এগুলো কোন সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষণ হতে পারে না!

সেলিনা শেলী:

একজন বিচারপতি, শিক্ষক, অথবা সমাজের যেকোনো দায়িত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিকে ছাত্র ও জনগণের একাংশের এভাবে মেরে পঙ্গু ও পদত্যাগ করানো কোনো সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষণ হতে পারে না। আমরা প্রায় সবাই এই কাজটিতে ঘৃণা প্রকাশ করছি, মেনে নিতে পারছি না।

এই আমরা কারা? যাদের বয়স অন্তত ৩০/৩৫ এর বেশি। এখন গভীরভাবে ভাবতে হবে কেনো এই কিশোর প্রজন্ম এরকম মূল্যবোধহীন অমানুষ হয়ে উঠছে? আমরা কেবল নতুন দেশ, নতুন রাজনীতির দোহাই দিয়ে বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারি না। এর পেছনে বহু বছরের পারিবারিক, সামাজিক,সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আর্থিক ও শিক্ষাব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে।

একটি দেশে যদি দীর্ঘদিন গণতন্ত্র না থাকে, গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া না থাকে, বাক স্বাধীনতা না থাকে, যদি দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থের এক ভয়ংকর দাপুটে সমাজ সৃষ্টি হয়, কোনো অপরাধেরই জবাবদিহিতা ও বিচার না থাকে, যদি শিক্ষাব্যবস্থা, সিলেবাস, পরীক্ষা, ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সব জায়গায় দুর্নীতি অসততা, রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখানোর সুযোগ থাকে, যদি পরিবারের সদস্যরা প্রত্যেকে ফেসবুক টিকটকে মগ্ন থাকেন, সন্তানদের একান্ত সময় না দেন, পাড়া মহল্লায় ওয়াজের নামে নোংরা বিনোদন বন্ধ না করেন, নেশার অবাধ ব্যবসা বন্ধ না করেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে না তোলেন, শিক্ষাক্রমে কোনো ধর্মীয় পাঠ না রেখে সেটিকে পরিবারে বা আলাদা ব্যবস্থাপনায় শেখানোর ব্যবস্থা না করেন, যদি শিক্ষক নিয়োগে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে একজন শিক্ষকের মানবিক সৃজনশীল উচ্চতার দিকগুলো গুরুত্ব না দেন, শিক্ষক-ছাত্র যদি সিলেবাসের ভারে ন্যুব্জ হয়ে প্রকৃতি, মুভি, নাটক, ভালো বইয়ের পাঠ, আলোচনা ইত্যাদির সাথে শিক্ষাকে সংযুক্ত করতে না পারেন তাহলে এই চিত্র, অবক্ষয় বদলানো সম্ভব নয় বলেই আমার ধারণা। এক্ষেত্রে একটি দুর্নীতিমুক্ত জবাবদিহিমূলক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।জনগণ যদি সত্যিকার নিরপেক্ষ একটি সরকার চান, দল নয়, তাহলে প্রকৃত সৎ মানুষটিকে নির্বাচন করা জরুরি।

একটা ছোট্ট কিন্তু গভীর স্মৃতি মনে পড়লো। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ। কী একটা কাজে তখন কবি আবুল মোমেন অচিন্ত্য আইচদের ফুলকি স্কুলে গেছি! ১৯৮৮/৮৯ সাল হবে। একটা শিশু শ্রেণির শিক্ষক আসেননি।অচিন্ত্যদা বললেন– তুমি ক্লাস নিতে পারো।
আমি বললাম– কী পড়াবো? আমি তো কিচ্ছু জানি না!
উনি বললেন– তুমি সবাইকে ৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে সবচেয়ে প্রিয় সুন্দর স্মৃতিটা ভাবতে বলো।তারপর এক এক করে জিগ্যেস করো কে কী ভেবেছে।
দারুণ বিষয়!সারাজীবনে লাখো ক্লাস নিয়েছি। কিন্তু সেই ক্লাসের কথা কোনো দিন ভুলিনি। সেই পাঁচ মিনিট– শিশুদের কল্পনাশক্তি, স্মৃতিশক্তি বাড়াবার, ভেবে সেটি গুছিয়ে বলবার, এমনকী শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য কী ভীষণ জরুরি ছিলো পরে বুঝেছিলাম।

আমাদের সমাজ ও সন্তানের মনস্তত্ত্ব মনস্তাপ বোঝা সকলের জন্যে খুবই জরুরি।
আমি শিক্ষকতা, শিক্ষাপ্রশাসন চালানো ও সন্তানের অভিভাবক হিসেবে দেখেছি– আমাদের পুরো শিক্ষাসমাজে এক বিকারগ্রস্ততা কাজ করছে।ছাত্রদের যে কোনো বয়সেরই এক অংশকে কতকশিক্ষক ও ছাত্র বুলিং করছে।এটি কতোটা প্রবল এবং ভয়াবহ অনেকেই তা জানেন না! এর প্রভাবও ভীষণই ভয়ংকর!

দুর্নীতির ঘায়ে বিচারহীনতায় ক্ষমতার দম্ভে ধ্বসে পড়া সমাজকে কোনো একটি সরকার চাইলেই ঠিক করে ফেলতে পারবে না– যদি না জনগণ এগিয়ে আসেন। সেই জনগণ এখন হতাশ না হয়ে পাড়ায় পাড়ায় এক একটি সমন্বিত মানবিক সংঘ গড়ে তুলতে পারেন। এটি প্রতিটি এলাকায় হোক। যেখানে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। তারা নানা মাত্রিক সমাজ বিকাশের কাজ হাতে নিতে পারেন। আমাদের সন্তানদের সাথে মনঃযোগাযোগ বাড়াতে পারেন।তা নাহলে এই জাতির আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ আমাদের সঠিক পথ দেখাতে ব্যর্থ হবে।

শেয়ার করুন: