কী করলে বন্ধ হবে এই ধর্ষণ মহামারী?

সুপ্রীতি ধর:

আমি সত্যি সত্যিই জানতে চাই, কী করলে, কী উপায় অবলম্বন করলে দেশজুড়ে ধর্ষণের যে মহামারী লেগেছে তা বন্ধ হবে? আর কত লড়াই আমাদের করতে হবে এর বিরুদ্ধে? আমরা জানি যে যুদ্ধের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে নারী ধর্ষণ। এখন কি তবে দেশে যুদ্ধ চলছে?

ডেইলি স্টারের রিপোর্টে পড়লাম, “গত পাঁচ বছরে ২ হাজার ৬২৪ জন নারী ও মেয়ে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২০২৫ সালেও পরিস্থিতি একইরকম রয়ে গেছে, প্রথম দুই মাসের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। অন্তত ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১০৭ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬৬ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
আরও ২৭ জন নারী ও শিশুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৯ জন যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১৬ জনই শিশু। যৌতুক-সম্পর্কিত সহিংসতার কারণে মারা গেছেন ছয় জন নারী, আহত হয়েছেন দুইজন”।

কী বার্তা দেয় এই প্রতিবেদন? দেশের খবরের দিকে চোখ মেলে কোন ভালো খবর পাই না। অথচ ভালোর জন্যই পরিবর্তন চেয়েছিলাম। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র নামক গালভরা শব্দগুলোর অবসান ঘটুক, এমনটাই চেয়েছিলাম। অথচ বাস্তবে কী হলো? দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ছেয়ে যাওয়া স্বৈরাচারি একটা সরকারের হাতবদল হয়ে আরেক রাক্ষসের হাতে পড়েছে দেশ। এইজন্যই কি এতোগুলো মানুষ প্রাণ দিয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থানে?

ছোট্ট আছিয়া মৃত্যুর সাথে লড়ছে (ইউরোপের মধ্যরাতে লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত)। চিকিৎসকরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ওকে বাঁচাতে। কিন্তু ও যদি এই যাত্রায় প্রাণে বেঁচেও যায়, ও কি আদৌ বেঁচে থাকবে? এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে? সমাজ কি ওকে বাঁচতে দেবে? একটা ছোট্ট কচি প্রাণ, ছোট্ট নরম তুলতুলে শরীর কীভাবে খাবলে খেয়ে নিল নরপিশাচরা! তাও আবার তিন বাপছেলে মিলে! এটা কোন স্বাভাবিক ঘটনা? মানসিক বিকৃতি কোন পর্যায়ে পৌঁছালে সমাজে এমন ঘটনা ঘটে?

এমনটা নতুনও না। আমাদের ‘উন্নয়নের গালভরা গল্পসমৃদ্ধ’ দেশে আগেও এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। আমরা শাহবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আর লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, কিন্তু ধর্ষকরা ক্লান্ত হয়নি। তাদের কর্মকাণ্ড থামেনি কখনও। যেহেতু আইনের শাসন ছিল না এবং এখন আরও বেহাল অবস্থা, তারই ভয়াবহ থাবা পড়েছে নারী-শিশুর ওপরে। কোথাও কেউ নিরাপদ বোধ করছে না, না বাড়িতে, না রাস্তাঘাটে। আমি দূর থেকে অনুভব করতে পারছি মা-বাবারা কীভাবে আগলে রাখতে চাইছে তাদের মেয়েদের, কন্যাশিশুদের!

মেয়েশিশুদের কথা বলছি, ছেলেশিশুরাই কি বাদ পড়ছে এই ভয়াল থাবা থেকে? মাদ্রাসাগুলোতে কীনা হচ্ছে? একের পর এক বীভৎস ঘটনা বেরিয়ে আসছে, আর আমরা ভয়ে, ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। আমাদের মায়েদের নাভিমূলে ব্যথা বাড়ছে একেকটি ঘটনায়। ছোট্ট ছোট্ট প্রাণগুলোকে জীবনের শুরুতেই গলা টিপে ধরা হচ্ছে। এরপরে ওরা যতদিন বেঁচে থাকবে, ভয়াবহ অন্ধকার একটা জীবন তাদের জন্য অপেক্ষা করবে! কোন স্বাভাবিক জীবন তাদের হবে না। আর এর ছাপ পড়বে তাদের পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে।

খুবই আতংকজনক এক অধ্যায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। গত সাত মাস ধরে স্বাভাবিক পড়ালেখা প্রায় বন্ধ, মানুষের জানমালের নিশ্চয়তা নেই, খুন হয়ে যাচ্ছে, নারীদের পথেঘাটে নাজেহাল করা হচ্ছে, নারী নিপীড়কদের মব তৈরি করে ছাড়িয়ে আনা হচ্ছে ধর্মকে পুঁজি করে। এমন সব ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন যে আমরা সাধারণ মানুষেরা খেই হারিয়ে ফেলছি। সেখানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা ঘুমাচ্ছেন কী করে? নিজেদের ঘরে, সন্তানের সামনে মুখ দেখাচ্ছেন কীভাবে?

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কী করলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে? কী করলে আর কোন আছিয়াকে এই পরিস্থিতির শিকার হতে হবে না?

কোন স্বাভাবিক দেশ হলে হয়তো বলতাম অপরাধীর মানসিক চিকিৎসা হোক, কিন্তু যেহেতু আমরা মধ্যযুগে বা তারও আগের যুগে ফেরত গেছি বা সেখানেই রয়ে গেছি, তাই জোরালো দাবি জানাচ্ছি, ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এমন শাস্তি হোক, যাতে আর কেউ এই অপরাধ করতে কোনরকম উৎসাহ না পায়!

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার

শেয়ার করুন: