সারাহ আমীর প্রেমা: বুয়েট-ইইই-০৬ এর আমি। যদিও আমার মতে আমার চাকরি তেমন বিশেষ কিছু না, কিন্তু আমাদের সিইও রবিউল আলম স্যারের মতে আমি একটা মাইলফলক জাতীয় কিছু। তাই ভাবলাম এ নিয়ে লিখেই ফেলি, ক্ষতি কী!
আমি প্রায় দুই বছর ধরে এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সাভার ফ্যাক্টরিতে পাওয়ার ট্রান্সফর্মার টেস্টিং এ আছি। প্রথম যখন ইন্টারভিউ দিলাম এখানে, সেটা ছিল আমার জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ, তাও ৪-২ এর রেজাল্টের আগে। আমার সাথে বুয়েটেরই আরো জনা পঞ্চাশেক ছিল। পাসের আগে তো, সবাই সবকিছুতে ট্রাই করতো। বুয়েট-০২ এর রাজু ভাই আর আরেকজন ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। সেদিন কী কী করেছি ঠিক মনে নাই, কিন্তু পরে শুনেছি প্যানেল খুবই ইম্প্রেসড ছিল।
দ্বিতীয় ইন্টারভিউতে সরাসরি সিইও স্যারকে ফেস করলাম। কোথায় পোস্টিং চাই প্রশ্নে ‘ফ্যাক্টরি’ বলায় উনি অনেকক্ষণ থমকে গেলেন। বললেন, আগে কখনো কোন মেয়ে ফ্যাক্টরিতে যেতে চায়নি, এমনকি ছেলেরাও ঢাকায় থাকতে চায়, আমি কী ভেবে চাইলাম!
আমি সত্যিই বললাম, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি হাতে কলমে কাজ করার জন্য, আমি সুযোগ চাই আমার বিদ্যাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার। স্যার বার বার জিজ্ঞাসা করলেন, আসলেই প্রথম মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমি কী পারবো ফ্যাক্টরি হ্যান্ডেল করতে! বললাম, যেহেতু সারা জীবন ছেলেদের সমান অধিকার নিয়ে চলেছি, বুয়েটে সিট দখল করে পড়েছি, আমি অবশ্যই তার সবই পারবো, যা একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলে পারে।
আমি আসলেই পেরেছি। স্যার এখনও সবসময় আমার সেই ইন্টারভিউ এর কথা বলেন সবাইকে।
তবে, এইসব প্রাপ্তি টুপ করে আসে নাই। প্রথমে আসলেই অদ্ভুত ছিল অবস্থা। টেকনিশিয়ানদের সাথে মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার ফ্লোরে কাজ করে, টেস্ট করে, এটা সবাই উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখত। আমার পারিবারিক অবস্থা নিয়ে ছিল প্রশ্ন। আগে থেকে কিছু মেয়ে ডিপ্লোমা ছিল এলাকারই, তাদের আমার পোশাক-আশাক, চাল-চলন নিয়ে পিছে পিছে মাথা কুটে মরা ছাড়া কোন কাজই ছিল না।
এমনও আছে, যে নিজে পাতলা কাপড়ের ছোট কামিজ পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আসে, আর আমার জিন্স পড়া নিয়ে পুরুষ কলিগের কাছে কটুক্তি করে! পুরুষ কলিগদের বাঁকা দৃষ্টি কোন ব্যাপার ছিল না – যেহেতু বুয়েটেই ১০% সংখ্যালঘুদের একজন হয়ে পাঁচ বছর পড়ে এসেছিলাম। কিন্তু এই মেয়েগুলার আচরণ খুবই বিরক্তিকর ছিল। প্রথম যখন আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে জয়েন করল, আমার সহজ স্বাভাবিক হাত নেড়ে হাই দেয়াতেই সবাই ধরে বসল ওই আমার বয়ফ্রেন্ড! তারপরও সবকিছুর মাঝে আমি কোনকিছু পাত্তা না দিয়ে, দেখেও না দেখে, সহজভাবে আমার মতই থাকতে লাগলাম।
ফ্যাক্টরির সবার বধ্যমূল ধারণা ছিল আমি একমাসও টিকবো না। একেতো “মেয়েরা কাজ পারে না” এই ধারণা আছেই সাথে – অফিসের দূরত্ব আর অমেয়েলি (!) কাজ – আমি কবে ছেড়ে চলে যাই এটাই ছিল দেখার বিষয়। আমার ইমিডিয়েট বস টেস্টিং-এ মেয়ে নেয়ার ঘোর বিরোধী ছিল। প্রথমে আমাকে ভাল কাজ দেয়া হল না, এমনকি আমাকে যেই পোস্টের জন্য পাঠানো হয়েছিল – তাতেও বসতে দেয়া হল না। এভাবে কয়েকমাসে আমি না যাওয়ায় এবং কাজ শিখে ফেলায় এত কাজের চাপ দেয়া হল যেন আমি নিজেই চাকরি ছেড়ে বের হয়ে যাই। মাঝে মাঝে আসলেই সহ্যের বাইরে চলে যেত, কিন্তু সিইও স্যারের আমার উপর এত আস্থা ছিল দেখে কেবল তাঁর জন্য চাকরি ছাড়লাম না। নিজেই নিজের ট্রান্সফার করিয়ে হাই ভোল্টেজ় ল্যাবে চলে এলাম। এরপর কখনই আর পিছে তাকাতে হয়নি।
তবে সবাই কিন্তু বিরূপ ছিলেন না, আমার কাছাকাছি বয়সের ইঞ্জিনিয়াররা ছিল প্রচণ্ড হেল্পফুল। বড় ভাইয়েরা অনেকেই অনেক সাহায্য করেছেন সব সময়। বিশেষ করে যখন সবাই দেখলেন কয়েক মাস পরও আমি যাচ্ছি না, বরং দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছি, সবাই তখন সহানুভূতিশীল হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আমার আরো অনেক ফ্রেন্ড জয়েন করলো। মেয়েও আসল। আমি এখন আর একা না, আমার সাথে আমাদেরই ইইই-০৬ এর নাজিয়া আহমেদও আছে। আমরা প্রতিদিন দুই ঘন্টা জার্নি করে অফিসে যাই, আবার দুই ঘন্টা জার্নি করে রাত ৭~৮টায় বাসায় ফিরি। আমাদেরকে টেবল টেনিসও শেখানো হয়েছে, আমরা ছেলেদের সাথেই খেলতাম। আমাদের কাজে খুশি হয়ে সিইও স্যার নিজের লন্ডন থেকে পড়ে আসা মেয়েকেও এই ঢাকা থেকে ৪০কিলো দূরের ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দিলেন। মাঝে মাঝে হেড-অফিস থেকে আমাদের আরো মেয়েরা এসেও থেকে যান আমাদের সাথে।
সবচেয়ে ভালো বিষয়টা হচ্ছে – এখন আমাদের ফ্যাক্টরি ভর্তি মেয়ে। মেয়ে টেকনিশিয়ান। মেয়েরা কাজের প্রতি বেশী মনোযোগী – এই ধারণা থেকে একঝাঁক মেয়েকে টেকনিশিয়ান হিসেবে নিয়োগ করেছেন আলম স্যার। মেয়েরা উইন্ডিং করছে, স্ক্রু লাগাচ্ছে, বাসবার সেট করছে। তারা দেখিয়ে দিচ্ছে শুধু গার্মেন্টসে সেলাই-ই না, তারা টেকনিক্যাল কাজও পারে। তাদেরকে দেখে গর্ববোধ হয়।
স্যার বলেন উনি মেয়েদের এই রেভ্যুলুশান দিয়ে পুরা দেশটাকে চেঞ্জ করে দিবেন। আমি দোয়া করি তাই যেন হয়।