হাইকোর্টের নির্দেশ খাতায় আছে, কাজে নেই

gorfa-bigউইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক (জুন ৩): বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য হাইকোর্টের একটি দিকনির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা মানা হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো কমিটিও নেই। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে এ সংক্রান্ত কমিটি আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে কমিটির নিয়মিত সভা হয় না। অভিযোগ করা তো দূরের কথা, কাউন্সেলিংও হয় না। আবার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়টা সম্পর্কেই জানে না। এই নির্দেশনা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও তা এখন পর্যন্ত করা হয়নি।

২০০৮ সালের ৭ আগস্ট বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। এরপর একই বছরের ১৮ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদ সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সকল সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি অফিস, কর্মক্ষেত্র এবং সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা বিশদভাবে জানানোর জন্য মন্ত্রিপরিষদের সচিবসহ আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, নারী এবং শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেন।

পরবর্তীতে কয়েকটি শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সকল সরকারি, আধা সরকারি অফিস এবং সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি দিকনির্দেশনামূলক রায় ঘোষণা করেন। রায় অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক। যার পরিচালনায় থাকবেন অবশ্যই একজন নারী।

এ বিষয়ে কথা হয় বরিশালের গৌরনদী গার্লস হাইস্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্রী প্রজ্ঞা মাহজাবীনের সঙ্গে। প্রজ্ঞা জানান, তার বিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে এ ধরনের কোনো কমিটি নেই। বন্ধুদের মধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়, রাস্তায় কোনো ছেলে টিজ করলে সেগুলো নিয়েও কথা হয়, কিন্তু এগুলো শুধুমাত্র বন্ধুদের আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এসব বিষয় নিয়ে কোনো সময়ই শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কোনো কাউন্সেলিং বা আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়নি।

এক ছাত্রী অভিযোগ করে বলেন, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার প্রাইভেট শিক্ষক তাকে শারীরিকভাবে নানা সময় হেনস্থা করেন। বিষয়টি তখন তার কাছে অসহ্য ঠেকলেও, কাকে বলবেন, কী বলবেন এই ভয়ে দীর্ঘদিন চুপ ছিলেন। আবার প্রাইভেট শিক্ষক প্রতিবেশী এবং সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে উচ্চপদে থাকার জন্য সহজে কোনো কিছু বলতে গিয়ে মনে একটা ভয় কাজ করতো। সেই শিক্ষক তাকে বাড়িতে কিছু না বলার জন্য হুমকিও দিতো। এখনো সেই সময়কার কথা মনে হলে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠেন অদিতি।

তার স্কুলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো কমিটি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ রকম কোনো কমিটি নেই। এখানে কখনই কোনো আলোচনা হয় না। কাউন্সেলিংয়ের তো প্রশ্নই আসে না।

সাউথ পয়েন্ট স্কুলের বনানী শাখার দশম শ্রেণীর এক ছাত্রী জানান, তার বিদ্যালয়ে একটি অভিযোগ বাক্স আছে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে কখনো বন্ধুদের বাইরে কোনো আলোচনা হয়নি। আর কোনো কমিটি আছে বা কমিটির কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেছে কিনা এমনটাও তার জানা নেই।

বিষয়টি নিয়ে সাউথ পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজের মালিবাগ শাখার ভাইস প্রিন্সিপাল জেরিনা ফেরদৌস বলেন, তার চাকরির ১০ বছরে এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনা তিনি পেয়েছেন। এর মধ্যে গুলশানের (বর্তমানে বনানীর শাখা) নিকেতন শাখায় দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন ছাত্রী ছুটিতে দাদার বাড়িতে বেড়াতে গেলে তার আত্মীয় দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। তৃতীয় শ্রেণীর একজন ছাত্রী প্রাইভেট শিক্ষকের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। এসব ঘটনায় শিশু দুটি খুব ভয় পায় এবং মানসিক সমস্যায় পড়ে। পরে বিদ্যালয়ের কাউন্সেলিংয়ের শিক্ষক দ্বারা তাদের সুস্থ করে তোলা হয়।

তিনি আরো বলেন, তাদের বিদ্যালয়ে একটি অভিযোগ বাক্স আছে। আর এ সংক্রান্ত একটি কমিটিও আছে। তবে সেই কমিটি এখন নিয়মিত সভায় বসে না। কিন্তু তিনি অভিযোগ করেন অভিভাবকদের আচরণ নিয়ে। তিনি বলেন, অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের এ রকম ঘটনা গোপন করেন। ভাবেন পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন হবে। তাই তারা শিশুদের কাউন্সেলিংও করাতে আসেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৌচাকের সিদ্ধেশ্বরী কলেজের বাংলার শিক্ষক বলেন, তার জানা মতে এ রকম কোনো কমিটি কলেজে নেই। তারা কোনোদিন এর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি।

রংপুর জেলার সৈয়দপুর উপজেলার টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মোছা. মাহবুবা বেগম বলেন, তাদের বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই লেখাপড়া করে। কোনো সমস্যা হয়নি। তাই এ ধরনের কোনো কমিটি তৈরির প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়নি। অভিযোগ থাকলে হয়তো বিষয়টি বিবেচনা করা যেতো। হাইকোর্টের এই রায়টি সম্পর্কেও তিনি কিছু জানেন না।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, এই দিকনির্দেশনা নিয়ে আইন করার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি সবার জানা দরকার সেটি হলো যৌন হয়রানি কি তা চিহ্নিত করা এবং একটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত করা। তবে যতোদিন আইন না হয় ততোদিন সংবিধানের ১১১ ধারা অনুযায়ি এই রায়টা মানা বাধ্যতামূলক। তবে মহিলা আইনজীবী সমিতি ল’ কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা করে এ বিষয়টি আইন করার জন্য পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তখন (২০০৯ সালে) মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসে আইন না করার জন্য। কিন্তু মহিলা আইনজীবী সমিতি মনে করে আইন করার প্রয়োজনীয়তা আছে।

তিনি আরো বলেন, গত ২৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্যানেল ডিসকাশন হয় প্রিভেনশন এন্ড প্রোটেকশন অফ ইয়ং ওমেন ফরম সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অফেন্সেস নিয়ে। সেখানে প্যানেল আলোচনায় প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর নাসরিন আহমেদ জানান, তিনি এ বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না এবং তারা কোনো কমিটি করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও জানেন না। ফলে অভিযোগও করতে পারেন না।

সালমা আলী বলেন, এই মামলার প্রধান দুই বিবাদী হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই এমন অবস্থা হলে আর কিছু বলার থাকে না।

তিনি বলেন, বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। আর যেসব জায়গায় আছে সেখানে অভিযোগও আসে না। অভিযোগ না এলে এই কমিটির কাজ থাকে না। আবার এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আছে। তাদের কাছে গেলে বলা হয়, বিষয়টা জানা হলো। এরপর থেকে করবো। তবে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি এই নির্দেশনা মনিটর করার চেষ্টা করছে।

শেয়ার করুন: