সাদিয়া আফরোজ শীতল: প্রথম যখন আমেরিকা আসলাম পিএইচডি করার জন্য তখন পেটে গুতো দিলেও ইংরেজি বের হত না। হুট করে কেউ ইংরেজি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে প্রশ্নটা বাংলায় অনুবাদ করে, তারপর বাংলায় একটা উত্তর ঠিক করে, তারপর সেটাকে অনুবাদ করে উত্তর দিতে দিতে বহুক্ষণ লেগে যেত, তারপর যে উত্তরটা দিতাম সেখানে ১০১ টা ব্যাকরণ ভুল থাকত।
কি ভুলভাল ইংরেজি বলবো, এই লজ্জায় কথা যত কম বলা যায় তার চেষ্টা করতাম। এই রকম অবস্থায় আমার প্রফেসর একদিন আমাকে বললেন, “তুমি কি ওমেন ইন কম্পিউটিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হতে চাও?” “কি আছে দুনিয়ায়” এই চিন্তা করে আমি ভুল উচ্চারণে বলে ফেললাম “সিওর!”
ড্রেক্সেলের ওমেন ইন কম্পিউটিং ক্লাবটা বেশি পুরাতন না, আর বেশিরভাগ মেয়েই আন্ডারগ্রাড। প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে একটা ছোট রচনা লিখতে হয় যে আমাকে ভোট দিলে জনতার কি কি লাভ হবে। রচনা পড়ে সবাই প্রেসিডেন্ট/ভাইস-প্রেসিডেন্ট/সেক্রেটারী পদে ভোট দেয়। একটু চিন্তা করে আমি যেটা লিখলাম তার মূল বক্তব্য হলো যে আমি প্রেসিডেন্ট হলে একটা ব্লগ বানাবো, যেখানে সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা/সমস্যা শেয়ার করতে পারে আর “মেন্টরশিপ” প্রোগ্রাম চালু করব, যাতে বড় স্টুডেন্ট রা ছোটদের সাহায্য করতে পারে। ভুলভাল ইংলিশে আমার রচনা বেশি ভোট পেল আর আমি হয়ে গেলাম প্রেসিডেন্ট!
ওমেন ইন কম্পিউটিং ক্লাবের আসল উদ্দেশ্য হলো সব মেয়েদের একসাথে করা, যাতে তারা নিজের অভিজ্ঞতা/সমস্যা শেয়ার করতে পারে। কম্পিউটার সায়েন্স এ মেয়ের সংখ্যা খুবই কম। এর একটা বড় কারণ হলো মেয়েরা নিজেরা, অনেকসময় টিচাররাও মনে করে যে, মেয়েরা প্রোগ্রামিং পারে না, মেয়েরা অংকে ভালো না, আর প্রোগ্রামিং না পারলে কম্পিউটার সায়েন্স এ পড়ে কোনো লাভ নাই। আবার মেয়েরা ক্লাসে মাত্র ২/৩ টা মেয়ে স্টুডেন্ট দেখে মনে করে কম্পিউটার সায়েন্স মেয়েদের জন্য না। আবার অনেক মেয়েই কম্পিউটার সায়েন্স এ শুরুতে পড়া শুরু করলেও শেষ করে না।আরেকটা সমস্যা হলো, কম্পিউটার সায়েন্সে বিখ্যাত নারীর অভাব।
আসলে কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্স এ অনেক প্রতিষ্ঠিত নারী আছেন, কিন্তু তাদের কথা মানুষ বেশি জানে না। যেমন আমি আমেরিকা আসার আগে ড. গ্রেইস হপারের কথা জানতামই না। কম্পিউটার সায়েন্সে তার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। উনি প্রথম কম্পাইলার আবিস্কার করেন যা কিনা কম্পিউটার প্রোগ্রামকে মেশিন কোডে রুপান্তরিত করবে, যাতে কম্পিউটার তা বুঝতে পারে। কম্পিউটার সবকিছু বোঝে ০-১ দিয়ে, কম্পাইলার ইংলিশে লিখা কম্পিউটার প্রোগ্রামকে ০-১ এ রুপান্তরিত করে। চিন্তা করে দেখুন ০-১ দিয়ে সব কিছু লিখতে হলে কম্পিউটারে কাজ করা কতই না কঠিন হত!
আরেকজন বিখ্যাত নারী হলেন ড. ফ্রান্সিস অ্যালেন যিনি প্রথম মহিলা টিউরিঙ পুরস্কার পেয়েছেন, যা কিনা কম্পিউটার সায়েন্সে নোবেল পুরস্কারের সমান। গত বছর আরেকজন নারী টিউরিঙ পুরস্কার পেলেন ড. শাফি গোল্ডওয়াসার, ক্রিপ্টোগ্রাফিতে অবদানের জন্য। ড. শাফির গবেষণার জন্যই আমরা ইন্টারনেটে নিরাপদে টাকা আদান-প্রদান করতে পারি, যে কেউ চাইলেই ইন্টারনেট থেকে টাকা চুরি করতে পারবে না।
যুগে যুগে পুরুষশাসিত সমাজ মেয়েদের অবদানকে ছোট করে দেখে, সমাজ/সংসারের নাম দিয়ে মেয়েদেরকে শুধু ঘরের কাজে ব্যস্ত রাখতে চায়। এত কিছুর পরও কত নারীর অবদানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে কত শাখায় কত উন্নতি করেছে- ভাবলেই মেয়ে হিসাবে আমার অনেক গর্ব হয়। এত এত ট্যালেন্ট নারী থাকার পরও যখন মানুষ বলে “মেয়েদের বুদ্ধি কম,” “মেয়েদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং না,” এর পরও যখন মানুষ মেয়েসন্তানকে উচ্চশিক্ষা না করিয়ে অল্পবয়সে বিয়ের কথা ভাবে, কি যে রাগ লাগে আমার!
ওমেন ইন কম্পিউটিং ক্লাবে সব মেয়ে একসাথে হলে এইসব কথা জানতে পারে। নিজেদের অভিজ্ঞতা/সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে যে আসলে কেউই মায়ের পেটের থেকে অংক, প্রোগ্রামিং এর জ্ঞান নিয়ে আসে না, অঙ্ক/প্রোগ্রামিং আর যেকোনো কাজের মতই প্র্যাকটিসের ব্যাপার, যত প্র্যাকটিস করবে তত ভালো পারবে। আর প্রোগ্রামিং এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমস্যা সমাধান করতে শেখা। ওমেন ইন কম্পিউটিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত নারী প্রোগ্রামার, গুগল/মাইক্রোসফট এ কাজ করা নারীদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে যাতে মেয়েরা এইসব দেখে উত্সাহী হয়।
আমি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন চেষ্টা করেছিলাম যাতে প্রতিমাসে অন্তত একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা যায়। অনুষ্ঠানগুলির কিছু ছিল সামাজিক, কিছু জ্ঞানদীপ্ত, যেমন গ্রেইস হপার এর জন্মদিন পালন (সবাই কেক কাটবে আর একটা ছোট কুইজ হবে গ্রেস হপারকে নিয়ে), চাইনিজ বছরের প্রথম দিনে আয়োজন করলাম চাইনিজ খাবারের, বিভিন্ন কোম্পানি নিয়ে ছোটখাটো ক্যারিয়ার ফেয়ার, গুগলের সাথে কথা বলে আয়োজন করলাম গুগল-নিউ ইয়র্ক এ ভ্রমণ, থ্যাংকসগিভিং, হ্যালোউইনের “পটলাক” যেখানে সবাই কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে আসবে (সবাই মহা অলস তাই সবাই ফাঁকিবাজি করে খাবার কিনে নিয়ে আসলো), টেকি মুভি দেখতে যাওয়া (আমরা দেখলাম “আভাতার”), রক-ক্লাইম্বিং করতে যাওয়া।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মত আমিও ইলেকশনের আগের প্রতিজ্ঞা ঠিক মত রাখতে পারলাম না– ব্লগ একটা বানালাম বটে, কিন্তু সেটায় আমি বাদে আর কেউই কিছু লিখল না, আর মেন্টর হিসাবেও কাউকে পাওয়া গেল না। তবে আমার পরের প্রেসিডেন্টরাও মেন্টরশিপ চালু রেখেছিল। আর এই এক বছরে আমার ইংরেজিতে কথা বলা আর লিখার অনেক উন্নতি হলো, কারণ প্রেসিডেন্ট হিসাবে অনেকের সাথে আমাকে বাধ্য হয়ে অনেক কথা বলতে হতো, লজ্জা লাগলেও সব অনুষ্ঠানে যেতে হত (শেষের দিকে আর কথা বলতে অহেতুক লজ্জা লাগত না)। অনেক নতুন বন্ধুও হয়ে গেল, তখন ইউনিভার্সিটি যেতেও ভালো লাগত আগের থেকে।
সবচেয়ে বড় লাভ হলো যে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল আগের চেয়ে যা আমার পড়াশুনার কাজে অনেক সাহায্য করেছিল।
তখন খুব মনে হতো যে বাংলাদেশে থাকতে যদি এইরকম কোনো ক্লাবে থাকতে পারতাম, কত কি যে করে ফেলতাম!
তখন খুব মনে হতো যে বাংলাদেশে থাকতে যদি এইরকম কোনো ক্লাবে থাকতে পারতাম, কত কি যে করে ফেলতাম!