শতাব্দী দাশ:
বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে, প্রতীকী নারীমূর্তি তৈরি করে বেধড়ক পেটানোর একটি ভিডিও সমাজমাধ্যমের কল্যাণে সর্বজনগোচর হয়েছে। নারীবিদ্বেষের এমন মত্ত প্রদর্শন বিরল। প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, এখনও শেখ হাসিনার প্রতি উন্মত্ত রাগের প্রকাশ বুঝি। পরে জানা গেল, হাসিনা নন, হয়তো শিরীন পfরভিন হক; কিংবা হয়তো তাও নয়, হয়তো এভ্রি উওম্যান, যে-কোনো-নারী। উল্লেখ্য, মারতে মারতে পুতুলের কাপড় খুলে যেতে ভব্য পুরুষ কিন্তু নারী-পুত্তলিকাকে শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে, তারপর ফের পিটিয়েছে। আসলে, তাদের রাগ সচেতন, শিক্ষিত, মুক্তিপিয়াসী নারীর প্রতি। কিন্তু যেহেতু নারীর ‘হায়া’ রক্ষা করার জন্যই নারীকে মারধর করে সিধে রাস্তায় আনার এই প্রচেষ্টা, তাই মার খাওয়ার সময়েও তার জামাকাপড় ঠিক জায়গায় থাকা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মোট এগারোটি সংস্কার কমিশন গঠন করে, যার একটি হলো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর যার গেজেট প্রকাশিত হয়। শিরীন হকের নেতৃত্বে সেই দশ সদস্যের কমিশন ১৯শে এপ্রিল ৪২৩টি সুপারিশসহ ৩১৮ পৃষ্ঠার বিস্তারিত এক প্রতিবেদন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা করেছে।
কমিশন তিন পর্যায়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে। প্রথমত, আছে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু সুপারিশ; দ্বিতীয়ত, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদকালের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ ; তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। নারীবিদ্বেষীদের রাগের কারণ আসলে সেই সুপারিশে নিহিত।
সুপারিশে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করে তাকে ঐচ্ছিক করতে বলা হয়েছে। মানে, ধর্মীয় পারিবারিক আইন তুলে না দিলেও, এক অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও পাশাপাশি রাখতে বলা হয়েছে, যার সাহায্য চাইলে নারী নিতে পারে। সম্পদে নারীর সমান অধিকার বা উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নারীর সমানাধিকার তো একমাত্র তাহলেই সম্ভব! এই পারিবারিক আইন বিয়ে, বিচ্ছেদ, সন্তানের অধিকার ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রেও লাগু হবে, তাঁরা চেয়েছেন। মৎস্যজীবী মেয়ে থেকে যৌনকর্মী— নানা শ্রেণির কর্মজীবী মেয়েদের শ্রমিকের স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ এখানে আছে। বন, কৃষি থেকে শুরু যাবতীয় অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশার মেয়েদের কথা সেখানে বলা আছে। আছে সংখ্যালঘু মেয়েদের কথা। মেয়েদের ক্রীড়াজাগতিক অধিকারের কথা আছে। বলা হয়েছে, তাদের নির্বিঘ্নে খেলাধুলো করার পরিবেশ ও পরিকাঠামো সরকারকে দিতে হবে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল হয়েছিল সে দেশে৷ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার কথা তো আছেই! সি সেকশনের মূল্য বেঁধে দিতে চেয়েছেন তাঁরা, যাতে সব নারী তার সুবিধা নিতে পারেন৷ দশম অধ্যায়টির নামই আবার ‘মাই বডি মাই চয়েস।’ এখানে বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনের আওতায় আনার সাহসী প্রস্তাব আছে অন্যান্য প্রস্তাবের সঙ্গে। অন্যদিকে, কর্মজগতে নারীর সুরক্ষা নিয়ে ভারতের ‘পশ’ আইনের মতো আলাদা আইন বাংলাদেশে নেই, তাই আছে তার সুপারিশ। অনেক সুপারিশই পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন ‘রাতদখল আন্দোলনের’ সঙ্গে মিলে যায়। যেমন গণপরিবহণে ও কর্মজগতে সুরক্ষা, যৌনতায় না বলার অধিকার, লিঙ্গসাম্যের শিক্ষার সুপারিশ, জনপরিসরকে নারীবান্ধব করার জন্য যথেষ্ট টয়লেটের সুপারিশ ইত্যাদি।
এর বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো আদালতে যে রিট পিটিশন দাখিল করেছে, তার ভাষ্য মনে করিয়ে দিতে কসুর করে না যে, বহুবিবাহের অধিকার বাদ গেলে বা নারী সম্পদের সমান উত্তরাধিকার পেলে কোরান অমান্য করা হয়৷ যৌনকর্মকে বৈধ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবে এবং ‘আমার শরীর, আমার অধিকার’ বাক্যবন্ধে তাঁরা সবচেয়ে স্তম্ভিত, এমনটা রিট পিটিশন পড়ে মনে হল। ‘ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে’, তা নিয়েও তাঁদের বিস্তর আপত্তি। আর আপত্তি রাষ্ট্রকে ‘ইহজাগতিক’ হতে বলা নিয়েও৷
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত মোট এগারোটি সংস্কার কমিশনের অধিকাংশই নিজ নিজ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আর কোনো কমিশনের সুপারিশ নিয়ে এত হুলুস্থুল হয়নি সে দেশে। পুরো কমিশন বাতিলের দাবিও ওঠেনি। এতে বোধহয় প্রমাণ হয়, কমিশনের সদস্যরা সঠিক চাকেই ঢিল ছুঁড়েছেন। এই শোরগোল সৃষ্টি করা উক্ত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রথম সাফল্য। হেফাজতে ইসলাম কমিশনের সদস্যদের শাস্তি চেয়ে বলেছে, ‘নারী কমিশন করার জন্য জুলাই বিপ্লবে তরুণেরা জীবন দেননি। শুধুমাত্র সেই সংস্কারগুলোই করা উচিত যেগুলো ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী।’ বলা বাহুল্য, তাঁরা হাসিনা সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু ফ্যাসিজম শুধু একটি নির্দিষ্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য না হতে পারে। ইতিহাস বলে, নারীকে ফ্যাসিজম গেরস্তালি ও রক্ষণশীল ভূমিকাতেই দেখতে চেয়েছে। নারীমুক্তির সুপারিশ নিয়ে তাই ফ্যাসিবাদ-বিরোধীদের সমস্যা থাকার কথা নয়। আরও প্রশ্ন জাগে, তথাকথিত সেই জুলাই বিপ্লব কি ছিল ‘পুরুষের বিপ্লব’? নারী কি সেখানে সহবিপ্লবী ছিল না? প্রশ্ন করা হয়েছে, নারী-বিষয়ক সংস্কার কমিটিতে কেন কোনো ধর্মগুরু, নিদেন কোনো পুরুষ, রাখা হয়নি? এ প্রশ্ন হাস্যকর, অবাস্তব এবং ম্যানসপ্লেনিং-এর হাতেগরম উদাহরণ। কিন্তু এই প্রসঙ্গে লক্ষ্যণীয়, ওঁদের সংবিধান সংস্কার কমিটিতে কোনো নারী নেই৷ তাহলে সংস্কার করে যে সংবিধান তাঁরা আনবেন, তা যে নারী বা ট্রান্স মানুষের মনোমতো হবে, তার কি নিশ্চয়তা আছে? এ বিষয়ে বরং শিরিন পরভিনদের দাবি পেশ করা উচিত।
বাংলাদেশের উদারমনস্ক জনগণ বদল চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা অধিকাংশই মনে করেন, ইউনুস সরকারও দেশবাসীর স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ; তাই সরকার চাইলেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত করতে পারবেন না। তাহলে এই সুপারিশের গুরুত্ব কী?
সম্ভবত এর গুরুত্ব এই যে, বাংলাদেশে মৌলবাদী আগ্রাসন, স্বৈরাচার ও পিতৃতন্ত্রের উপস্থিতি সত্ত্বেও নারী আন্দোলন যে দীর্ঘকাল ধরে সেখানে বহতা থেকেছিল অন্তঃসলিলাসম, এই সুপারিশ তার প্রামাণ্য দলিল। শিরিন ও তাঁর দল সাবধানী খেলা খেলেননি। পিচ বুঝেও ব্যাট চালাননি হয়ত, অন্তত নাগরিকরা তাই বলছেন। অনেকেই বলছেন, দেশের সামগ্রিক সামাজিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখলে নাকি সুপারিশ বাস্তবসম্মত নয়। তাছাড়া এই সুপারিশ এতটাই নাকি সাহসী যে পূর্বতন সরকারের আমলেও হয়ত সব সুপারিশের বাস্তবায়ন হত না। ভারতেও যেমন বৈবাহিক ধর্ষণ আইনের আওতায় আসেনি এখনও। কিন্তু শিরিনরা আউট হওয়া-না হওয়ার তোয়াক্কা না করে চার-ছয় মারার চেষ্টা যে করেছেন, তার জন্য বাহবা দিতেই হয়। আন্দোলনের শিক্ষা হল, যখন সরকারের সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশন’-এর সময় আসে, তখন বাস্তবতার তোয়াক্কা না করে সর্বোচ্চ দাবি থেকেই শুরু করতে হয়, যাতে সরকার তার কিয়দংশ মেনে নিলেও, প্রগতির পথে বেশ কিছুটা অগ্রসর হওয়া যায়। এর নিদর্শন এই সুপারিশের প্রতি ছত্রে। সংসদীয় আসন সংখ্যা বাড়িয়ে প্রতিটি কনস্টিটিউয়েন্সিতে একটি সাধারণ ও একটি নারী পদ রাখার প্রস্তাব রেখেছেন সদস্যরা, যাতে সংসদে সদস্যসংখ্যা হবে প্রায় ৬০০। গৃহকর্মী নারীর শ্রমের মূল্য জিডিপি-তে নির্ধারণ করতে বলেছেন তাঁরা, যাতে তথাকথিত ‘বেকার’ গৃহবধূদের দেশের অর্থনীতিতে অবদানের একটা খতিয়ান অন্তত পাওয়া যায়। প্রতিটি দাবি মৌলিক, সরল ও ন্যায্য, অথচ প্রতিটি দাবি আন্তর্জাতিক নারীবাদী আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ও তার সমান্তরাল। মৌলবাদের সামনে অকুতোভয় ভাবে ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত এতগুলো কথা বলার সাহসও প্রশংসনীয়। ভারতে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের বিরুদ্ধে নারীর স্বরকে দৃঢ়তর করবে প্রতিবেশী দেশের মেয়েদের এই সাহস৷
জাতীয় নাগরিক দল নামক যে দল নতুন গঠিত হয়েছে আন্দোলনের পর, তার পুরুষ সদস্যদের দেখা গেছে নারী সংস্কার কমিশনের বিরোধিতায় হেফাজতের পাশে থাকতে, অথচ একই দলের মেয়েরা সেই হেফাজতের বিরুদ্ধেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতীকী নারীবিদ্বেষের প্রদর্শনের পর কেস ঠুকে দিয়েছেন। এটাও আশার কথা। যে কোনো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে নারীর বিরুদ্ধস্বর বজায় থাকাটাই সুস্থতার লক্ষণ। এসব দেখলে আশা জাগে যে দক্ষিণপন্থার বিশ্বজোড়া উত্থানের মধ্যেও নারীমুক্তির মশাল জ্বালিয়ে রাখতে জ্বালানির অভাব হচ্ছে না। বলা বাহুল্য, এই দাবিগুলি আদায়ের পথ তুমুলভাবে রাজনৈতিক এবং বন্ধুর, যদিও শিরিন বলছেন, তাঁরা সরকারের উপর চাপ বহাল রাখবেন। প্রশ্ন এও উঠতে পারে যে, আইন হলেই কি সাম্য আসে? আইনের প্রণয়নের পরে আসে প্রয়োগ; এই দ্বিতীয় ধাপে গাফিলতির চূড়ান্ত নিদর্শন প্রতিনিয়ত দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত। যেমন, ভারতে আইনানুযায়ী নির্যাতিত নারীর জন্য ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ থাকার কথা থানায় থানায়। কার্যক্ষেত্রে, নেই। এই ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’-এর উল্লেখও বাংলাদেশের উক্ত সুপারিশে আছে৷ তারও পরে আসে সাম্যের শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার, সে কাজও ভারতে দূর অস্ত। কিন্তু তবু আইন ও সাংবিধানিক সুরক্ষাকবচের উপস্থিতি কিছু দরজা খোলা রাখে, অত্যাচারিত হলে ন্যায় পাওয়ার একটা ক্ষীণ আশা অন্তত জাগিয়ে রাখে। সেই দরজাগুলো প্রতিবেশীদের জন্যও খুলে যাওয়া দরকার।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। বাড়ছে বাংলাদেশের ভারতবিদ্বেষ। কিন্তু মায়ের মুখের ভাষার শুধু নয়, মেয়ের লড়াইয়ের ভাষারও, দেখা যাচ্ছে, একই বর্ণমালা। সে ভাষা, সে বর্ণমালা রোকেয়ার:
“যখনই কোনো ভগিনী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে… আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
লেখক: নারী অধিকার কর্মী
(লেখাটি ‘এই সময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের অনুমতিক্রমে উইমেন চ্যাপ্টারের পাঠকদের জন্য তা আবারও ছাপা হলো)