সাহেরা কথা- ১৪

Black womenলীনা হক: আমার মেয়েটির এ লেভেল পার্ট ১ এর পরীক্ষা চলছে। মেয়ে যত না ব্যস্ত পড়াতে তার থেকে বেশী ব্যস্ত কোন পরীক্ষার দিন কোন ড্রেস পরে যাবে, পরীক্ষা শেষ হলে বন্ধুদের সাথে কি কি মজা করবে এইসবে। আর আমি মেয়ের পরীক্ষার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। কলিকাল একেই বলে।

এমনিতে আমার মেয়েটি খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটু ঝামেলাই করে। ১৭ বছর বয়সে পা দিয়ে তা যেন আরও বেড়েছে। এটা খাব না, সেটা খাব না কারণ ওজন বেড়ে যাবে। রাগ করি, ধমকাই, কখনো কাজ হয় বেশীরভাগ সময় বৃথা চেষ্টা। পরীক্ষার এই কয়দিন তার উপরে প্রায় সামরিক শাসন জারী করেছি খাওয়া বাধ্যতামুলক করতে।

সকালে অফিসে আসার সময় সাহেরাকে অনেকবার করে বলি মেয়ে যেন এক কাপ দুধ আর একটা ডিম অবশ্যই খায়। সাহেরা যেন খেয়াল করে মাঝখানে মেয়েকে কোন একটা ফল খেতে দেয়। দুপুরে মেয়ে কতটুকু ভাত খেলো একটু যেন নজর রাখে। বেশীসময় টিভি দেখলে যেন মানা করে। সাহেরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমার কথা, ফোন করে আমাকে জানায় মেয়ে না খেতে চাইলে।

কন্যা খুবই ক্ষিপ্ত সাহেরার উপরে,’ খালা, আপনার আর কোন কাজ নাই আমার উপরে খবরদারী করা ছাড়া?’ বন্ধুদেরকে ফোনে জানায়, মা এবং মায়ের সহকারী সাহেরা খালার অত্যাচারে তার জীবন কালি কালি হয়ে গেল।‘

গতকাল মেয়ের পরীক্ষা ছিল দুপুর ৩টা থেকে। বনানী থেকে ধানমণ্ডি যেতে নরম্যাল সময়ে লাগে ৪৫ মিনিট, ভর দুপুরে হয়তো দেড় ঘণ্টা লাগবে এই ভেবে যাত্রা শুরু দুপুর ১টার সময়। সাহেরা আজ অনেক ভোরে এসেছে। তাড়াতাড়ি রান্না সেরে মেয়েকে খেতে দেয়া। এতো তাড়াতাড়ি সে দুপুরের খাবার খেতে অভ্যস্ত নয়। তড়িঘড়ি করে এক বোতল লেবুর শরবত, একটা আপেল আর একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে নিলাম। যাতে পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে খেতে পারে। এইসব কাজ করতে করতেই সাহেরার সাথে টুকটাক কথা চলে।

সাহেরার বড় মেয়েটি দেশে তার নানীর কাছে থেকে ক্লাস এইটে পড়ছে। ক্লাস ফাইভের সমাপনী পরীক্ষায় অনেক ভালো করেছিল মেয়েটি। মেয়ের পরীক্ষার সময় সাহেরা দেশে যেতে পারে নাই। তখন সে আরও দুটি বাসায় কাজ করতো। সেই সব বাসা থেকে ছুটি পায় নাই। মেয়ের ফল প্রকাশের সময়ও যেতে পারে নাই মেয়ের আনন্দের ভাগীদার হতে। শরবত ছেঁকে বোতলে ভরছি, সাহেরা ছাঁকনির নীচে বোতল ধরে আছে। আস্তে গলায় হঠাৎ বলে সে,’ আফা, এতো আদর করেন মাইয়াক, মুই মোর মাইয়াক একনা দেখবারও পারি না আফা! না পারি কাছে থাকতে না পারি কিছু আন্না (রান্না) করে খাওয়াতে! সমাপনী পরীক্ষার সময় হিদল ভর্তা দিয়ে বাসী ভাত খাইয়া ওমরা( সে) পরীক্ষার হলত গেইছে’। ধক করে কথাটা লাগলো বুকের মধ্যে। আসলেও তো! তারপরেও সাহেরার মেয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে।

সাহেরা আমার মেয়েটিকে বড় যত্ন করে। তার খাওয়ার তদারকি থেকে শুরু করে কাপড় জামা ভাঁজ করে রাখা, বিছানা তোলা সবই সাহেরা করে দেয়। আমি অনেক সময় রাগ করি,খাওয়ার ব্যপারটা ছাড়া আর কোন কাজ সে যেন না করে দেয়। সাহেরা হাসে,’ ছাওয়া মানুষ আফা, কাম করতে কি ভালো নাগে ওমার(ওর)? আর মোরতো কুন কষ্ট হয় না আফা আম্মুর কাম করতে’। মেয়ের বন্ধুরা বাসায় এলে দফায় দফায় তাদের খাবার দেয়া।

আমি বলি,’ সাহেরা, তুমি আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছ এই মেয়েকে’। আজ মনে হল নিজের মেয়েকে যে স্নেহ সে করতে পারে না তারই কি বহিঃপ্রকাশ আমার মেয়ের যাবতীয় ঝামেলা সহ্য করা! দেখি সাহেরা একমনে তাকিয়ে আছে ছাঁকনির দিকে যেখানে লেবুর শাঁস বিচি আটকে যাচ্ছে আর পরিষ্কার শরবত বোতলে জমা হচ্ছে। কি মনে হচ্ছিলো সাহেরার? দারিদ্র্য আর বাস্তবতার নির্মমতা তাকে আর তার মেয়েকে একসাথে থাকতে দেয় নাই। নিজের মেয়ের বড় হয়ে ওঠা দেখতে পারছে যে মা, সে অন্যের মেয়ের বেড়ে ওঠার আনন্দের অংশীদার হচ্ছে।

সব প্রস্তুতি সেরে রওনা করছি। দরজার কাছে সাহেরা দাঁড়িয়ে। মেয়ে সাহেরাকে বলল,’খালা যাই। দোয়া করেন।‘ সাহেরা বলে,’ আল্লাহ ভরসা। ঠাণ্ডা মাথাত পরীক্ষা দিও আম্মু। আমি কাইল রাইতেরথন তুমার জন্য দুয়া করি বাহে‘ আমাকে বলে পৌঁছে তাকে ফোন করতে। ধানমণ্ডির এই বিদঘুটে পরীক্ষার হলের কথা সাহেরাও জানে। লিফটে উঠি মেয়েকে সাথে নিয়ে। বন্ধ হতে থাকা লিফটের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সাহেরা তখনো দাঁড়িয়ে। অন্যের মেয়ের সাফল্যের জন্য প্রার্থনারত এক মাকে দেখি যে নিজের মেয়েকে কাছে পায় না প্রায় বছরখানেক।

মনে মনে বলি, সাহেরা, তোমার জায়গায় আমি হলে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারতাম না। স্যালুট তোমাকে।

শেয়ার করুন: