ডিজিটাল সহিংসতায় নারী: ক্ষমতার পালাবদলে অপরিবর্তনীয় দুঃস্বপ্ন

সুমিত রায়:

ক্ষমতা বদলের হাওয়া লাগে, রাজনৈতিক মঞ্চের কুশীলবেরা বদলায়, কিন্তু নারীর প্রতি ডিজিটাল আক্রমণের কদর্য চিত্রটি যেন এক অপরিবর্তনীয় ধ্রুবক। যে মানুষগুলো হয়তো একসময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন, আজ তারাই যেন ভিন্ন পরিচয়ে সেই একই বিদ্বেষের চর্চা করছেন। রিসেন্টলি চারটি এরকম ঘটনা নজরে এলো –
১. সারজিসের সাথে বৈষম্যবিরোধী সংগঠনের এক মেয়ের এডিটিং করা ছবি বসিয়ে সেটা পোস্ট করেছে যুবদলের এক নেতা, যিনি লন্ডন থাকেন।
২. মুহাম্মাদ ইশরাকের স্ত্রীর ছবি নিয়ে খুবি বাজে ও নোংরা ভাষা লিখে পোস্ট করেছেন কোন এক রক্ষণশীল জাজমেন্টাল ব্যক্তি, যিনি ইশরাকের ভাষায় তৌহিদী জনতার কেউ।
৩. ছাত্রদলের একজন নারী নেত্রীকে রেইপ থ্রেট দিয়েছেন নতুন বন্দোবস্তের রাজনীতি পছন্দ করে এমন দুইজন। তাদের দলীয় কোনো পদবী না থাকলেও ফেসবুক এক্টিভিটি দেখে বোঝা যায় তারা জানাপার সমর্থক।
৪. বিএনপিপন্থী একটি পেজ থেকে জানাপার সামান্থা শারমিনকে পর্ন তারকার সাথে তুলনা করে পোস্ট করা হয়েছে।

সব মিলে এই বিষাক্ত চক্রে বাদ যাচ্ছে না প্রায় কোনো পক্ষই।

প্রশ্ন জাগে, আমরা পরিবর্তন হলাম কোথায়? এই যে নারীর প্রতি কটূক্তি, যৌন হুমকি, ধর্ষণের হুমকি, সম্পাদিত ছবি ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো, কিংবা কোনো পুরুষের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তার পরিবারের নারীদের হয়রানি করা—এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এগুলো আসলে এক গভীর এবং পদ্ধতিগত সমস্যার প্রকাশ, যাকে আমরা বলতে পারি লিঙ্গ-ভিত্তিক ডিজিটাল সহিংসতা (Gendered Digital Violence) অথবা রাজনৈতিক নারীবিদ্বেষ (Political Misogyny)। এই সহিংসতা কেবল রাজনৈতিক মতপার্থক্যের প্রকাশ নয়, বরং এটি সমাজে প্রোথিত নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতিরই ডিজিটাল প্রতিফলন। ক্ষমতা কাঠামোর পালাবদলের সাথে এর চরিত্র বদলায় না, শুধু ব্যবহারকারীর পরিচয় বদলায়। এই আক্রমণের কৌশলগুলোও নির্দিষ্ট—কখনো ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে (Doxxing) চাপ সৃষ্টি করা, কখনও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যৌনরূপে উপস্থাপন করে (Defamation) চরিত্র হনন করা, কখনও যৌন গুজব বা মিম ছড়িয়ে নারীর রাজনৈতিক ভূমিকাকে অস্বীকার বা তুচ্ছ করা (Discrediting activism), আবার কখনও সরাসরি সহিংসতা বা ধর্ষণের হুমকি দিয়ে নারীর আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়া এবং তাকে নীরব করে দেওয়ার চেষ্টা করা। এই সবগুলো কৌশলই রাজনৈতিক পরিসরে নারীবিদ্বেষের চেনা ছক।

এই ঘৃণার শিকড় আসলে অনেক গভীরে প্রোথিত। নারীবাদী তাত্ত্বিক সিলভিয়া ফেদেরিচি তার ‘ক্যালিবান অ্যান্ড দ্য উইচ’ গ্রন্থে দেখাচ্ছেন, পুঁজিবাদী ও আধুনিক ক্ষমতা কাঠামো নির্মাণে নারীর শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অন্যতম ভিত্তি। মধ্যযুগে যেভাবে ডাইনি অপবাদ দিয়ে স্বাধীনচেতা নারীদের দমন করা হতো, আধুনিক ডিজিটাল যুগেও যেন তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। নারীর রাজনৈতিক সত্তা এবং তার শরীরকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়, কারণ তার সরব উপস্থিতি ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এই নিয়ন্ত্রণকামী মনোভাবই নারীর প্রতি যৌন হয়রানি, কুৎসা রটানো বা অবমাননার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা তার রাজনৈতিক কণ্ঠকে রুদ্ধ করার একটি ঘৃণ্য প্রচেষ্টা।

মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই বিদ্বেষমূলক চর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সারা বানেট ও এস্থার জেন্টিলি তাদের পোস্টফেমিনিস্ট মিডিয়া কালচার বিষয়ক আলোচনায় দেখিয়েছেন, এই যুগে মিডিয়া প্রায়শই নারীকে এক ধরনের ‘ক্ষমতায়িত ভিকটিম’ (empowered victim) হিসেবে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ, নারীকে একদিকে যেমন স্বাধীন ও সক্রিয় হতে উৎসাহিত করা হয়, অন্যদিকে যখনই সে প্রকৃত ক্ষমতা অর্জন করে বা প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়, তখনই তাকে অতিমাত্রায় যৌনায়িত (sexualized) করে বা তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে হেয় করা হয়। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে হয়তো বাহ্যিকভাবে স্বাগত জানানো হয়, কিন্তু যখনই তার পরিচিতি বা প্রভাব বাড়ে, তখন তাকে দমিয়ে রাখার জন্য তার যোগ্যতা বা রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তে তার শরীর বা ব্যক্তিগত জীবনকে আক্রমণের কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। পর্ন তারকার সাথে তুলনা করার ঘটনাটি এই প্রবণতার একটি নির্লজ্জ উদাহরণ।

কেন নারীর রাজনৈতিক উত্থান বা সক্রিয়তা অনেকের কাছে এত অসহনীয় হয়ে ওঠে? জুডিথ বাটলার তার জেন্ডার ট্রাবল বইয়ে লিঙ্গকে কেবল জৈবিক বাস্তবতা নয়, বরং একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পারফরম্যান্স হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যখন একজন নারী প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বেঁধে দেওয়া ভূমিকার বাইরে গিয়ে নেতৃত্ব দেয়, নীতি নির্ধারণে অংশ নেয় বা কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্য রাখে, তখন সেটি বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এই চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আসে আক্রমণ—যে আক্রমণের লক্ষ্য থাকে নারীকে অপমানিত করা, ভয় দেখানো এবং তাকে আবার সেই ‘প্রথাগত’ নারীত্বের খোলসে ঢুকিয়ে দেওয়া। ছাত্রদল নেত্রীকে দেওয়া ধর্ষণের হুমকি এই প্রতিক্রিয়াশীলতারই একটি পাশবিক প্রকাশ, যা নারীর রাজনৈতিক স্পর্ধা এবং সক্রিয়তাকে সহ্য করতে না পারারই পরিচায়ক।
কিন্তু সবচেয়ে হতাশাজনক দিকটি হলো, এই ঘৃণ্য সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে এর চর্চা বন্ধ হয় না, বরং হাতবদল হয়। এটি হলো “সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন” (Regime Change without Cultural Revolution)। রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শ বদলায়, কিন্তু নারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং তাকে দমিয়ে রাখার যে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা প্রায় একই রকম থেকে যায়। যারা একসময় হয়তো ভুক্তভোগী ছিলেন, ক্ষমতার সমীকরণের বদলের সাথে সাথে তারাই আবার একই ধরনের নিপীড়নের হাতিয়ার তুলে নিচ্ছেন। পরিবর্তন আসছে কেবল পতাকা বা প্রতীকে, কিন্তু গভীরে প্রোথিত মানসিকতার কোনো সংস্কার হচ্ছে না। ফলস্বরূপ, সংস্কারের বুলি আউড়ে, নতুন স্বাধীনতার কথা বলেও আমরা দিনশেষে সেই একই জায়গায় আটকে থাকছি।

এই চক্র ভাঙতে হলে প্রয়োজন দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এক সম্মিলিত প্রতিরোধ। প্রয়োজন এমন এক ইন্টারসেকশনাল নারীবাদী রাজনীতির (Intersectional Feminist Politics) যা শুধু নিজের দলের নারী নয়, বরং সব নারীর প্রতি হওয়া ডিজিটাল সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। এর জন্য দরকার দলমত নির্বিশেষে অনলাইন পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা, নারী রাজনীতিকদের সুরক্ষায় প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, পুরুষ রাজনৈতিক কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, এবং ফ্যাক্টচেকিং ও ডিজিটাল ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া (যেমনটি ফ্যাক্টচেকার শোয়েব আব্দুল্লাহ করেছেন)। এই সহিংসতা মূলত “নারীবাদী উত্থানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতিক্রিয়া” – অর্থাৎ, রাজনীতি ও সমাজে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ এবং সাফল্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের ভীতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বহিঃপ্রকাশ।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা আমাদের সবার কাছেই। এই রাজনীতি আসলে কার স্বার্থে? সংগঠনের নামে, দলের নামে যারা এই ন্যক্কারজনক কাজগুলো করেন, তারা কি আদৌ কোনো রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন, নাকি কেবল নিজেদের ভেতরের নারীবিদ্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীল সত্তাটাকেই প্রকাশ করেন? আমরা কবে মানুষ হবো? শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল নয়, প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার বদল, আমাদের সংস্কৃতির সংস্কার। রাজনীতিতে জড়িত প্রত্যেক নারীর জন্য একটি সুস্থ ও নিরাপদ অনলাইন পরিবেশ তৈরি করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। অন্যের পরিবারের নারী সদস্যকে নিয়ে গুজব ছড়ানো বা কুরুচিপূর্ণ আক্রমণ বন্ধ হোক। আসুন, নতুন সমাজ বা নতুন রাজনীতির কথা বলার আগে আমরা নিজেরা একটু সংস্কার হই, একটু মানবিক হই।

#IfYouAskUs
#BdFeministThoughts
#WhatAreBdFeministsThinking
#WomanUnite

শেয়ার করুন: