উইমেন চ্যাপ্টার: নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগরা ইউনিয়নের বহেরাতলী গ্রাম। মেঘালয় সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের এই গ্রামটিতে বর্তমানে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও একসময় হাজং এবং গারো সম্প্রদায়ই বাস করতো। যদিও বর্তমানে মাত্র সাতটি হাজং পরিবার আছে এই গ্রামে।
এই বহেরাতলী গ্রামেই বাস করেন ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের নেত্রী কমরেড কুমুদিনী হাজং। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও এখনো নবীনদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা। কুমুদিনী তাঁর সংগ্রামমুখর জীবনে অংশগ্রহণ করেছেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামে। কুমুদিনী হাজং বর্তমানে তাঁর মেঝ ছেলে অর্জুন হাজং এর সাথে থাকেন। তার বয়স এখন প্রায় ৮০। সরকারী বয়স্ক ভাতার কয়টা টাকাই তার সম্বল। ছেলে অর্জুন বিজয়পুর চীনামাটির খনিতে দিন মজুরি করেন। অসুখ-বিসুখ তেমন না থাকলেও বয়সজনিত কিছু শারীরিক সমস্যা কুমুদিনীকে ইদানিং বেশ কাবু করে ফেলেছে। স্মৃতি শক্তিও দুর্বল হয়ে এসেছে। অনেক কথাই মনে করতে পারেন না। তবে সেই দিনটির কথা তার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। শীতের সকালে গ্রামের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ কৃষি কাজে ক্ষেতে গেছে। সকাল ১০টার দিকে বিরিশিরি থেকে ৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমের এই বহেরাতলী গ্রামেই তৎকালীন ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি দল কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজংএর খোঁজে বাড়িতে হানা দেয়। টংক আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের নেতা লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের গ্রেফতার করাই ছিল সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্য। ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর বহেরাতলীর দিকে আসার সংবাদ পেয়েই লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর তিন ভাই আত্নগোপন করে বিপ্লবী নেতা কমরেড মনি সিংহের গোপন আস্তানায় চলে যান। তাদের ধরতে না পেরে ক্ষিপ্ত সশস্ত্র সেনারা বাড়ির নারীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে লংকেশ্বর হাজং এর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনীর কাছে জানতে চায় লংকেশ্বর হাজং কোথায়। টংক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং ‘জানিনা’ বললে সেনারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা কুমুদিনী হাজংকে বিরিশিরি সেনা ছাউনিতে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এই অবস্থায় বাড়ীর আরেক নারী সদস্য পাশের বাড়িতে গিয়ে কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পৌঁছায়। এ সংবাদ হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে শতাধিক হাজং নারী-পুরুষ সহ রাশিমনি হাজং এর নেতৃত্বে দিস্তামনি হাজং, বাসন্তি হাজংসহ আরও হাজং নারীরা লাঠি, কাস্তে, দা বটি সহ প্রতিরোধ করে দাঁড়ায় ও ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর কাছ থেকে কুমুদিনী হাজংকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে সশস্ত্র সেনারা নৃশংসভাবে তাঁদের ওপর গুলি চালায়। এতে রাশিমনি হাজং গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুরেন্দ্র হাজং সহ আরও বেশ কয়েকজন এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ ঘটনায় অন্যান্য হাজং নারী পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সেনাদের উপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায়। তাঁদের হামলায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দু’সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাকি সেনারা দৌঁড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
কৃষক নারীদের মধ্যে শহীদ হিসেবে রাশিমনি হাজং এর নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। নিঃসন্তান হয়েও হাজংদের অধিকার ও নারী সংগ্রামের প্রতীক রাশিমনি হাজং সম্প্রদায়ে হাজং মাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন, আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের প্রেরণার উত্স।
হাজং সম্প্রদায় বরাবরই সুসং জমিদারদের বাধ্য প্রজা ছিল। এই পাহাড়ি অঞ্চলে জমিদারদের নির্দেশই ছিল শেষ কথা। এই জমিদারদের সৃষ্ট টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তি অনুসারে টংকের ধান জমিদার-মহাজনদের দিতেই হতো। এতে হাজংরা ক্রমেই জমি বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে। এ সময় সুসং দুর্গাপুরের জমিদারদের ভাগ্নে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহ-এর নেতৃত্বে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে টংক প্রথা উচ্ছেদ, টংক জমির খাজনা স্বত্ব, জোত স্বত্ব, নিরিখ মতো টংক জমির খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ইত্যাদি দাবি নিয়ে টংক আন্দোলন শুরু হয়। হাজং সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থেই টংক আন্দোলনের সংগে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। সে সূত্রেই কুমুদিনী হাজং এর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর তিন ভাই টংক আন্দোলনের সংগে জড়িয়ে পড়েন।
বহেরাতলীসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামে কুমুদিনীসহ গোটা পরিবার টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য হাজংদের মাঝে সাংগঠনিক কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতো। এছাড়া পরিবারটি কমরেড মনি সিংহর সাথেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে চলতো। তৎকালীন জমিদার ও ব্রিটিশ বাহিনীর কোপানলে পড়বার পিছনে এটাও একটা কারণ।
ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তি সংগ্রামে অবদানের জন্য কুমুদিনী হাজং অনন্যা শীর্ষদশ, ২০০৩ (আন্দোলন) নির্বাচিত হন। আনুষ্ঠানিকভাবে সাপ্তাহিক অনন্যা কুমুদিনী হাজংকে একটি ক্রেস্ট ও নগদ ১৫০০ টাকা প্রদান করেন। এছাড়া কুমুদিনী হাজংকে বসবাসের জন্য একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে দেয়। ২০০৫ সালে স্বদেশ চিন্তা সংঘ কুমুদিনী হাজংকে ড. আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার প্রদান করে। এই কমিউনিস্ট নেত্রীকেই প্রথমবারের মতো প্রদান করা হয়েছে কমরেড মণি সিংহ স্মৃতি পদক ২০০৭। কুমুদিনী হাজং-এর স্বামী লংকেশ্বর হাজংকে তে-ভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি ময়মনসিংহ ১৯৯৬ সালের ২৫ অক্টোবর সংবর্ধনা দেয়।
কারো কাছে কোন কিছু চাওয়ার নাই এই অশীতিপর মহিয়সী নারীর। অতীতের সোনালী স্মৃতি ও মানুষের ভালবাসাকেই সম্পদ মনে করে বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত কুমুদিনী হাজং তৃপ্ত। শুধু চান যেন জগতের সকল মানুষ সুখে থাকে।