সুপ্রীতি ধর:
“সেলাই এর কাজ করে মেয়েকে বড়ো করেছি, সেলাই করেই খাবো। মেয়েকে হারিয়ে লক্ষ সন্তানের বাবা হয়েছি, তাই মেয়েকে বিক্রি করে টাকা নেব না।”
– কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে যখন কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে, এই ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও বিচারের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ‘রাতের দখল নাও কর্মসূচি পালন করেন নারীরা, সেইসময়ে ভিকটিম তিলোত্তমার বাবার এই কথাগুলো প্রাণে শক্তি আর সাহসের সঞ্চার করে আমাদের। এখনও তাহলে কিছু মানুষ অবশিষ্ট আছে এই শ্বাপদসংকুল ভূমিতে, যারা বিক্রি হয়ে যায় না।
খবরে প্রকাশ, ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার চাপের মুখে আছে। এ পরিস্থিতিতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় রাজ্য সরকারগুলোকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু ঘটনাচক্র যেভাবে ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে এবং একের পর এক মোড় নিচ্ছে তাতে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্নগুলোই রিপিট করতে চাই – “এরকম একটি ঘটনা একটি সরকারি হাসপাতালের অন্দরে ঘটে কী করে? তাও আবার মেয়েদের জন্যে সুরক্ষিত বলে পরিচিত কলকাতা শহরের বুকে? তড়িঘড়ি করে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই সিভিক পুলিশ কর্মী যদি সত্যিই দোষী হন, তাহলে তিনি রাতে হাসপাতালের ভিতরে কী করছিলেন ? ওটা কি তার ডিউটি ক্ষেত্র? বোঝাই যাচ্ছে পুরো সিস্টেমের ভেতরে বাসা বেঁধেছে চুর ঘুণপোকা। সেগুলো সময় থাকতে চিহ্নিত করার দায়িত্ব তো প্রশাসনের। তা কি করছে প্রশাসন?
এই ঘটনার পর প্রশাসনের ভূমিকা কি এরকম হওয়ার কথা ছিল?
কখনো ” অস্বাভাবিক মৃত্যু ” কখনো “আত্মহত্যা ” বলার চেষ্টা কেন হবে?
মধ্যরাত্রেই ঘটনাস্থলে ময়না তদন্ত? এর কী মানে?
যে অধ্যক্ষ থাকাকালীন এরকম একটি ঘটনা ঘটে এবং যে দায় এড়িয়ে মেয়েটির গতিবিধি নিয়েই প্রশ্ন তোলে, তাকে শাস্তিমূলক নির্বাসনে পাঠানো হলো না কেন? বরং শহরের আরেকটি মুখ্য মেডিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষ পদে আসীন করা তো প্রায় প্রোমোশনের সমান। এ কেমন ন্যায়বিচার?
এই সমস্ত নিয়ে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হওয়াটা কি অস্বাভাবিক?
আর জি করে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা হলো কেন? আর সেটিকে আবার বিরোধীদের কাজ বলে চালানোর কি অর্থ?
ঘটনাস্থল থেকে তথ্য প্রমাণ লোপাট করে তাদের কী লাভ? বিরোধী রাজনৈতিক দল তো তাদের কাজ করবেই ! গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তো সেটাই স্বাভাবিক ! তারা যদি বিরোধী হতেন রাজ্যে (যেমন আগে ছিলেন) তাহলে তারাও ঠিক এটাই করতেন (যেমন আগে করতেন! বা যেমন এখন কেন্দ্রের অনেক নীতি বিরোধিতা করে কর্মসূচি নেন) সেটাই তো কাম্য! কিন্তু ১৪ তারিখ রাতে যে লাখ লাখ মানুষ পথে নামলো বিচার চেয়ে, সেইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু, তারা সবাই বিজেপি বা সিপিএম এর সদস্য? বা তাদের দ্বারা চালিত?
সমাজের যেকোনো বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনার ঘটনায় বিরোধী রাজনৈতিক দল যে মাঠে থাকবে সে তো বলাই বাহুল্য! সুশীল সমাজের একটা বিচারকামী আন্দোলনকে পুরোপুরি নিজেদের আওতায় নিয়ে আসার বা নিজেদের রং লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আপনারাই সুবিধে করে দিচ্ছেন! এই সব কথা বলে, মেরুকরণ তৈরি করে মানুষকে রাগিয়ে দিয়ে বিরোধীদের পরিসর বড়ো করে দিচ্ছেন!
আমরা সকলে একটা অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, অন্ধকার সময় বললেও ভুল হবে হয়তো। নাগরিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে এমন সাংঘাতিক হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা আর ভীতির সম্মুখীন আমরা সকলেই খুব কম হয়েছে সম্প্রতি। মানসিক অবসাদ আর হতাশায় অনেকেই আমরা বিপর্যস্ত, উদ্বিগ্ন। আমরা সকলে সবসময় দুঃসংবাদ আর ভয়াবহতার চেহারা দূর থেকে দেখতে অভ্যস্ত, আমাদেরই দূরদর্শিতা এবং মানবিকতার অভাবে আমরা বুঝতে পারি না আসলে কোনো ঘটনাই দূরের এবং বিক্ষিপ্ত বা বিচ্ছিন্ন নয়, ঘটনা দূরের হোক বা কাছের, আগুন আমাদের নিজেদের গণ্ডি পেরিয়ে আঁচ সরাসরি এসে পড়বেই আমাদের ওপর।
আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার শাসকদের সমস্যা হলো, গণতন্ত্রের লেবাস ধরে ক্ষমতায় এসেই তারা একনায়ক বনে যান। অতীতের ভুল থেকে কমই শিক্ষা নেন। আর মাঝখান থেকে আমজনতা এর কুফল ভোগ করে। আমরা জনতাও এই ভুলগুলো করতে দিই নানানরকম হিসাব-নিকাশ থেকে। ফলে বঞ্চিতের, শোষিতের ন্যায়বিচার পাওয়া দু:সাধ্য হয়ে উঠে।
হয়তো এখন সময় এসেছে সেইসব ভুলচুকগুলো শুধরে নতুন পথে হাঁটার। কলকাতার প্রতিবাদের সাথে আমরা সবাই একাত্ম্য আজ। মেয়েরা আজ প্রশ্ন করতে শিখেছে, এখন আর তাদের নানান বিশেষণে দমিয়ে রাখার কোন উপায় নেই।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার