি পরলেও তার ধর্ম তথা মুসলমানিত্ব যায় না!
আরেকটা মজার ঘাপলা আছে:) বাংলাদেশি বাঙ্গালি নারীর পোশাকে আরবি হিজাব উঠলে পুরো আরব পোশাক কিন্তু তাকে গ্রাস করেনি! যেমন আরবের মেয়েদের বিয়ের পোশাক! বিয়ের দিন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী বধূরা যেমন সাদা গাউন পরেন!’ আরব মুসলিম বিয়ের বধূর ড্রেসটিও এমন সাদা গাউন। আরব বিয়েতে ঢোল পিটানো হয়। উলুধবনি দেয়া হয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশে হিজাব প্রভাবিত গ্রামের কোন পরিবারের বিয়েতে বধূকে সাদা গাউন পরিয়ে, ঢোল পিটিয়ে-উলু ধবনি দিয়ে দেখতে পারেন মাইর কিন্তু একটাও মাটিতে পড়বেনা
হিজাবসহ বদলে যাওয়ার নানা প্রভাব সিডনির বাংলাদেশি বাঙ্গালি কমিউনিটিতেও আছে। এদেশের মুসলমানদের সিংহভাগ আরব।। মুসলিম আরব মেয়েদের প্রায় সবাই হিজাব পরেন। পিটিয়েও তাদেরকে শাড়ি-সালোয়ার-কামিজ তথা বাঙ্গালি সংস্কৃতির কিছু পরানো যাবেনা! বাংলাদেশি বাঙ্গালিদের তাদের সংস্কৃতি গ্রহণে কিন্তু কোন রকম জোরজবরদস্তি করতে হয়নি।
আমরা এমনই সহজ গমন বিশারদ অথবা পটিয়সী এদেশে আসার পর এমন বদলে যাওয়া নারীর পাশাপাশি পুরুষও আছেন। তবে তারা সংখ্যায় খুব কম। তাদের একজনের আগে চমৎকার একটি বাংলা নাম ছিল। বদলে যাবার পর তার মুসলমান তথা আরবি নামটি না বললে তিনি সাড়া দেন না। ক্ষেপে যান! এমন সিরিয়াস পরিবর্তন তার হয়েছে!
পরিবর্তন হয়েছে আরেক ক্ষেত্রেও! যিনি প্রায় কাজে বিরতি দিয়ে চিল্লায় চলে যান, তিনি এখন সারাক্ষণ এত মিথ্যা বলেন যে, অস্ট্রেলিয়ায় তার মতো মিথ্যাবাদী বাংলাদশি-বাঙ্গালি দ্বিতীয়জন খুঁজে বের করা কষ্টকর হবে! এর সবকিছুই কী আমাদের চলতি সাংস্কৃতিক বিপর্যয় অথবা ট্রানজিশনকালীন সুফল-কুফল? এরজন্যেই কী আমরা এখন পার করছি অবিশ্বাসী, অসৎ, অস্থির এক সময়?