শঙ্খিনী ঐন্দ্রীলা:
তনুর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল শিল্পকলায়। আর দশটা জুনিয়র এর মতো সহজভাবেই মিশেছি ওর সাথে। প্রথম থেকেই ওর আচরণগত পার্থক্য টের পেতাম। ছেলেটা নাচ শেখায়; ইন্ডিয়া থেকে বিউটিশিয়ন এর কোর্স করে এসেছে। কথাবার্তার ঢং বেশ মেয়েলী। অন্যদের কাছে শুনতে পাই ওর অনেক গসিপ, রিউমারও হতে পারে। আমলে নেইনি। নেয়ার মতো স্বভাব নেই আসলে। আমি মনে করি প্রত্যেকটা মানুষের নিজের মতো করে জীবন-যাপন করার অধিকার আছে। কে, কীভাবে বেঁচে আছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানো মানেই তার ব্যক্তিগত জীবনে পোক করা, ব্যাপারটা অরুচিকর লাগে।
শিল্পকলার একটা অংশ আছে যাদের আগ্রহ মূলত অন্যের জীবন নিয়ে গসিপ করা। এমন মানুষ বোধহয় সবখানেই থাকে! বুদ্ধিজীবী গত্রের এক ইন্টেলেক্ট বন্ধু’র মুখেই প্রথম শুনতে পাই তনু ‘গে’। সে খুব একটা সরলভাবে কথাটি বলেনি। আড্ডার সবার রস উৎপাদন করে, প্রচুর অঙ্গভঙ্গি সমেত একটা রগরগে গল্প আমাদের পাতে দিয়েছিল; তার গল্পের সফলতায় একজন দু’জন নিজেদের বক্তব্যও দিয়ে দিল।
একজন তো বললো, সে তনুর এইসব বদ খাসিলতের কথা জানতো না বলে, তার সাথে বন্ধুত্ব করেছিল, কিন্তু পরে ওর স্বভাব দেখে আর তার পাশে ঘেঁষেনি। কথাটা হজম হলো না। আমি তনুকে যতদূর দেখেছি ওর পুরুষ সংক্রান্ত উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভঙ্গিটি অত্যন্ত খোলামেলা, আমার তৎকালীন প্রেমিকের ব্যাপারেও ওর আগ্রহ দেখেছি। আমার সামনেই সে সেটা প্রকাশ করেছে। তাই প্রতিবাদ না করে পারলাম না। কিন্তু আমার যা ইমেজ বন্ধুদের কাছে, তা হলো, আমি পুরোপুরি মাথা খারাপ একটা মেয়ে। তাই যখন বললাম- তনু তো সাইনবোর্ড নিয়ে ঘুরে যে ও গে। তোমরা কেন দেখতে পাও না? সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো, যেন খুব মজার কথা বলেছি। নিজের উপরেই বিরক্ত লাগলো। কেন যে এদের সাথে কথা বলি!
যাই হোক, তনুকে আমার ভালো লাগে। মাঝে মধ্যে পাশে এসে বসে। কেমন সখীর মতো করে কথা বলে। এতো মেয়েলিপনা মেয়েদের মধ্যেও নেই! ভালো লাগে ওর হুট-হাট উদাস হয়ে যাওয়া। কুল ছেলে দেখে কানে কানে বলা, ‘দিদি দেখো; ছেলেটা কী সুন্দর!’ আমিও ওর চোখ দিয়ে দেখতে থাকি ছেলেটাকে। আগেও হয়তো দেখেছি, কিন্তু তেমন আহামরি লাগেনি, তনু বলার পর মনে হয় আসলেই সুন্দর!
ছেলে দেখে তরল হওয়া আমাকে দিয়ে হয় না, আমি সাইলেন্ট এডমায়ারার। কিন্তু তনুর সাথে বসে ছেলে মাপতে মন্দ লাগে না। আমার একবারের জন্যেও মনে হয় না, সে নিজেই শারিরীকভাবে ছেলে। আমি ওর শরীর দেখতে পাই না, দেখতে পাই ওর বিচিত্র মনটাকে। যেটা একজন আর্টিস্ট হয়ে উঠতে চায় প্রাণপনে, কিন্তু নিজের বৈচিত্র্যের ভারে নুয়ে থাকে। মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টায় অপাঙক্তেয় জেনেও রোজ রোজ এই ঐ আড্ডায় বেহায়ার মতো বসে থাকে। নিজেকে ফিট করার চেষ্টায়। হয় না, তারপর ফিরে যায় নিজের একলা জগতে।
তনুদের মতো যারা, তাদের সাথে মেশাটা নারী-পুরুষ কেউও খুব আরামদায়ক ভাবে না আসলে। আমরা যারা যৌন জীবনে ভীষন প্রথাগত, তাদের কাছে ও ট্যাবু। আমি তনু’কে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ২০১৪ সালের দিকে ও আমার কাছে একটা আবদার করে, ওর ছেলেবেলার একটা স্মৃতি আছে একটা গাছ নিয়ে, গাছটা কেটে ফেলার পর ওর খুব কষ্ট হয়েছিল, সেই বয়সটাতে একই সাথে ওর চারিত্রিক বৈচিত্র্যতার মুখোমুখি হচ্ছিল। দু’টা ব্যাপার নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ও হাঁসফাঁস করছিল। সে সময়টা নিয়ে একটা স্ক্রিপ্ট করতে চায়, নাচের, আমার সাহায্য দরকার। আমার আগ্রহ হলো। ওর সাথে আরো ডিটেলে মিশতে শুরু করলাম। ওর বাসায় যেয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগল। একই উঠানের ভেতর পারিবারিক বাড়িতেই ও আলাদা একটা ঘরে থাকে, বিচ্ছিন্ন। ভীষণ সাদামাটা কিন্তু আশ্চর্য নান্দনিক করে সাজানো। এক চিলতে মাটি আছে ঘরের পেছন দিকে, সেখানে গাছ দিয়ে ভরে ফেলেছে। ধ্রুপদী নাচের একটা আবহ আছে বসবাসের মধ্যে।
তনুর ভেতরটা ভীষণ তুলতুলে, আমার মনে হতো ওর পারিবারিক আবহ বোধহয় তুলতুলেই হবে, বাস্তবে একদম বিপরীত।পরিবারটির সবার সাথে সবার জটিল সম্পর্ক। তনুর সাথে সবচেয়ে বেশি। জীবন যাপন পদ্ধতি নিয়ে প্রচুর গঞ্জনা সহ্য করেও সে এই বাড়িতেই পড়ে আছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে। আমার কেমন অবশ লাগতে থাকে দিন দিন। নিজের ভেতর তোলপাড় টের পাই।
কেন আমরা এতোটা অনুদার? এই বঙ্গ সমাজে বাই সেক্সুয়ালিটির জায়গা আছে তলে তলে। এমন পুরুষের অভাব নেই যারা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার করে, এবং লুকিয়ে হোমোসেক্সুয়ালিটির চর্চা করে। তাদের বেলায় আমরা জেনেও না জানার ভান করি। অনেক ছেলেরই শৈশব-কৈশোরে অন্য ছেলেদের সাথে টুকটাক শারীরিক সম্পর্ক হয়। মাদ্রাসাগুলো নিয়ে হাজারটা ডার্টি জোকস আছে। আর মেয়েদের ব্যাপারে কেউ এসব প্রসঙ্গ টানে না ঠিকই, কিন্তু কম-বেশি সব মেয়েই বান্ধবীর সাথে নিছক খেলার বশে, আগ্রহ বশে একটু আধটু যৌনতার স্বাদ নেয়। তাহলে তনুর মতো একজন মানুষ, যার কোন রাখ-ঢাক নেই, যে স্ব-উচ্চারিত, তাকে কেন সবাই এতো একঘরে করে রাখে!
আমি দেখেছি তনু চাইলেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু রাখে না। এটা কি ওর সততা নয়? তাহলে তনুর মতো একজন সৎ মানুষ কী করে হাসির পাত্র হয়?
পাণ্ডুলিপি লেখা হলো। আমিই লিখলাম মূলত। নৃত্যনাট্যের রুপ দিল তনু। যদিও অর্থের অভাবে কাজটা এখনও আলোর মুখ দেখেনি….।
লেখাটা লিখতে যেয়ে আমি আবিষ্কার করেছি একটা ভিন্ন জগত, ওর সাথে মেলামেশার সুবাদে আরও দু’একজন হোমোসেক্সুয়াল মানুষের সাথে পরিচয় হলো, একেক জনের স্বভাবগত বৈচিত্র্য আমাকে মুগ্ধ করলো, তবে তনুর মতো সৎ কাউকে পাইনি। যৌন জীবন নিয়েও আমরা বেশ খোলামেলা কথা বলেছি। অবাক হয়ে দেখলাম, নারী হিসেবে আমার অনেক অনুভূতির সাথেই ওর অনুভূতি মিলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে টের পেলাম ওর ভেতরটা পুরোপুরি মেয়েদের মতো। প্রেমিকের প্রতারণায় ও সারারাত কেঁদে বালিশ ভেজায়। নিজেকে সাজাতে বড় ভালোবাসে। কখনো কখনো উদাস হয়ে বলতো; আমি এমন কেন হয়েছিরে! আর হয়েছি, এটা কি আমার পাপ?
কখনো উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না আসলে। জীবনের কোনো না কোনো সময় আমরা সবাই কি এটাই ভাবি না? আমি এমন কেন! তনু এমন কারণ প্রকৃতি তেমনটা চেয়েছে, এখানে কারো কিছু করার নেই আসলে, তার চেয়ে বড় কথা তনু নিজেই এমনটা চায়। তাহলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়?
অনেকবার শুনেছি গে ছেলেরা মেয়েদের খুব ভালো বন্ধু হয়। মেয়েরা তাদের কাছে নিরাপদ। কথাটা সর্বাংশে সত্য। তনুর সাথে আড্ডা দিতে গেলে কোনদিন মনে হয়নি, কাপড় সামলে বসি। ওড়না টেনে বসি, নির্ভার, খোলামেলা হয়ে কথা বলতে পেরেছি। অর পাশে শুয়ে থেকেও মনে হয়নি কিছু হওয়ার চান্স আছে! এই সাবলীলতা ছেলেদের সাথে সম্ভব নয় আসলে। মেয়েলী সংকীর্ণতা ছাড়াও নিজের অনুভূতির উপরেই কি আসলে ভরসা করা যায়! কখন মন চোর হয়ে উঠে কে জানে……।
তনু’র সাথে সেসবের বালাই নেই। ঝরঝরে নিখাদ বন্ধুত্ব। আসলেই গে ছেলেরা মেয়েদের ভালো বন্ধু হয়। তনু আমার খুব ভালো বন্ধু। ও একটা পার্লার করেছে, চলছে না, চলার কথাও না। তনুদের এটাই হবার কথা। আজকাল দেখা হয় না তেমন। কিন্তু ওকে কখনো ভুলে যাই না আমি। মাঝে মধ্যে ফোন করলে ওর হতাশ গলা শুনি। অর্থনৈতিক সংকট, পারিবারিক জটিলতার ভেতরেও ওর প্রেমহীন জীবন নিয়ে হা-হুতাশ শুনি। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলি, এতো প্রেম প্রেম করিস কেন? প্রেম ছাড়া আর কিছু নাই দুনিয়ায়! তোর এতো গুণ; এগুলোকে কাজে লাগা নারে, প্রেম আসার হলে আসবে।
আমার কথায় ও আরও বিমর্ষ হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে আমিও গুমড়ে উঠি। তনু জানে, ওর জীবনে গগনবিদারী প্রেম আসবে না কোনদিনও। তাই কি প্রেমের জন্য এতো হাহাকার ওর! তনু একজন সংবেদনশীল মানুষ চায়, অনেস্ট প্রেমিক চায়। কিন্তু তনু কি বোঝে না, এই সমাজ ব্যবস্থায় ও কখনোই এটা পাবে না! ওকে বলি, বাইরে চলে যা। উপায় থাকলে যেত হয়তো, উপায় নেই আসলে। তাই প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে সে। আজকাল বাসা থেকে বের হয় না। আগে নাচের প্রোগ্রাম করতো এদিক-ওদিক। আজকাল তাও করে না বললেই চলে। নাচ শেখায় বোধহয় বাচ্চাদের। টুকিটাকি ইনকাম দিয়ে হেঁচড়ে-পেচড়ে জীবন কাটাচ্ছে।
সাধারণ মানুষদের কথা ছেড়ে দিলাম, তাদের ধ্যান ধারণার বদল যে খুব সহজ নয় তাতো জানা কথা, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ, আর্টিস্ট সমাজই দেখতে পেল না, তনু একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। একজন খুব ভালো নৃত্যশিল্পী, মেকআপ আর্টিস্ট পেশায়। তারা দেখতে পেল, তনুর যৌন জীবন। যা কিনা একান্ত ব্যক্তিগত একটা বিষয়। তারা চিনল গে তনু’কে। নৃত্য শিল্পী তনুকে না।